মূল রচনা: ডব্লিউ. জে. উইলকিনস (হিন্দু মিথোলজি: বৈদিক অ্যান্ড পৌরাণিক থেকে)
অনুবাদ: অর্ণব দত্ত
শিবজায়া এইবারে সম্পূর্ণ নতুন একটি রূপ ধারণ করলেন–এমন রূপ তিনি আগে
কখনও ধরেননি। আগেও তিনি ছিলেন শিবের পত্নী; তবে তিনি আচরণ করতেন সাধারণ
নারীর মতো; বলা যায়, তিনি ছিলেন নারীসুলভ গুণাবলির মূর্ত প্রতীক। দুর্গা
রূপে তিনি হলেন এক সর্বশক্তিময়ী বীরাঙ্গনা। দেবতা ও মানুষের ত্রাস
অসুরদের নির্মূল করতে পৃথিবীতে তিনি আবির্ভূতা হলেন নানা নামে।
দুর্গ নামে এক অসুরকে বধ করে দেবী দুর্গা নামে পরিচিতা হয়েছিলেন।
”স্কন্দপুরাণ”-এ এই ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। ঋষি অগ্যস্ত একবার
কার্তিকেয়কে জিজ্ঞাসা করলেন যে, তাঁর মায়ের নাম দুর্গা কেন? কার্তিকেয়
বললেন, "রুরু দৈত্যের পুত্র ছিল দুর্গ। ব্রহ্মার বরলাভের আশায় সে একবার
কঠোর তপস্যা করেছিল। তারপর ব্রহ্মার পর পেয়ে সে হয়ে উঠেছিল দুর্জেয়।
ত্রিভুবন জয় করে সে ইন্দ্রকে করল সিংহাসনচ্যুত। মুনিঋষিদের বাধ্য করতে
লাগল তার জয় গাইতে। দেবতাদের সে পাঠিয়ে দিল বনে; শুধু তাই নয়, তাঁদের
করে রাখল নিজের আজ্ঞাবহ। ধর্মানুষ্ঠান যা ছিল, সে সব সে নিষিদ্ধ করে দিল।
তার ভয়ে ব্রাহ্মণরা বেদপাঠ ছেড়ে দিল; নদীর গতিপথ গেল ঘুরে; আগুন হারাল
তার তেজ; সন্ত্রস্ত নক্ষত্ররাজি করল আত্মগোপন। দুর্গ মেঘের রূপ ধারণ করে
যেখানে খুশি সেখানে বৃষ্টিপাত ঘটাতে লাগল। ভয় পেয়ে পৃথিবী মাত্রাতিরিক্ত
শস্য উৎপাদন করতে লাগলেন; ঋতুচক্রের তোয়াক্কা না করেই গাছে ফুটতে লাগল
ফলফুল।”
দুঃখী দেবগণ এলেন শিবের কাছে। দেবরাজ ইন্দ্র বললেন, "সে আমাকে
সিংহাসনচ্যুত করেছে!” সূর্য বললেন, "সে আমার রাজ্য কেড়ে নিয়েছে!” শিবের
দয়া হল। তিনি পার্বতীকে অনুরোধ করলেন গিয়ে দৈত্যটিকে বধ করে আসতে।
পার্বতী সানন্দে রাজি হলেন। তিনি দেবতাদের শান্ত করে প্রথমে কালরাত্রিকে
পাঠালেন। কালরাত্রি তাঁর রূপে ত্রিভুবনকে করলেন মোহিত; দৈত্যদের আদেশ
করলেন পৃথিবীর পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে দিতে। দুর্গ শুনে উঠল ক্ষেপে;
কালরাত্রিকে ধরার জন্য পাঠাল সেনা। কিন্তু দেবী এক নিঃশ্বাসে তাদের ভষ্ম
করে দিলেন। দুর্গ তখন ৩০,০০০ দৈত্য পাঠাল। এই দৈত্যরা আকারে এতই বড়ো ছিল
যে পৃথিবীতল শুধু দৈত্যদেহেই ঢাকা পড়ে গেল। দৈত্যদের দেখে কালরাত্রি
দুর্গার কাছে পালিয়ে এলেন। দুর্গ তখন ১০০,০০০,০০০ রথ, ১২০,০০০,০০০,০০০
