ছবি ও লেখা: অর্ণব দত্ত
লেখকের কথা–বর্তমান প্রবন্ধটির রচনার নেপথ্য ইতিহাস আছে। এটি লিখতে আমাকে প্ররোচিত করেছিল কয়েকটি বাংলাদেশী ফোরামের কিছু প্রবন্ধ। সেসবের সারমর্ম ছিল, দুর্গাপূজা আধুনিক উৎসব; এই উৎসব কিছু ধনী জমিদারের স্বকপোল-কল্পিত ও হিন্দু ধর্মগ্রন্থে এই উৎসবের কোনো উল্লেখ নেই! সেই সব লেখার নিচে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কয়েকজনের মন্তব্য পড়ে মনে হল, এগুলি বাংলাদেশের হিন্দুবিরোধী মৌলবাদীদের এজেন্ডা হিসেবে লেখা হয়েছে। যদিও সেই সব ‘জ্ঞানগর্ভ’ নিবন্ধের বক্তব্য খণ্ডানোর জন্য তথ্য বা যুক্তি কেউই উত্থাপন করেননি (সম্ভবত তাঁরা সম্যক অবহিত ছিলেন না)। আমার এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল আমার ব্যক্তিগত ব্লগ ‘বঙ্গভারতী’ ও আমাদের বন্ধু-ব্লগ ‘কফি হাউসের আড্ডা’য়। সেদুটির কোনোটিই বাংলাদেশী ব্লগ না হওয়ায় আমি এই ইতিহাসের কথা সেখানে উল্লেখ করিনি। কিন্তু আপনাদের ব্লগের কয়েকটি পোস্ট পড়ে মনে হল, এই কথাগুলি এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। আপনাদের ব্লগে আমার প্রথম পোস্ট হিসেবে আমি আরও কিছু তথ্য দিয়ে লেখাটিকে আরও একটু পরিমার্জিত করে দিচ্ছি। ১৪১৮ বঙ্গাব্দের শারদীয়া উৎসবের প্রাক্কালে আমার বাংলাদেশী হিন্দু ভাইবোনেদের কাছে এটি আমার উপহার হিসেবে রইল। ধন্যবাদান্তে-
বাঙালির দুর্গাপূজা কবে শুরু হয়েছিল, তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। কেউ কেউ বলে থাকেন, ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অধুনা বাংলাদেশের তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ প্রথম দুর্গাপূজা প্রচলন করেন। কিন্তু ধর্মশাস্ত্র নিয়ে যাঁরা চর্চা করে থাকেন, তাঁরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন, কংসনারায়ণেরও প্রায় বারোশো বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল এবং বাংলার প্রাক-মুসলমানি ও সুলতানি যুগের স্মার্ত পণ্ডিতদের সংস্কৃত রচনা ও বাঙালি হিন্দুর ধর্মীয় সাহিত্যে প্রাচীন ও প্রাক-মধ্যযুগীয় বাংলায় দুর্গোৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য, সেসব রাজা কংসনারায়ণের বহু আগে থেকে প্রচলিত ছিল।
শারদীয়া দুর্গাপূজার একটি প্রাচীন গল্প প্রচলিত আছে হিউয়েন সাংকে নিয়ে। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কোনো এক সময়ে শরৎকালে গঙ্গাপথে চলেছিলেন এই চীনা পর্যটক। পথে পড়লেন দস্যুর কবলে। দস্যুরা তাকে দেবী দুর্গার সামনে বলি দেওয়ার জন্য ধরে নিয়ে চলল। বলির আয়োজন সারা। এমন সময় খ্যাপা শ্রাবণ ছুটে এল আশ্বিনের আঙিনায়। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল সব আয়োজন। দস্যুরা মাথা বাঁচাতে যে যেদিকে পারল দিল ছুট। সেই সুযোগে নিজেকে মুক্ত করে পালালেন হিউয়েন সাং।
