তারাপীঠ পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার রামপুরহাট শহরের কাছে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র মন্দির নগরী। এই শহর তান্ত্রিক দেবী তারার
মন্দির ও মন্দির-সংলগ্ন শ্মশানক্ষেত্রের জন্য বিখ্যাত। হিন্দুদের
বিশ্বাসে, এই মন্দির ও শ্মশান একটি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। এই মন্দির শাক্তধর্মের পবিত্র একান্ন একান্ন সতীপীঠের অন্যতম। এই স্থানটির নামও এখানকার ঐতিহ্যবাহী তারা আরাধনার সঙ্গে যুক্ত।[১][২][৩][৪] তারাপীঠ এখানকার "পাগলা সন্ন্যাসী" বামাক্ষ্যাপার
জন্যও প্রসিদ্ধ। বামাক্ষেপা এই মন্দিরে পূজা করতেন এবং মন্দির-সংলগ্ন
শ্মশানক্ষেত্রে কৈলাসপতি বাবা নামে এক তান্ত্রিকের কাছে তন্ত্রসাধনা করতেন।
বামাক্ষ্যাপা তারা দেবীর পূজাতেই জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। মন্দিরের অদূরেই
তাঁর আশ্রম অবস্থিত।
ভূগোলতারাপীঠ বীরভূম জেলার মারগ্রাম থানার অধীনস্থ সাহাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি ছোটো গ্রাম । এটি দ্বারকা নদীর তীরে অবস্থিত।[৬]
প্লাবন সমভূমির সবুজ ধানক্ষেতের মধ্যে এই তীর্থস্থান অবস্থিত। কিছুকাল
আগেও বাংলার সাধারণ মাটির বাড়ি আর মেছোপুকুরে ভরা গ্রামের থেকে তারাপীঠের
খুব একটা পার্থক্য ছিল না।[৭] বর্তমানে অবশ্য তীর্থমাহাত্ম্যের কারণে প্রচুর জনসমাগম হওয়ায় গ্রামটি ছোটোখাটো শহরের আকার নিয়েছে। জেলার রামপুরহাট মহকুমার সদর রামপুরহাট শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে তারাপীঠ অবস্থিত। রামপুরহাট ও চাকপাড়ার 'তারাপীঠ রোড' রেল স্টেশনদুটি তারাপীঠের নিকটতম রেল স্টেশন।
কিংবদন্তি ও গুরুত্বতারাপীঠ
মন্দিরের উৎস ও তীর্থমাহাত্ম্য সম্পর্কে একাধিক কিংবদন্তি লোকমুখে
প্রচারিত হয়ে থাকে। এগুলির মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কিংবদন্তি হল
"শক্তিপীঠ" ধারণাটির সঙ্গে যুক্ত পৌরাণিক কাহিনিটি। শিবের স্ত্রী সতী তাঁর পিতা দক্ষের
"শিবহীন" যজ্ঞ সম্পাদনার ঘটনায় অপমানিত বোধ করে। স্বামীনিন্দা সহ্য করতে
না পেরে তিনি যজ্ঞস্থলেই আত্মাহুতি দেন। এই ঘটনায় শিব ক্রুদ্ধ হয়ে সতীর
দেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয়নৃত্য শুরু করেন। তখন বিষ্ণ শিবের ক্রোধ শান্ত করতে সুদর্শন চক্র
দ্বারা সতীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড করে দেন। সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে ছিন্ন হয়ে
পৃথিবীর নানা স্থানে পতিত হয়। এইসকল স্থান "শক্তিপীঠ" নামে প্রসিদ্ধি লাভ
করে। পশ্চিমবঙ্গেও এই রকম একাধিক শক্তিপীঠ অবস্থিত। এগুলির মধ্যে
সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ পীঠ হল কালীঘাট ও তারাপীঠ।[২][৩] সতীর তৃতীয় নয়ন বা নয়নতারা তারাপুর বা তারাপীঠ গ্রামে পড়ে এবং প্রস্তরীভূত হয়ে যায়।[৮] ঋষি বশিষ্ঠ প্রথম এই রূপটি দেখতে পান এবং সতীকে তারা রূপে পূজা করেন। অপর একটি কিংবদন্তি অনুসারে: সমুদ্র মন্থনের
সময় উত্থিত হলাহল বিষ পান করার পর বিষের জ্বালায় শিবের কণ্ঠ জ্বলতে শুরু
করে। এই সময় তারাদেবী শিবকে আপন স্তন্য পান করিয়ে তাঁর জ্বালা নিবারণ
করেন। স্থানীয় কিংবদন্তী অনুসারে, বশিষ্ঠ তারাপীঠ নামে প্রসিদ্ধ এই তীর্থে