হাতি, ১০,০০০,০০০ দ্রুতগামী ঘোড়া ও অসংখ্য সৈন্য নিয়ে চলল বিন্ধ্যপর্বতে
পার্বতীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে। তাকে দেখেই পার্বতী সহস্রভুজা মূর্তি ধারণ
করলেন। উপদেবতাদের নিয়ে গঠন করলেন নিজের বাহিনী। নিজের শরীর থেকে বহু
অস্ত্র সৃষ্টি করলেন (পুরাণে সেসবের একটি দীর্ঘ তালিকা রয়েছে)। পার্বতী
বিন্ধ্যপর্বতে উপবেশন করতেই দৈত্যরা তাঁকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়তে লাগল।
দৈত্যদের ছোঁড়া তীর ঝোড়ো বৃষ্টির ধারার মতো দেবীর দিকে ছুটে এল। শুধু
তাই নয়, গাছ, পাথর যা কিছু পেল সবই উপড়ে দেবীর দিকে ছুঁড়ে দিল দৈত্যের
দল। প্রত্যুত্তরে দেবী একটিমাত্র অস্ত্র ছুঁড়ে তাদের ছোঁড়া সবকিছু
হটিয়ে দিলেন। দুর্গ তখন নিজে একটা আগুনের গোলা ছুঁড়ে দিল দেবীর দিকে।
দেবী সেটি দূরে সরিয়ে দিলেন। তখন দুর্গ ছুঁড়ল আরও একটি আগুনের গোলা।
দেবী একশো তীর ছুঁড়ে থামিয়ে দিলেন সেটি। দুর্গ তখন দেবীর বক্ষদেশ লক্ষ্য
করে তীর ছুঁড়ল। দেবী সেটিও থামিয়ে দিলেন। তারপর থামিয়ে দিলেন দুর্গের
ছোঁড়া গদা আর শূলও। তারপর দেবী ও দৈত্য পরস্পরের কাছাকাছি এসে পড়লেন।
পার্বতী দুর্গকে ধরে তার বুকে নিজের বাঁ পা-টি চাপিয়ে দিলেন। তবে দুর্গ
কোনো ক্রমে নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হল। তারপর নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়ল
যুদ্ধে।
পার্বতী তখন নিজের দেহ থেকে একাধিক দেবীর সৃষ্টি করলেন। তাঁরা সব
অসুরসৈন্যদের বধ করতে লাগলেন। দেখে দুর্গ পার্বতীর উপর ভয়ানক শিলাবৃষ্টি
ঘটাতে গেল। কিন্তু দেবী এক অস্ত্রে সেই শিলাবৃষ্টি দিলেন আটকে। অসুর তখন
পর্বত-প্রমাণ এক হাতির রূপ ধরে দেবীকে আক্রমণ করল। দেবী তার পাগুলি বেঁধে
ফেলে তাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেললেন নিজের নখের আঘাতেই। দুর্গ আবার উঠে
দাঁড়াল। একটা মহিষের রূপ ধরে ছুটে এল দেবীর দিকে; শিং দিয়ে উপড়ে ফেলল
পাহাড়, ক্রুদ্ধনিঃশ্বাসে উড়িয়ে দিল গাছ। দেবী তাকে নিজের ত্রিশূলের
আঘাতে টুকরো টুকরো করে দিলেন। সে তখন মহিষের রূপ ত্যাগ করে স্বমূর্তি
ধরল–হাজার হাতে হাজার অস্ত্র ধরে দৈত্যবেশে আক্রমণ করল দেবীকে। পার্বতীর
কাছে আসতেই পার্বতী তাকে তুলে আছড়ে ফেললেন মাটিতে। তাতেও সে মরল না দেখে,
তীর মেরে তার বক্ষ বিদীর্ণ করে দিলেন। নদীর ধারার মতো দুর্গর মুখ থেকে