এই গল্প সত্য কি মিথ্যা বলা যায় না। তবে একথা সত্যি যে দুর্গাপূজার ইতিহাস একেবারেই অর্বাচীন নয়। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি বলেছেন, ‘দুর্গাপূজা বৈদিক যজ্ঞের রূপান্তর, তন্ত্র দ্বারা সমাচ্ছন্ন।’ তাঁর মতে, বৈদিক যুগে প্রত্যেক ঋতুর প্রারম্ভে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হত। শরৎঋতুর আরম্ভেও হত। ‘এই শরৎকালীন যজ্ঞই রূপান্তরিত হইয়া দুর্গাপূজা হইয়াছে।’ তাঁর যুক্তি? তিনি বলেন, বৈদিক যজ্ঞ ও দুর্গাপূজার মধ্যে অনেক প্রভেদ রয়েছে। কিন্তু উভয়ের উদ্দেশ্য একই। বৈদিক যজ্ঞের উদ্দেশ্য, ধন-ধান্য-পুত্র, রোগমুক্তি ও শক্তিনাশের শক্তি প্রার্থনা। দুর্গার পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র বলে, ‘আয়ুরারোগ্যং বিজয়ং দেহি দেবি নমস্তুতে। রূপং দেহি যশো দেহি ভাগ্যং ভগবতি দেহি মে। পুত্রান দেহি ধনং দেহি সর্ব্বকামাংশ্চ দেহি মে।।’ (হে ভগবতী, আপনাকে প্রণাম করি, আপনি আমাকে রোগমুক্ত করুন, বিজয়ী করুন, যশ ও সৌভাগ্য প্রদান করুন, পুত্র ও ধন দিন এবং আমার সকল কামনা পূর্ণ করুন।) যোগেশচন্দ্র আরও দেখাচ্ছেন, দুর্গাপূজার মন্ত্রে ‘যজ্ঞ’ শব্দটির পরিব্যাপ্তি কতটা। বৈদিক হিন্দুধর্ম ছিল যজ্ঞসর্বস্ব। দুর্গাপূজাতেও দেখি, দেবীকে যজ্ঞভাগ গ্রহণে আহ্বান জানানো হচ্ছে (‘দেবি যজ্ঞভাগান্ গৃহাণ’) এবং পশুবলি দেওয়ার সময় বলা হচ্ছে, যজ্ঞের নিমিত্তই পশুর সৃষ্টি (‘যজ্ঞার্থে পশবঃ সৃষ্টাঃ তস্মিন্ যজ্ঞে বধোঽবধঃ’)। যোগেশচন্দ্রের তাই অনুমান, বৈদিক শারদ যজ্ঞই তন্ত্রের প্রভাবে পর্যবসিত হয়েছে আধুনিক দুর্গোৎসবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বললে, ‘হৃদয়ে ছিলে জেগে, দেখি তাই শরৎমেঘে’।
বাংলায় যে দুর্গাপূজা প্রচলিত, তা মূলত মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা। মহিষাসুরমর্দিনীর পূজার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এ (রচনাকাল আনুমানিক অষ্টম শতাব্দী)। এছাড়া দুর্গাপূজার কথা পাওয়া যায় মার্কণ্ডেয় পুরাণ (মূল পুরাণটি চতুর্থ শতাব্দীর রচনা, তবে দুর্গাপূজার বিবরণ-সম্বলিত সপ্তশতী চণ্ডী অংশটি সামান্য পরে সংযোজিত হয়), বৃহন্নন্দীকেশ্বর পুরাণ (সঠিক রচনাকাল অজ্ঞাত), কালিকা পুরাণ (রচনাকাল ৯ম-১০ম শতাব্দী) ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ-এ (রচনাকাল ১২শ শতাব্দী)। ৯ম-১২শ শতাব্দীর মধ্যকার সময়ে নির্মিত একাধিক মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি বাংলার নানা স্থান থেকে আবিষ্কৃতও হয়েছে। এর মধ্যে মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এ পাওয়া যায়, রাজা সুরথ দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, মৃন্ময়ী প্রতিমা অর্থাৎ মাটির প্রতিমায় দেবপূজা বাংলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। বাংলার বাইরে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে মাটির প্রতিমায় পূজা একেবারে হাল-আমলে বাংলার দেখাদেখি শুরু হয়েছে। তাছাড়া, উপরে যে পুরাণগুলির নামোল্লেখ করা হল, সে সবই হয় বৃহত্তর বাংলা নয় কামরূপের (একালের অসমের) স্মার্ত পণ্ডিতদের লেখা। সুতরাং যোগেশচন্দ্রের মত ও পুরাণগুলির রচনাকাল বিচার করলে বলতে হবে, ইসলামের আবির্ভাবের বহু আগেই বঙ্গদেশে দুর্গাপূজা প্রচলন লাভ করেছিল।