যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তি রূপেন সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ\’ দেবী পূজার মূল উত্স হচ্ছে সনাতন ধর্মের আদি শাস্ত্র বেদ। অভৃশ্য ঋষির কন্যা ব্রহ্মবাদিনী বাক সর্বপ্রথম তার অতীন্দ্র ধ্যাননেত্রে আবিষ্কার করেন দেবীসূক্ত। এই দেবীসূক্তই হচ্ছে মাতৃবন্দনার মঙ্গলসূত্র। যুগন্নিয়ন্ত্রী মহাশক্তি শুধু পুরুষ দেবতারূপে আমাদের পূজার পাত্র হননি, স্ত্রী দেবীর মাধ্যমেও মহাশক্তিকে আরাধনা করা হচ্ছে যুগে যুগে। শরতের শারদীয় উত্সব। শারদীয় উত্সব মানেই দুর্গাপূজা। মাতৃরূপে, পিতৃরূপে, শক্তিরূপে, শান্তিরূপে, বিদ্যারূপে আবির্ভূতা এক মহাশক্তি। তিনি সম্মিলিত দেবশক্তির প্রতীক। অসুর অর্থাত্ অপশক্তি বিনাশে দেবতারা তাদের সম্মিলিত শক্তিতে সৃষ্টি করেন মহাশক্তি মহামায়া। পুরাণের মত অনুসারে, শিবের তেজে দেবীর মুখ, যমের তেজে কেশ, বিষ্ণুর তেজে বাহুসমূহ, চন্দ্র তেজে স্তনদ্বয়, ইন্দ্রের তেজে মধ্যভাগ, বরুণের তেজে জংঘা ও উরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল।... মহাদেব দিলেন শূল, কৃষ্ণ দিলেন চক্র, শঙ্খ দিলেন বরুণ, অগ্নি দিলেন শক্তি... (দ্রঃ হংসনারায়ণ, ১৯৮০, ১৭৫) এই হলো বিপদনাশিনী দেবীমাতা দুর্গামাতা। দুর্গতি হতে ত্রাণ করেন বলেই দেবীর নাম হয়েছে দুর্গা। রাজ্যভ্রষ্ট রাজা যুধিষ্ঠির বিপদ থেকে মুক্তিলাভ করার জন্য মা দুর্গার আরাধনা করেছিলেন বলে মহাভারতের বিরাট পর্বের ষষ্ঠ্যাধ্যায়ে উল্লেখ আছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে দেবী দুর্গা মহাশক্তিরই প্রতীক। সেই মহাশক্তিকেই তারা প্রতিমার মধ্য দিয়ে চিন্ময়ী ব্রহ্মশক্তিকে দর্শন করে। তাই এই পূজা প্রতিমাকে পূজা করা নয়, প্রতিমাতে পূজা করা। যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন, চিকের আড়ালে দেবী সর্বদাই রহিয়াছেন। চিকের আড়ালে যিনি আছেন, তিনি মহাশক্তি দেবী দুর্গা। শাকম্বরী অবতারে তিনি দুর্গম নামের মহাশুরকে বধ করে দুর্গাদেবী নামে প্রসিদ্ধ হয়েছেন। আবার ভক্তদের অনুভবে ‘চিকের’ আড়ালে থাকা মহাশক্তি ভক্তদের দুর্গতি নাশ করেন, তাই তিনি দুর্গা। দুর্গাপূজা মূলত অনুষ্ঠিত হয় মার্কণ্ডেয় পুরাণের ভিত্তিতে; দেবী পুরাণ, কালিকা পুরাণ, বৃহত্ নন্দিকেশ্বর পুরাণ, দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী, দেবী ভাগবত প্রভৃতি গ্রন্থের ভিত্তিতে। এই গ্রন্থগুলো অনেক পুরানো। তার থেকে নির্বাচিত সাতশ’টি শ্লোক নিয়ে যে সংক্ষিপ্ত মার্কণ্ডেয় পুরাণ করা হয়েছিল তাকেই বলা হয় ‘দুর্গাশপ্তশতী’, কথ্য ভাষায় বলা হয় শ্রীশ্রীচণ্ডী। চণ্ডীর বর্ণনা অনুযায়ী, দুর্গম নামক অসুরকে বধ করায় মায়ের নাম হয়েছে দুর্গা। দুর্গম অসুরের কাজ ছিল জীবকে দুর্গতিতে ফেলা। দুর্গমকে বধ করে যিনি স্বর্গ বিতাড়িত দেবগণকে হৃতরাজ্য ফিরিয়ে দেন এবং জীবজগতকে দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করেন তিনি মা দুর্গা। এছাড়া মহিষমর্দিনী, শূলিনী, পার্বতী, কালিকা, ভারতী, অম্বিকা, গিরিজা, বৈষ্ণবী, কৌমারি, বাহারী, চণ্ডী, লক্ষ্মী, উমা, হৈমবতী, কমলা, শিবাণী, যোগনিদ্রা প্রভৃতি নামে ও রূপে মায়ের পূজা হয়ে থাকে। সনাতন ধর্মশাস্ত্রে ‘দুর্গা’ নামটির ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, ‘উ-কার’ বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাত্ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। আশ্বিনের শুক্লাষষ্ঠী থেকে শুক্লানবমী পর্যন্ত দেবী দুর্গার পূজা হয়ে থাকে। দেবীর সঙ্গে যুক্ত হয় আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্যাবিজ্ঞানদায়িনী দেবী সরস্বতী, সর্বৈশ্বর্য প্রদায়িনী দেবীলক্ষ্মী, সর্বসিদ্ধিদাতা গণেশ, বলরূপী কার্তিক এবং ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন ত্যাগ ও বৈরাগ্যের মূর্তবিগ্রহ দেবাদিদেব মহাদেব। এ যেন একই সঙ্গে শক্তি, জ্ঞান, ঐশ্বর্য, সিদ্ধি, বল ও বৈরাগ্যের এক অপূর্ব সমাবেশ। ষষ্ঠীতে দেবীর ষষ্ঠাদিকল্প অর্থাত্ আবাহন, বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস প্রভৃতি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। যষ্ঠীতে সন্ধ্যাকালে দেবীর বোধন হয়। শাস্ত্রমতে, দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষে বা বিল্বশাখায়। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিমায় দেবীর অর্চনা করা হয়ে থাকে। সপ্তমীতে অন্যতম অনুষ্ঠান নবপত্রিকা প্রবেশ কদলীবৃক্ষসহ আটটি উদ্ভিদ এবং জোড়াবেল একসঙ্গে বেঁধে শাড়ি পরিয়ে বধূর আকৃতির মতো তৈরি করে দেবীর পাশে স্থাপন করা হয়, প্রচলিত ভাষায় একে কলাবউ বলে। অষ্টমীতে বিশেষ অনুষ্ঠান—অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিতে আটচল্লিশ মিনিটে দেবীর বিশেষ পূজা ‘সন্ধিপূজা’। অষ্টমী তিথিতে কোনো কুমারী বালিকাকে পূজা করা হয়। নবমীতে হোমযজ্ঞের দ্বারা পূজার পুণ্যাহূতি দেয়ার রীতি। দশমী তিথিতে হয় দেবীর বিসর্জন। এই দশমী তিথি বিজয়াদশমী নামে খ্যাত। রামায়ণ থেকে জানা যায়, পিতার আদেশ পালন করার জন্য রাজা দশরথের জ্যেষ্ঠপুত্র শ্রীরামচন্দ্র স্ত্রী সীতা ও অনুগত ভাই লক্ষণকে নিয়ে পঞ্চবটী বনে যান। রাক্ষসরাজ রাবণের বোন সূর্পনখা শ্রীরামচন্দ্রের রূপে মুগ্ধ হয়ে তার ভালোবাসা চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়। সূর্পনখা শ্রীরামচন্দ্রের ক্ষতি করতে গেলে শ্রীরামচন্দ্র তার নাক-কান তীর-ধনুক দিয়ে কেটে দেন। বোনের অপমানের প্রতিশোধ নিতে দুর্মতি রাবণ ছদ্মবেশে সীতাকে চুরি করে আটকে রাখেন অশোক কাননে। শ্রীরামচন্দ্র সীতাকে উদ্ধার করার জন্য শক্তিদায়িনী দেবীদুর্গার পূজা করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রয়োজনীয় সবকিছু যোগাড় করে শ্রীরামচন্দ্র পূজা করতে