রক্ত উঠে এল। সে মরল। দেবতাদের তা দেখে হলেন মহাআনন্দিত। অবশেষে তাঁরা
ফিরে পেলেন তাঁর হৃতগৌরব।
"মার্কণ্ডেয় পুরাণ”-এর অংশ চণ্ডীতে দুর্গার উৎপত্তি সংক্রান্ত অন্য
একটি গল্প পাওয়া যায়। অসুরদের রাজা মহিষাসুর এক যুদ্ধে দেবতাদের পরাজিত
করেছিলেন। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাঁদের এমন অবস্থা হয়েছিল যে, তাঁরা পথে
পথে ভিখারির বেশে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছিলেন। শেষে ইন্দ্র তাঁদের নিয়ে
গেলেন ব্রহ্মার কাছে। ব্রহ্মা আবার তাঁদের নিয়ে গেলেন শিবের কাছে। কিন্তু
তিনিও দেবতাদের কোনো সুরাহা করতে পারলেন না। তখন তাঁরা সবাই মিলে গেলেন
বিষ্ণুর কাছে। দেবতাদের অবস্থা দেখে বিষ্ণুর দয়া হল। তাঁর মুখমণ্ডল থেকে
নির্গত হল জ্যোতি। সেই জ্যোতি মহামায়ার রূপ নিল। এই মহামায়াই দুর্গা।
বিষ্ণুর মুখমণ্ডলের জ্যোতির সঙ্গে এসে মিশল অন্য সব দেবতাদের জ্যোতি।
দেখতে দেখতে মহামায়া এক পর্বতপ্রমাণ অগ্নিকুণ্ডের মতো জ্যোতির্ময়ী রূপ
ধারণ করলেন। দেবতারা তাঁকে নিজ নিজ অস্ত্রে করলেন সজ্জিতা। দেবী প্রচণ্ড
হুঙ্কার দিয়ে আকাশে উঠে গেলেন। তারপর দানববধ করে দেবতাদের হৃতরাজ্য
ফিরিয়ে দিলেন।
"বরাহ পুরাণ”-এ এই গল্পের যে পাঠান্তরটি পাওয়া যায়, তা একটু অন্যরকম।
এই পুরাণ মতে, দেবতারা পরিত্রাণের আশায় এলেন বিষ্ণুর কাছে। বিষ্ণু নিজে
এবং তাঁর আদেশে শঙ্কর, ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবতারা তাঁদের চোখ থেকে এক
পর্বতপ্রমাণ জ্যোতি নির্গত করলেন। এই জ্যোতি সহস্রসূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল
ত্রিনয়নী কৃষ্ণকেশী অষ্টাদশভুজা কাত্যায়নী দেবীর রূপ ধারণ করল। শিব
তাঁকে দিলেন নিজের ত্রিশূল, বিষ্ণু দিলেন চক্র, বরুণ দিলেন শঙ্খ, অগ্নি
দিলেন শূল, বায়ু দিলেন ধনুক, সূর্য দিলেন তীর-ভরা তূণীর, ইন্দ্র দিলেন
বজ্র, কুবের দিলেন গদা, ব্রহ্মা দিলেন অক্ষমালা ও কমণ্ডলু, যম দিলেন খড়্গ
ও ঢাল, বিশ্বকুর্মা দিলেন কুঠার এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র। দেবতাদের
অস্ত্রে সুসজ্জিতা দেবী কাত্যায়নী গেলেন বিন্ধ্যপর্বতে। সেখানে চণ্ড ও
মুণ্ড অসুরদ্বয় তাঁকে দেখতে পেলেন। দেবীর রূপ দেখে বিমোহিত অসুরদ্বয় সেই
রূপের বর্ণনা দিল তাদের রাজা মহিষাসুরের কাছে। শুনে মহিষাসুর দেবীকে বিয়ে
করার জন্য পাগল হয়ে উঠল। কিন্তু দুর্গা বললেন, তাঁকে বিবাহ করতে হলে আগে
