আলোর উৎসব দীপাবলি।এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কালীপুজোরও সম্পর্ক। কিন্তু এই আলোর উত্সব শুধু হিন্দু ধর্মের একার নয়, বিশ্বের সকল ধর্ম এবং প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মধ্যেই রয়েছে আলো জ্বালিয়ে পালন করবার মতো বিভিন্ন ধর্মীয় প্রথা ও লোকাচার।
মানুষ কবে থেকে সভ্য হতে শিখেছে? গ্রিক পুরাণ বলে প্রমিথিউস যে দিন স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে নিয়ে এসেছিলেন মর্ত্যভূমিতে। অর্থাৎ আগুনের আবিষ্কার মানব জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার। আগুন জ্বালাতে না শিখলে বন-মানুষ আর কোনও দিনও মানুষ হয়ে উঠতে পারত না। তাই পৌত্তলিক, অপৌত্তলিক সব ধর্মের মধ্যেই রয়েছে আগুন ঘিরে নানা উত্সব বা অগ্নিপার্বণ।
‘তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ’ সব ধর্মেই রয়েছ এই আপ্তবাক্য। তমসা অর্থাত্ অশুভ, অমঙ্গলের প্রতীক অন্ধকার থেকে জ্যোতি বা আলোয় ফেরাই মানবজীবনের সর্বোত্কৃষ্ট সাধনা। খ্রিস্টান ধর্মে রয়েছে ‘অল সোলস্ ডে’। এই দিনে ওই ধর্মাবলম্বীরা প্রিয়জনের সমাধিতে (কবর) গিয়ে বাতি জ্বালিয়ে আসে। তারা বিশ্বাস করে যে আগুনের স্পর্শে অন্ধকারময় সমাধিস্থলের অন্যান্য অপদেবতা বা খারাপ আত্মাকে দূরে সরিয়ে দেওয়া যাবে। কবরস্থানে প্রদীপ, বাতি বা চিরাগ জ্বালাবার প্রথা মুসলমান সমাজের মধ্যেও আছে। বিশেষ করে মুসলিম সন্ত বা ফকিরদের মাজারে বাতি জ্বেলে দিতে অনেক হিন্দুকেও দেখা যায়। একই ধরণের প্রথা লক্ষ্য করা যায় জাপানের ওবোন উত্সব কিংবা চিনের য়ুয়ান জিয়াও জিউ পরবে। জাপানিরা ওবোন উত্সবে মৃত মানুষদের উদ্দেশ্যে উড়ন্ত ফানুসে আলো বেঁধে দেয়। আর চিনাদের য়ুয়ান জিয়াও বা লণ্ঠন উত্সব করে প্রয়াত প্রিয়জনেদের আত্মার শান্তি কামনায়।
দীপাবলি বা দেওয়ালীর উত্সব সারা ভারত জুড়ে প্রচলিত। নানা পুরাণ কাহিনি ও ইতিহাস থেকে বিভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া যায় এর সম্পর্কে। পুরাণ কাহিনি বলে, ক্ষীরসাগর মন্থনের পরে কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে অমৃতভাণ্ড হাতে সমুদ্র থেকে ধন্বন্তরি উঠে এসেছিলেন। সেই জন্য তিথির নাম ধন্বন্তরি ত্রয়োদশী (ধনতেরাস)। ওই দিন একই সঙ্গে স্বর্গচ্যূত দেবী লক্ষ্মীও সমুদ্র থেকে উঠে আসেন। তার পরে অমৃতের ভাগ নিয়ে দেবাসুরের লড়াইয়ের পরে, লক্ষ্মীদেবী স্বর্গে পুনরায় ফিরে যান এই কার্তিকী অমাবস্যার রাতেই। সেই ঘটনার স্মরণেই ওই অমাবস্যার রাত সাজানো হয় দীপ জ্বালিয়ে। আবার অন্য পুরাণ মতে, দেবতাদের পরাজিত করে বলিরাজা লক্ষ্মীকে নিয়ে গিয়ে পাতালে লুকিয়ে রাখেন। এই কার্তিকী অমাবস্যার রাতেই নারায়ণ বলিরাজাকে পরাজিত করে পাতাল থেকে লক্ষ্মীকে উদ্ধার করে আনেন।