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, হিন্দুদের পূজাপার্বণ ইত্যাদি ধর্মানুষ্ঠান ‘শ্রুতি’ অর্থাৎ বেদের অন্তর্গত নয়, তা ‘স্মৃতি’ অর্থাৎ পুরাণাদি শাস্ত্রের অন্তর্গত; ‘স্মৃতি’ শাস্ত্রের বিধান বেদের মতো অপরিবর্তনীয় নয় এবং সেই কারণেই যুগে যুগে আচার্যগণ তা পরিমার্জিত করে দেশকালের উপযোগী করে তোলেন। (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, পঞ্চম খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৭) নিঃসন্দেহে দুর্গাপূজার প্রাচীন বিধানগুলিতেও পরবর্তীকালের স্মার্ত পণ্ডিতগণ কিছু কিছু পরিবর্তন এনেছিলেন। খ্রিস্টীয় একাদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যে দুর্গাপূজা এই জাতীয় বিবর্তনের মধ্যে ছিল। প্রাচীন স্মৃতিশাস্ত্র ও লোকাচার-দেশাচারের মিলন ঘটানোর জন্য এই চারশো বছরে দুর্গাপূজার কয়েকটি বিশেষ ‘ম্যানুয়েল’ রচিত হয়। এ থেকেই প্রমাণিত হয়, সেযুগে লৌকিক ও পৌরাণিক হিন্দুধর্মের একটি মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল দুর্গাপূজার প্রাঙ্গন। এই বিশেষ ‘ম্যানুয়েল’গুলি কী কী? পূর্ববঙ্গের রাজা হরিবর্মা দেবের সভাপণ্ডিত ভবদেব ভট্ট একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে রচনা করেন ‘কর্মানুষ্ঠান পদ্ধতি’–এই গ্রন্থে মাটির প্রতিমায় দুর্গাপূজার বিধিব্যবস্থা করা হয়েছিল। অর্থাৎ, আজ থেকে নশো বছর আগে বাংলায় মাটির প্রতিমায় দুর্গাপূজার উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। উল্লেখ্য, ভবদেব ভট্ট স্বকল্পিত বিধান দেননি, তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন, দুর্গাপূজার যাবতীয় বিধান তিনি তাঁর পূর্ববর্তী স্মৃতিকার জীকন, বালক ও শ্রীকরের গ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করেছেন।
দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বাঙালি পণ্ডিত শূলপাণি রচনা করেছিলেন ‘দুর্গোৎসব বিবেক’, ‘বাসন্তী বিবেক’ ও ‘দুর্গোৎসব প্রয়োগ’ নামে তিনটি প্রবন্ধ। তিনিও তাঁর নিবন্ধের বিধানগুলি সংগ্রহ করেছিলেন পূর্ববর্তীকালের স্মার্ত পণ্ডিত জীকন ও বালকের রচনা থেকে। শূলপাণির সমসাময়িক জীমূতবাহন রচনা করেছিলেন ‘দুর্গোৎসব নির্ণয়’–এই গ্রন্থেও মাটির প্রতিমায় দুর্গাপূজার বিধান ছিল। এছাড়াও, দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে রচিত সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত কাব্যে বলা হয়েছে, বরেন্দ্রভূমিতে (উত্তরবঙ্গে) মহাসমারোহে উমাপূজা (দুর্গাপূজা) হত। এই সব বই পড়ে মনে হয়, সেকালে শুধু মাটির প্রতিমাতেই দুর্গাপূজা হত না, কাঠ, ধাতু বা পাথরের প্রতিমাতেও হত। পশ্চিমবঙ্গের অনেক জায়গায় এখনও মাটির বদলে কাঠ, ধাতু বা পাথরের প্রতিমায় দুর্গাপূজা হয়ে থাকে। বৌদ্ধ পালরাজাদের রাজত্বকালের শেষভাগেই বাংলায় দুর্গাপূজা উৎসবে পরিণত হয়। সেন রাজত্বে তা আরও ব্যাপকতা লাভ করে।