দেবী সতীর পূজা শুরু করেন।[১][৯] পীঠস্থানগুলির মধ্যে তারাপীঠ একটি "সিদ্ধপীঠ", অর্থাৎ এখানে সাধনা করলে সাধক জ্ঞান, আনন্দ ও সিদ্ধি বা অলৌকিক ক্ষমতা প্রাপ্ত হন।[১০] লোকমুখে প্রচারিত একটি কিংবদন্তী অনুসারে, বশিষ্ঠ এখানে তারাদেবীর তপস্যা করেছিলেন। কিন্তু তিনি অসফল হন। তখন তিনি তিব্বতে গিয়ে বিষ্ণুর অবতার বুদ্ধের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বুদ্ধ তাঁকে বামমার্গে মদ্যমাংসাদি পঞ্চমকার
সহ তারাদেবীর পূজা করতে বলেন। এই সময় বুদ্ধ ধ্যানযোগে জানতে পারেন
মন্দিরে তারামূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজার করার আদর্শ স্থান হল তারাপীঠ।
বুদ্ধের উপদেশক্রমে বশিষ্ঠ তারাপীঠে এসে ৩ লক্ষ বার তারা মন্ত্র জপ করেন।
তারাদেবী প্রীত হয়ে বশিষ্ঠের সম্মুখে উপস্থিত হন। বশিষ্ঠ দেবীকে অনুরোধ
করেন বুদ্ধ যে শিশু শিবকে স্তন্যপানরতা তারাদেবীকে ধ্যানে দেখেছিলেন, দেবী
যেন সেই রূপেই তাঁকে দর্শন দেন। দেবী সেই রূপেই বশিষ্ঠকে দর্শন দেন এবং এই
রূপটি প্রস্তরীভূত হয়। সেই থেকে তারাপীঠ মন্দিরে শিশু শিবকে স্তন্যপানরতা
মূর্তিতে দেবী তারা পূজিত হয়ে আসছেন।[৯][১১] শাক্তধর্মের তারাপীঠ ও বৈষ্ণবধর্মের নবদ্বীপ বাঙালি হিন্দুদের নিকট সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ রূপে পরিগণিত হয়। তারাপীঠ মন্দিরতারাপীঠের তারার প্রতিমূর্তি, দক্ষিণ কলকাতার বেহালার একটি কালীপূজা মণ্ডপে তারাপীঠ
মন্দিরটি গ্রাম বাংলার যে কোনো মধ্যম আকারের মন্দিরেরই অনুরূপ। কিন্তু তা
সত্ত্বেও এত বৃহৎ একটি তীর্থক্ষেত্রে হিসেবে এই মন্দিরের বিকাশের কারণ হল
"মন্দির-সংক্রান্ত কিংবদন্তি, পশুবলি সহ এই মন্দিরের পূজাপদ্ধতি, এখানে
গেয় ভক্তিগীতিসমূহ, স্থানীয় জলাশয়গুলির অতিলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে
লোকবিশ্বাস, এবং শ্মশানক্ষেত্রের অধিবাসী ও সেখানকার সাধনপদ্ধতি।"[১২] মন্দিরটি
লাল ইঁটে নির্মিত। এর ভিতের দেওয়াল বেশ মোটা। উপরিভাগে শিখর পর্যন্ত
একাধিক ধনুকাকৃতি খিলান উঠেছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবীমূর্তি সংস্থাপিত।
শিশু শিবকে স্তন্যপানরতা তারার মূল প্রস্তরমূর্তিটি একটি তিন ফুট উঁচু ধাতব
মূর্তির মধ্যে রাখা থাকে। দর্শনার্থীরা সাধারণত ধাতব মূর্তিটিই দর্শন করে
থাকেন। এই মূর্তিটি তারা দেবীর ভীষণা চতুর্ভূজা, মুণ্ডমালাধারিণী এবং
লোলজিহ্বা মূর্তি। এলোকেশী দেবীর মস্তকে রৌপ্যমুকুট থাকে। বহির্মূর্তিটি
সাধারণট শাড়ি-জড়ানো অবস্থায় গাঁদা ফুলের মালায় ঢাকা অবস্থায় থাকে।
মূর্তির মাথার উপরে থাকে একটি রুপোর ছাতা। মূর্তিটির কপালে সিঁদুর লেপা
থাকে। পুরোহিতেরা সেই সিঁদুরের টীকা পরিয়ে দেন দর্শনার্থীদের। ভক্তরা
নারকে, কলা বা রেশমি শাড়ি দিয়ে দেবীর পূজা দেন।[১৩][১৪] তারাদেবীর মূল মূর্তিটিকে "তারার কোমল রূপের একটি নাটকীয় হিন্দু প্রতিমা" বলে অভিহিত করা হয়েছে।[৯] ভক্তেরা
মন্দিরে প্রবেশের পূর্বে মন্দির-সংলগ্ন পবিত্র জলাশয়ে স্নান করেন। তারপর
মন্দিরে প্রবেশ করে পূজা দেন। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই জলাশয়ের জলে
আরোগ্যক্ষমতা বিদ্যমান।[১৫][১৫]
মন্দিরের রোজই পশুবলি হয়ে থাকে। ভক্তেরা এই মন্দিরে ছাগ বলি দিয়ে থাকেন।
বলির পূর্বে ছাগটিকে পবিত্র জলাশয়ে স্নান করানো হয়। বলিদাতা নিজেও স্নান