রামায়ণ এবং মহাভারতেও দীপাবলির আলোকসজ্জ্বার কারণ পাওয়া যাবে। রামায়ণকথা অনুসারে, রাবণবধের পর সীতাকে উদ্ধার করে রাম যেদিন অযোধ্যায় ফিরেছিলেন, সেই দিনটা ছিল কার্তিকী-অমাবস্যা। পুরো অযোধ্যা নগরী সেদিন রাম-সীতাকে বরণ করবার জন্য আলোকসজ্জ্বায় সেজে উঠেছিল। তাই আজও ভারতবাসী রাম-সীতার ঘরে ফেরাকে স্মরণ রাখতে দীপাবলির দিন আলোকমালায় সাজিয়ে তোলে গ্রাম-শহর-নগর। মহাভারতেও পাওয়া যাবে আর একটি কারণ। নবকাসুরকে বধ করে কৃষ্ণ নবকাসুরের কারাগারে বন্দিনী ষাট হাজার গোপিনীকে উদ্ধার করেন এই কার্তিকী অমাবস্যার রাতেই। পরে তাদের সবাইকে কৃষ্ণ বিবাহও করেন। কৃষ্ণের ভক্ত-অনুগামীদের কাছে ওই গোপিনীদের মুক্তির স্মরণ উত্সবই দীপাবলী।
বঙ্গদেশে এই উত্সব কালীপুজোর সঙ্গে জুড়ে আছে। এই কালী বা কালিকা কোনও মৌলিক দেবতা নয়। আর্যরা এদেশে আসবার সময়ে যে সংস্কৃতি নিয়ে এসেছিল সেখানে কালীমূর্তির কোনও উল্লেখই ছিল না। কিন্তু এখানকার অনার্য অধিবাসীদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে সে ধারণ করে এক নতুন রূপ। ঋগ্বেদ পরবর্তী যুগে আচার-সর্বস্ব ব্রাহ্মণ্যবাদ কায়েম হওয়ার সময় থেকে ঋগ্বেদের প্রধান তিন দেবতা ইন্দ্র, মিত্রাবরুণ ও যম-এর স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন তিন অনার্য দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। এবং মাতৃরূপিনী আদ্যশক্তি মহামায়ার উপাসনার কথাও পাওয়া যাচ্ছে সেই সময় থেকেই।
আবার ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ তৈরি হওয়া বৌদ্ধধর্ম প্রাথমিকভাবে নাস্তিক-দর্শন হলেও বুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের নানা আচরণ, বিশেষ করে তন্ত্র-মন্ত্রর চর্চা এই ধর্মে প্রবেশ করেছিল প্রভূত পরিমাণে। ইতিহাসবিদদের মতে, কালীর যে অন্যন্য রূপগুলি পাওয়া যায় তা এসেছে ওই বৌদ্ধ তন্ত্র থেকে।
বঙ্গদেশ-সহ গোটা পূর্বভারত সংস্কৃতিগতভাবে চিরকালই ছিল তথাকথিত আর্যাবর্তের বাইরে। এখানকার ধর্মীয় সংস্কৃতিতে যে সমস্ত লৌকিক দেবদেবী ছিল তারাই পুজিত হয়ে এসেছে একটা দীর্ঘ সময় ধরে। আর্য সংস্কৃতির বাইরে থাকার কারণে এখানে বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তৃতি লাভ করতে পেরেছিল দ্রুত। এখানকার লৌকিক দেবী ও বৌদ্ধ তন্ত্র মিলেমিশে শক্তি-আরাধনার বিস্তৃত পট তৈরি হয়েছিল বঙ্গদেশ জুড়ে। যারই এক সংহত ও সংঘবদ্ধ রূপ কালীপুজো।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লৌকিক দেবদেবীদের একত্রিত করে দেবী কালিকার এক সুসংহত রূপ প্রদান করেছিলেন চৈতন্য সমসাময়িক শক্তি সাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। এবং সেই দেবীকেই গ্রহণ করা হল রাত্রি (অন্ধকার) ও মৃত্যুর অধিদেবতা রূপে। মৃত্যুকে জয় করবার বাসনা সব মানুষেরই। বাস্তবের খাতিরে মৃত্যুকে যদি জয় করা নাও যায়, তবু তাকে তুষ্ট রাখার জন্যই দীপ জ্বালিয়ে মৃত্যুদেবতার আরাধনাই দীপাবলী। মৃত্যুকে অতিক্রম করে অমৃতলোকে উত্তরণের শাশ্বত মনোবাসনা ‘মৃত্যুমা অমৃতগময়ঃ’।