তাঁকে যুদ্ধে পরাজিত করতে হবে। সেই কথা শুনে মহিষাসুর এল দেবীর সঙ্গে
যুদ্ধ করতে। দেবী তাঁর বাহন সিংহের পিঠ থেকে নেমে উঠে বসলেন মহিষাসুরের
পিঠে। মহিষাসুর মহিষের রূপ ধারণ করেছিল। দেবীর কোমল পদের ভারেই সে মুখ
থুবড়ে মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। দেবী তখন নিজের খড়্গ দিয়ে তার
মাথাটি কেটে নিলেন।
দুর্গার ছবি ও মূর্তিতে যে রূপটি সচরাচর দেখা যায়, সেটি কনকবর্ণা,
পরমারূপবতী এক যুবতীর রূপ। তিনি দশভুজা; এক হাতে শূল ধরে তা দিয়ে
মহিষাসুরকে বিদীর্ণ করছেন; বাঁ হাতে ধরে আছেন একটি সাপ, আরেক হাতে ধরে
আছেন অসুরের চুল, সাপটি অসুরের বক্ষ দংশন করছে; অন্যান্য হাতে নানাবিধ
অস্ত্রশস্ত্র। তাঁর ডান পা সিংহের পিঠে, বাঁ পা অসুরের উপর। দুর্গার সঙ্গে
লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশও পূজিত হন। মূর্তির পিছনের চালচিত্রে
দুর্গা ও অন্যান্য দেবদেবীদের ছবি আঁকা থাকে। এই চালচিত্র-সহ
দুর্গাপ্রতিমা বাংলায় প্রতি বছর শারদীয় মহোৎসবের সময় পূজিত হয়।
বাংলায় দুর্গাপূজা হিন্দু উৎসবগুলির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। তিন-দিন
ব্যাপী এই উৎসব বছরের প্রধান ছুটির মরসুম। ইংল্যান্ডের বড়োদিনের মতো
বাংলায় দুর্গাপূজায় কর্মসূত্রে প্রবাসীরা বাড়ি ফিরে আসেন। জাঁকজমক করে
মহাধুমধামের সঙ্গে পালিত হয় দুর্গোৎসব। পূজা উপলক্ষ্যে মহিষ ও ছাগল বলি
দেওয়া হয়। অনেক রাত পর্যন্ত চলে ভোজসভা ও নাচগানের আসর। অধিকাংশ লোকে
শরৎকালে দুর্গাপূজা করলেও, বসন্তকালেও কেউ কেউ দুর্গাপূজা করে থাকেন।
বাংলায় একটি প্রচলিত গল্পে দেবীর এই দুই ঋতুতে পূজার ব্যাখ্যা রয়েছে:—
শরৎকালে দুর্গাপূজা অধিক জনপ্রিয় হলেও, অনেকে বসন্তকালেও দুর্গাপূজা
করেন। দুর্গাপূজা আদিতে ছিল বসন্তকালের উৎসব। পরে কিভাবে শরৎকালে
দুর্গাপূজা শুরু হল, সেই সম্পর্কে একটি গল্প বাংলার লোকসমাজে
প্রচলিত:—দুর্গাভক্ত রাবণ নিত্য চণ্ডীপাঠ করতেন। তাই রাম-রাবণের যুদ্ধে
দুর্গা প্রথমে রাবণের পক্ষ নিলেন। তখন শরৎকাল। দুর্গার সাহায্য ছাড়া
রাবণবধ অসম্ভব বুঝে রামচন্দ্র শরৎকালেই দুর্গাপূজা করলেন। রামের ভক্তিতে
তুষ্ট হয়ে দুর্গা রাবণের সঙ্গ ত্যাগ করে রাবণবধে রামকেই সাহায্য করলেন।
দশভুজা
"মার্কণ্ডেয় পুরাণ”-এর বর্ণনা অনুযায়ী, শুম্ভ-নিশুম্ভ দৈত্যবধের সময়