মৈথিলী কবি বিদ্যাপতি (১৩৭৫-১৪৫০) রচনা করেন দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাপতির পদাবলি সম্পর্কে বলেছিলেন, বাঙালি তাঁর পাগড়ি খুলে নিয়ে তাঁকে ধুতি-চাদর পরিয়ে দিয়েছে। কথাটি তাঁর দুর্গাপূজা-বিধানের ক্ষেত্রেও সত্য। আজও বাংলার অনেক প্রাচীন পরিবারে দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী মতে দুর্গাপূজা হয়। তবে দুর্গাপূজা-বিধানগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নবদ্বীপের স্মার্ত পণ্ডিত রঘুনন্দনের (১৫০০-১৫৭৫) তিথিতত্ত্ব গ্রন্থের ‘দুর্গোৎসবতত্ত্ব’ প্রবন্ধ ও দুর্গাপূজাতত্ত্ব গ্রন্থ। পঞ্চদশ শতাব্দীর মানুষ কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ অনুবাদে উল্লিখিত দুর্গোৎসবের কথা সকলে জানে। এই বিবরণ মূল বাল্মীকি রামায়ণে নেই। কৃত্তিবাস তা সংগ্রহ করেছিলেন দেবীভাগবত ও কালিকা পুরাণ থেকে। কিন্তু রামচন্দ্রের জীবনবৃত্তান্ত লিখতে গিয়ে বৈষ্ণব কবি কেন তাকালেন দুই শাক্ত পুরাণের দিকে? উত্তর পাওয়া যাবে, কৃত্তিবাসী রামায়ণের একটি প্রবণতার মধ্যে–রামায়ণের চরিত্রদের বেশভূষায়, খাদ্যাভ্যাসে, স্বভাবে কৃত্তিবাস করে তুলেছিলেন বাঙালি। তাই হয়ত রঘুবীরকে দিয়ে তাঁর ‘নয়ন-ভুলানো’কে ডাকিয়েছিলেন। বৃন্দাবন দাস তাঁর চৈতন্যভাগবত (রচনাকাল ১৫৩৮-৫০) গ্রন্থে লিখেছেন,
মৃদঙ্গ মন্দিরা শঙ্খ আছে সব ঘরে। দুর্গোৎসব কালে বাদ্য বাজাবার তরে।।
অর্থাৎ, দুর্গাপূজা একাদশ শতাব্দী থেকেই ছিল ‘উৎসব’। ষোড়শ শতাব্দীতে ঘরে ঘরে তা আয়োজিত হত। চৈতন্যপার্ষদ নিত্যানন্দ প্রভুও (১৪৭৪-১৫৩২) অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার খড়দহে স্বগৃহে প্রতিমায় দুর্গোৎসব করতেন। তাঁর বংশধরেরা আজও বেঁচে আছেন এবং তাঁরাও সেই দুর্গোৎসবের ধারা বজায় রেখেছেন। মনে রাখা দরকার, দুর্গাপূজা সাধারণত জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হলেও, দুর্গাপূজার প্রাচীন বিধানগুলিতে সাধারণ পঞ্চোপচারে এবং তার অভাবে শুধুমাত্র গঙ্গাজলে দুর্গাপূজারও বিধান পাওয়া যায়। দার্জিলিং জেলার একটি বৌদ্ধ পরিবারে এমন এক সরল দুর্গাপূজা দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম আমি নিজে।
কংসনারায়ণের ঠাকুরদা উদয়নারায়ণ প্রথম দুর্গাপূজার বাসনা প্রকাশ করেছিলেন ১৫৮০ সালে। কিন্তু নানা কারণে তিনি নিজে তা আয়োজন করতে পারেননি। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগে তা করেছিলেন কংসনারায়ণ। সুতরাং দেখাই যাচ্ছে, কংসনারায়ণ বাংলায় দুর্গাপূজার প্রচলন করেননি। তবে কংসনারায়ণ দুর্গাপূজার প্রবর্তক–এহেন মিথের (আমি যাকে বলি ‘কংসনারায়ণী মিথ’) উৎপত্তি কীভাবে ঘটল। আমার ধারণা, যে জাঁকজমকের সঙ্গে কংসনারায়ণ দুর্গাপূজা করেছিলেন (সেযুগের বাজারে তিনি খরচ করেছিলেন ৮ লক্ষ টাকা), তা ছিল আক্ষরিক অর্থেই অভূতপূর্ব। তাঁকে অনুসরণ করেছিলেন বাংলার অন্যান্য ভূস্বামীরা। সেই থেকেই পুরাণের রামচন্দ্র-সুরথ এবং ইতিহাসের ভবদেব ভট্ট-শূলপাণি-বিদ্যাপতি-রঘুনন্দনকে ছাপিয়ে তিনিই হয়ে গিয়েছিলেন দুর্গাপূজার তথাকথিত ‘প্রবর্তক’। যে স্মার্ত পণ্ডিত কংসনারায়ণকে দুর্গাপূজার বিধান দিয়েছিলেন, সেই রমেশ শাস্ত্রীর এক উত্তরপুরুষ রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য আমার মামাবাড়ির পাড়াসম্পর্কে ‘মামা’। এই নিবন্ধের পূর্বতন সংস্করণটি পড়ে তিনিও আমার মতটিকে সমর্থন জানান। কিন্তু তিনি এও বলেন, রমেশ শাস্ত্রী মহাশয় কংসনারায়ণকে দুর্গাপূজার কয়েকটি বিশেষ বিধানও দিয়েছিলেন, সেগুলি পূর্বের দুর্গাপূজায় পালিত হত না। কিন্তু কংসনারায়ণের পর থেকে সেই রীতিনীতিগুলি দুর্গাপূজার অবিচ্চেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়। সম্ভবত ‘কংসনারায়ণী মিথ’-এর উদ্ভবের এও একটি কারণ হতে পারে।