করে পবিত্র হন। ছাগটিকে হাঁড়িকাঠে খড়্গের এক কোপে বলি দেওয়া হয়। বলির
পর ছাগটির রক্ত সংগ্রহ করে দেবীকে নিবেদন করা হয়। ভক্তেরা এই রক্তের তিলকও
কপালে আঁকেন। শ্মশানঘাটকথিত আছে, তারাপীঠের শ্মশানক্ষেত্রে দেবীর অধিষ্ঠান। শহরের
এক কোণে নদীর ধারে ঘন অরণ্য বেষ্টিত তারাপীঠ শ্মশানটি অবস্থিত। শ্মশানটি
লোকালয় থেকে দূরে। তারাপীঠের শ্মশানটি শক্তিপীঠের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, তারা দেবীকে শ্মশানের অন্ধকারে বলিপ্রদত্ত ছাগের রক্ত
পান করতে দেখা যায়।[১৬] তন্ত্রসাধকরা
বিশ্বাস করেন নরকঙ্কাল ও শ্মশানক্ষেত্র তারা দেবীর বিশেষ প্রিয়। দেবীর যে
সকল চিত্র আঁকা হয়ে থাকে, তাতে তাঁকে শ্মশানক্ষেত্রনিবাসিনী রূপেই দেখানো
হয়। এই কারণে তন্ত্রসাধকেরা শ্মশানক্ষেত্রকেই তাঁদের সাধনস্থল হিসেবে
বেছে নেন। অনেক সাধুই পাকাপাকিভাবে এখানে বাস করেন।[১৭][১৮]
শ্মশানে অনেক জটাধারী ভষ্মমাখা সাধু দেখা যায়। তাঁরা বটবৃক্ষের তলায়
নিজেদের কুটির সৃজন করে বাস করেন। এই সব কুটিরের মাটির দেওয়ালে তাঁরা
সিঁদুরমাখানো নরকপাল গ্রথিত করে রাখেন। কুটিরের দেওয়ালে শোভা পায় গাঁদার
মালায় শোভিত হিন্দু দেবী ও তারাপীঠের সন্তদের ছবি। কুটিরের প্রবেশ পথের
কাছে অনেক সময়েই মাল্যভূষিত ত্রিশূল ও নরকপাল রেখে দেওয়া হয়।
তন্ত্রসাধনায় মানুষ ছাড়াও সাপ, ব্যাং, শিয়াল ও খরগোসের করোটি প্রয়োজন
হয়। এগুলির পাশপাশি সাপের খোলসও কুটিরে রাখা থাকে। ভাল নরকপাল পূজা ও
মদ্যপানের জন্য ব্যবহৃত হয়। কুমারী মেয়ে ও আত্মহত্যাকারী ব্যক্তিদের
মাথার খুলির অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করা হয়।[১৮] বামাক্ষ্যাপাউনিশ শতকের তান্ত্রিক সাধক বামাক্ষ্যাপা তারাপীঠের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ সাধক হলেন বামাক্ষ্যাপা (১৮৪৩-১৯১১)। মন্দিরের নিকটেই তাঁর আশ্রম ছিল।[১৭] বামাক্ষ্যাপা ছিলেন তারাদেবীর একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি মন্দিরে পূজা করতেন এবং শ্মশানে সাধনা করতেন।[১৭] তিনি ছিলেন উনিশ শতকের অপর প্রসিদ্ধ কালীভক্ত রামকৃষ্ণ পরমহংসের
সমসাময়িক। অল্প বয়সেই তিনি গৃহত্যাগ করেন এবং কৈলাসপতি বাবার সান্নিধ্যে
তন্ত্রসাধনা শুরু করেন। পরে তিনি সমগ্র তারাপীঠের প্রধান ধর্মীয়
ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। ভক্তেরা তাঁর কাছে আশীর্বাদ বা আরোগ্য প্রার্থনা
করতে আসত। কেউ কেউ আবার শুধুই তাঁকে দর্শন করতে আসত। তিনি মন্দিরের নিয়ম
মানতেন না। একবার নৈবেদ্য নিবেদনের পূর্বে খেয়ে ফেলে তিনি পুরোহিতদের রোষ
দৃষ্টিতে পড়েছিলেন। শোনা যায়, এরপর তারাদেবী নাটোরের
মহারানিকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে দেবীর পুত্র বামাক্ষ্যাপাকে প্রথমে ভোজন
করাতে আদেশ দেন। এরপর থেকে মন্দিরে দেবীকে নৈবেদ্য নিবেদনের পূর্বে
বামাক্ষ্যাপাকে ভোজন করানো হত এবং কেউ তাঁকে বাধা দিতেন না।[৫] কথিত আছে, তারাদেবী শ্মশানক্ষেত্রে ভীষণা বেশে বামাক্ষ্যাপাকে দর্শন দিয়ে তাঁকে স্তন্যপান করিয়েছিলেন।[১৭]
লেখাটি সম্পূর্ণ ই উইকি পিডিয়ার এই পৃষ্ঠা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। তাই তাদের এই মহৎ কর্ম তাদের উদ্দেশ্যেই উৎসর্গ করছি যারা এই আর্টিকেলটি তৈরী করেছেন। ধন্যবাদ।
|