দুর্গা দশটি পৃথক পৃথক রূপ ধারণ করেছিলেন:— (১) ‘দুর্গা’ রূপে তিনি
দৈত্যদের বার্তা প্রেরণ করেন; (২) ‘দশভুজা’ রূপে দৈত্যসেনাদের একাংশ নষ্ট
করেন; (৩) ‘সিংহবাহিনী’ রূপে রক্তবীজ অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করেন; (৪)
‘মহিষমর্দিনী’ রূপে তিনি মহিষরূপী শুম্ভকে বধ করেন; (৫) ‘জগদ্ধাত্রী’ রূপে
দৈত্যসেনাদের পরাজিত করেন; (৬) ‘কালী’ রূপে রক্তবীজকে বধ করেন; (৭)
‘মুক্তকেশী’ রূপে দৈত্যদের অপর একটি বাহিনীকে পরাজিত করেন; (৮) ‘তারা’
রূপে শুম্ভকে তার নিজের রূপে বধ করেন; (৯) ‘ছিন্নমস্তকা’ রূপে নিশুম্ভকে
বধ করেন; এবং (১০) ‘জগৎগৌরী’ রূপে দেবতারা তাঁকে স্তব করে ধন্যবাদ জানান।
অসুরদের বিরুদ্ধে দেবী দুর্গার এই সফল সংগ্রামের বিস্তারিত বর্ণনাও
পাওয়া যায় "মার্কণ্ডেয় পুরাণ”-এ। ত্রেতা যুগের শেষ ভাগে শুম্ভ ও
নিকুম্ভ নামে দুই অসুর ১০,০০০ বছর কঠোর তপস্যা করেছিল। তাদের তপস্যায়
তুষ্ট হয়ে শিব এলেন তাদের বর দিতে। অসুরদ্বয় বর চাইল অমরত্বের। কিন্তু
সেই বর দিতে শিব নারাজ। তিনি অন্য কোনো বর চাইতে বললেন অসুরদের; কিন্তু
অসুরদের অমরত্বের বরই চাই। তারা তখন এক হাজার বছর ধরে আরো কঠোর তপস্যা
করল। আবারও শিব এলেন তাদের বর দিতে; এবারও তারা চাইল অমরত্বের বর আর এবারও
শিব তাদের সেই বর দিতে করলেন অস্বীকার। তখন তারা ৮০০ বছর ধরে জ্বলন্ত
অগ্নিকুণ্ডের উপর উলটো অবস্থায় ঝুলে তপস্যা করল। তাদের কঠোর তপস্যা দেখে
দেবতারা ভয় পেয়ে গেলেন। দেবরাজ ইন্দ্র ডাকলেন সভা। অসুরদের তপস্যা
দেবতাদের পক্ষে যে বিপজ্জনক, তা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে নিলেন এবং এই
বিপদ থেকে উদ্ধারের রাস্তা খুঁজতে লাগলেন।
ইন্দ্রের পরামর্শে প্রেমের দেবতা কন্দর্প রম্ভা ও তিলোত্তমা নামে দুই
পরমাসুন্দরী অপ্সরাকে নিয়ে চললেন অসুরদ্বয়ের তপস্যা ভঙ্গ করতে। কন্দর্প
তাঁর পুষ্পবানে তাদের ধ্যান দিলেন ভাঙিয়ে। চোখ খুলেই তারা দেখল দুই
সুন্দরী নারীকে। তখন তপস্যা ভুলে তাদের সঙ্গেই ৫০০০ বছর সহবাস করলেন। শেষে
তাদের খেয়াল হল যে, দুই তুচ্ছ নারীর জন্য তারা অমরত্ব অর্জনের তপস্যা
ছেড়ে এসেছে। তখন পুষ্পবানের কবল থেকে নিজেদের মুক্ত করে অপ্সরাদের
খেদিয়ে দিয়ে তারা আবার গেল তপস্যা করতে। এবার নিজেদের হাড়-মাংস কেটে
কেটে যজ্ঞের আগুনে আহুতি দিয়ে করল তপস্যা। ১০০০ বছর এভাবে তপস্যা করার পর
তাদের শরীর হয়ে গেল অস্তিচর্মসার। শিব তখন পুনরায় আবির্ভূত হয়ে তাদের