শেষ পাতে শোনাবো, বৃহত্তর বাংলার সেই প্রাচীনতম দুর্গাপূজাটির গল্প, যেটি আজও টিকে রয়েছে। এই পূজা পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার মল্ল রাজবাড়ির পূজা। ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মামুদ যখন ভারতের পশ্চিমপ্রান্তে মন্দিরধ্বংস করে লুটপাট করছিলেন, সেই সময় ভারতের পূর্বপ্রান্তে মল্লরাজ জগৎমল্ল বনবিষ্ণুপুরে (অধুনা বিষ্ণুপুর) তাঁদের কুলদেবী মৃন্ময়ীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দুর্গাপূজা শুরু করেন। মল্ল রাজাদের যুগের অবসান ঘটার পর এখন এই পূজার দায়িত্ব পালন করে বিষ্ণুপুর পুরসভা। পশ্চিমবঙ্গে এই পূজাটিকে এখন প্রাচীনতম দুর্গাপূজার মর্যাদা দেওয়া হয়।
কারো কারো ধারণা, জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গন থেকেই দুর্গাপূজা হয়েছে বাঙালির জাতীয় উৎসব। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। বৈদিক শারদ যজ্ঞ ছিল সর্বজনীন এক ধর্মানুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানই যুগে যুগে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিক চার-দিনের দুর্গোৎসবে পরিণত হয়েছে। স্মার্ত পণ্ডিতদের লেখা থেকে দুর্গাপূজার যে সুপ্রাচীন দেশাচার ও লোকাচারের কথা জানা যায়, তাই প্রমাণ করে এই উৎসব আদতে ছিল বাঙালির মাটির উৎস। শাক্ত কবির আগমনী-বিজয়ায় যে মাটির সুর বাজে, তাতে জমিদারগৃহের বাইজি নাচের নূপুরধ্বনি শোনা যায় না, শোনা যায় মাথার উপর খড়ের চাল বয়ে চলা বঙ্গজীবনের প্রাণের আশা-আকাঙ্খার কথা। এই সুর আবহমান। ইসলামের আবির্ভাবের বহু আগে সুপ্রাচীন বৈদিক কাল থেকে আজকের এই যন্ত্রসভ্যতার যুগে এই সুরটি ঠিক একই তানে বেজে আসছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়–
শরতে আজ কোন্ অতিথি এল প্রাণের দ্বারে। আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে।।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার–
১। পূজা-পার্বণ, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা।
২। Durga Puja: Yesterday, Today & Tomorrow, Sudeshna Banerjee, Rupa & Co.,New Delhi.
৩। মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা, দেব সাহিত্য কুটির সম্পাদনা, দেব সাহিত্য কুটির, কলকাতা।
৪। পূজাবিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা।
৫। হিন্দুদের দেবদেবী: উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ, তৃতীয় খণ্ড, হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, ফার্মা কেএলএম প্রাঃ লিঃ, কলকাতা।
৫। সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস, ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা।
|