বহু যুগ আগের কথা। পুরাকালের কোনও এক সময়ে মহিষাসুর নামে এক মহা পরাক্রমশালী অসুর তার অসম্ভব দাপট এবং হিংস্রতায় একে একে অধিকার করল মর্ত ও পাতাল। তার দম্ভ এবং লোভ তখন আকাশছোঁয়া। কাজেই স্বর্গ বিজয় করে সে ত্রিলোকের অধীশ্বর হতে চায়। চায় সর্বশক্তিমান ও ক্ষমতাবান হতে। মহিষাসুরের পৈশাচিক হিংস্রতা ও ক্ষিপ্রতার কাছে হার মেনে নিয়েছে প্রায় সকলেই। এমনকী দীর্ঘদিনের যুদ্ধের পর দেবতাদের পরাস্ত করে মহিষাসুর তাঁদের তাড়িয়ে দিলেন স্বর্গ থেকে। মুনি ঋষিরাও ছাড় পেলেন না সেই অত্যাচার থেকে।
বিতাড়িত দেবতারা তখন সর্ব ক্ষমতার অধীশ্বর ত্রিদেব অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের কাছে উপস্থিত হলেন। প্রজাপতি ব্রহ্মা জানালেন, কঠোর তপস্যাবলে মহিষাসুর তাঁরই কাছ থেকে বর লাভ করেছে যে ত্রিভূবনের কোনও পুরুষই তাকে পরাস্ত করতে পারবে না।
তাহলে উপায়?
মহিষাসুরের পাশবিক অত্যাচারের কাহিনি শুনে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর খুবই রেগে গেলেন। ত্রিদেবের সেই ক্রোধাগ্নির প্রচণ্ড তেজ ও দেবতাদের সম্মিলিত রোষে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে হিমালয়ের শীর্ষে ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সৃষ্টি হল এক ‘নারী’। ত্রিভুবনের দুর্গতি বিনাশ করার জন্যই তাঁর আবির্ভাব হয়েছে বলে দেবীর নামকরণ হল দুর্গা। ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে এই সৃষ্টিকার্য হয়েছিল বলে দেবী দুর্গার আর এক নাম রাখা হল ‘কাত্যায়নী’।
অমাবস্যা-পরবর্তী শুক্লপক্ষের সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে ঋষি কাত্যায়ন দেবীর আরাধনা করলেন। দেবীর পুজো এবং স্তুতি চলাকালীন সকল দেবতারা তাঁদের সমস্ত শক্তি ও অস্ত্র দেবীকে প্রদান করলেন। যেমন, হিমালয় দেবীকে দিলেন তাঁর বাহন সিংহ। ব্রহ্মা দিলেন কমণ্ডলু। দেবরাজ ইন্দ্র দিলেন বজ্র। কুবেরের গদা, বিষ্ণুর চক্র আর মহাদেবের কাছ থেকে দেবী দুর্গা পেলেন পেলেন ত্রিশুল। দেবী হলেন দশভুজা, যিনি সর্ব শক্তির অধিকারী। দেবীর রণ হুঙ্কারে ত্রিলোক কাঁপতে লাগল। সঙ্গে যুক্ত হল তাঁর বাহনের সিংহনাদ।
দেবী দুর্গা প্রবল পরাক্রমে এবং কৌশলের সঙ্গে ভয়ানক হিংস্র অসুরবাহিনীকে পরাজিত করলেন। কিন্তু বাকি রইল শুধু মহিষাসুর, এ বার তার পালা। দেবী যুদ্ধে আহ্বান করলেন মহিষাসুরকে।
শুরু হল মহিষাসুর এবং দেবী দুর্গার সমর। সে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ! দেবী ও মহিষাসুরের দৃপ্ত, উন্মত্ত পদ চালনায় স্বর্গ-মর্ত-পাতাল কাঁপতে থাকল। মহিষাসুর নানা রূপ ধারণ করে, নানা ছলে, কৌশলে দেবীকে বিব্রত ও বিমোহিত করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু দেবী ধীরে ধীরে তার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে প্রচণ্ড হুঙ্কারে ত্রিশুল দিয়ে বধ করলেন মহাপরাক্রমী মহিষাসুরকে।
প্রলয় তখন থেমে গিয়েছে। সকল দেবতারা একত্রিত হয়ে দেবী দুর্গার জয়ধ্বনি করতে লাগলেন। চতুর্দিকে পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে। দেবতারা আবার স্বর্গের অধিকার ফিরে পেলেন। পুরাণ মতে দশমীতে দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেন।
দুষ্টের দমন ও শান্তি স্থাপনে মানুষ ও দেবতারা বার বার দেবী দুর্গার শরণাপন্ন হয়েছেন। যেমন, কৃত্তিবাসী রামায়ণে পত্নী সীতাকে উদ্ধার ও রাবণ বধের জন্য ব্রহ্মা শ্রীরামচন্দ্রকে দেবী দুর্গার আরাধনার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই মতো শ্রীরামচন্দ্র করেছিলেন দেবীর অকাল বোধন। ষষ্ঠী, সপ্তমী এবং অষ্টমী তিথিতে চণ্ডীপাঠ করে রামচন্দ্র দেবীর আরাধনা করেন। কিন্তু সমস্যা হল, মহাষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিক্ষণে এসে। তখন সন্ধিপুজোর সময়, সে জন্য ১০৮টি নীল পদ্ম জোগাড় করে এনেছিলেন হনুমান। কিন্তু রামকে পরীক্ষা করার জন্য দেবী একটি পদ্ম মায়াবলে লুকিয়ে ফেললেন। সেই একটি পদ্ম না পেয়ে উদ্বিগ্ন রামচন্দ্র পুজোর আয়োজন সম্পূর্ণ করতে নিজের ‘আঁখিপদ্ম’ উৎপাটনে উদ্যত হলে দেবী দুর্গা প্রকট হলেন। রামচন্দ্রের ভক্তি ও নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী তাঁকে রাবণ বধের বর প্রদান করলেন। মহাযুদ্ধের পর মহাপরাক্রমী রাবণের বিরুদ্ধে রামচন্দ্র ও তাঁর বানরসেনা জয়লাভ করল।
দেবীর অকাল বোধনের এই ধারাকেই অনুসরণ করে বছর বছর ধরে আশ্বিন মাসে পালিত হয়ে আসছে বাঙালির অন্যতম মহোৎসব দুর্গাপুজো যা আজ দেশ-কালের গণ্ডি পেরিয়ে এখন আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে। এটি বাঙালি সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক মিলন উৎসবও বটে। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এই দুর্গাপুজোর ইতিহাস খুব প্রাচীন নয়। দুর্গাপুজোর যে রূপ আমরা দেখি তার সময়কাল খুব বেশি হলে পাঁচশো বছরের কাছাকাছি। কিন্তু এই আরাধনার ব্যাপ্তি খুব দ্রুত হয়েছে বলে এখন এই পুজো মহোৎসবে পরিণত হয়েছে।