বসেন। একে একে অঞ্জলি দেয়ার সময় একশ’ আটটা নীলপদ্মের জায়গায় একশ’ সাতটা নীলপদ্ম পান। আরেকটা নীলপদ্ম না পেলে পূজা থেকে যাবে অসম্পন্ন। সীতা উদ্ধারও হবে না। তাই তো নিরুপায় শ্রীরামচন্দ্র নিজের চোখ দিয়ে পূজা সম্পন্ন করতে উদ্যত হন, কেননা শ্রীরামচন্দ্রের চোখ পদ্মের মতো ছিল বলে তার আরেক নাম ছিল পদ্মলোচন। মা দুর্গা শ্রীরামচন্দ্রের ভক্তিতে খুশি হয়ে চোখ তুলতে বাধা দিয়ে আশীর্বাদ করেন। দেবীদুর্গার আশীর্বাদে শ্রীরামচন্দ্র রাক্ষসরাজ রাবণকে পরাজিত করে সীতাকে উদ্ধার করলেন। সেই থেকে শরত্কালে হয়ে আসছে দুর্গাপূজা। পৃথিবীতে শুভ-অশুভর যুদ্ধ চলছে প্রতিনিয়ত। সাধনার মহাযুদ্ধে জয়ী হতে পারলেই মানুষ মহাশক্তি দুর্গার সন্ধান পান। সাধনার দশম স্তরে উন্নীত হতে পারলেই পরমবিদ্যা মহাশক্তির নাগাল পাওয়া যায়। মানুষের এ স্তরে আসতে পারলেই অপরাজিত হন অন্তরাত্মার যুদ্ধে। এ যেন দশমীর মহাদশা যা মানুষ কখনও ভুলতে পারে না। পরাশক্তির অধিকারী অসুরকে বধ করার জন্য মা দুর্গা দশ হাতে দশ অস্ত্রে সুসজ্জিত তার দশ হাত দশ দিক রক্ষার প্রতীক। তার পায়ের নিচে আছে উদ্ধত সিংহ আর উদ্ধত অসুর। সিংহ রাজসিক আর অসুর তামসিক শক্তির প্রতীক। পশুরাজ সিংহ সাত্ত্বিক গুণাশ্রয়ী দেবীকে বহন করে। দেবী কাঠামোতে শোভা পায় দেব সেনাপতি কার্তিক যিনি শক্তির প্রতীক। সিদ্ধিদাতা গণপতি গণেশ, বিদ্যাদায়িনী সর্বশুক্লা সরস্বতী ও প্রভূত ঐশ্বর্যময়ী শ্রী দেবী লক্ষ্মী। কিন্তু সবার উপরে শোভা পান মঙ্গলের বার্তাবাহী দেবাদিদেব মহাদেব। সবাই দেবীর এক এক শক্তির প্রতীক। মূলে কিন্তু তিনি এক পরমাবিদ্যা স্বরূপিনী, যিনি সর্বভূতের প্রাণরূপী মহা দিব্য মূর্তি মা ও জগত্ মঙ্গলময়ী দুর্গা। দেবসেনাপতির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন নব পত্রিকা বা কলাবৌ। সর্বজীবের প্রাণরক্ষার উপযোগী শাকগুলোর দ্বারা পৃথিবীকে পালনকারিনী দেবীর নাম সার্থক করার মানসেই দুর্গাপূজার নবপত্রিকা রচনার বিধান রয়েছে। কারণ দেবীর আর এক নাম শাকম্ভরী। সনাতন ধর্মের পূজা অনুষ্ঠানগুলোতে এবং বিভিন্ন প্রতিমার রূপ কল্পনায় মূলশক্তি হলো আত্মশক্তি। যাকে সংস্কৃততে বলে ‘আত্মানাং বিদ্ধি’ অর্থাত্ নিজেকে জান বা আত্মাকে জান। দুর্গা সাধকের নিজের এবং বিশ্বের মূল মহাশক্তি। ঋষি বেদব্যাস পরম ব্রহ্মের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেছেন, তুমি রূপ বিবর্জিতা; আমি ধ্যানে তোমার রূপ কল্পনা করেছি। অপরূপকে রূপময়, অনির্বচনীয়কে বচনীয় এবং সর্বব্যাপীকে স্থানিক করা হয়েছে সর্বলোকের কল্যাণের জন্য। আমাদের ঋষিকবিরা মানুষের মধ্যকার সুরশক্তির ও অসুরশক্তির দ্বন্দ্বের কথা এবং পরিণামে অসুরশক্তির বিনাশ ও সুরশক্তির জয়ের কথা ধর্মগ্রন্থে রূপকে বর্ণনা করেছেন। সব দেবতার তেজরাশির সমন্বিত শক্তিরূপই মহাশক্তি দুর্গা। লেখক : সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