বর দিলেন—শক্তি ও ঐশ্বর্যে তারা দেবতাদের পদানত করতে পারবে।
"দেবতাদের জয় করার ক্ষমতা পেয়েই শুম্ভ-নিশুম্ভ দেবতাদের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ ঘোষণা করে দিল। এই যুদ্ধে করল জয়লাভ অসুররা আর দেবতাদের অবস্থা হল
সবচেয়ে করুণ। তাঁরা ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর সাহায্য চাইতে গেলেন।
ব্রহ্মা-বিষ্ণু এই ব্যাপারে নিজেদের অক্ষমতার কথা জানিয়ে দেবতাদের
পাঠিয়ে দিলেন শিবের কাছে। শিব বলে দিলেন, তাঁর বরেই অসুরদ্বয় অজেয়, তাই
তিনি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবেন না; দেবতারা বরং দুর্গাপূজা করুন। দেবতারা
দুর্গাপূজা করলেন। দেবী দুর্গা সেই সময় কাঁখে কলস নিয়ে জল আনতে
চলেছিলেন। তিনি দেখলেন, দেবতারা তাঁরই পূজা করছেন। তখন নিজ রূপ ধরে তিনি
দেবতাদের অভয় দিলেন।
দেবী দুর্গা এলেন হিমালয় পর্বতে। সেখানে শুম্ভ ও নিশুম্ভের দুই দূত
চণ্ড ও মুণ্ড বাস করত। চণ্ড-মুণ্ড পর্বতে ভ্রমণ করতে করতে দেখতে পেল
দেবীকে। দেবী-কর্তৃক বিমোহিত হয়ে তারা তাদের প্রভুর কাছে গিয়ে দেবীর
বর্ণনা দিয়ে তাদের পরামর্শ দিল এই দেবীকে বিবাহ করতে; সে যদি স্বর্গ থেকে
লুণ্ঠিত সব সম্পদের বিনিময়েও হয়, তাও।
"শুম্ভ সুগ্রীব নামে এক দূতকে দেবীর কাছে পাঠিয়ে জানাল যে, ত্রিভুবনের
সকল সম্পদ তার ঘরে; যা কিছু দেবতাদের উপহার দেওয়া হত, তা এখন উপহার
দেওয়া হয় তাকে। এই সবই দেবীর হতে পারে, যদি দেবী তার কাছে আসেন। দেবী
উত্তর দিলেন, ‘প্রস্তাব উত্তম, কিন্তু তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন, যে ব্যক্তি
তাঁকে যুদ্ধে পরাস্ত করে তাঁর দর্পচূর্ণ করতে পারবে, তিনি তারই হবেন।’
সুগ্রীব বিফল মনোরথ হয়ে ফিরতে চাইছিল না। সে দেবীকে ইতিবাচক উত্তরের জন্য
পীড়াপীড়ি করতে লাগল। কর্তাসুলভ মনোভাব নিয়ে বলল, ‘আপনি কি আমার প্রভুকে
চেনেন? আমারর প্রভুর সামনে ত্রিজগতে কেউ দাঁড়াতে পারে না; সে দেবতাই হোক,
দানবই হোক, কি মানুষই হোক। একজন নারী হয়ে আপনি কি করে আমার প্রভুর
প্রস্তাব ফিরিয়ে দিচ্ছেন? যদি প্রভু আমাকে আদেশ দিতেন, তাহলে আমিই আপনাকে
সঙ্গে যেতে বাধ্য করতাম।’ দেবী বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু আমি যে
প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছি, তাই তোমার প্রভুর উচিত আমার সামনে দাঁড়িয়ে
শক্তিপরীক্ষা করা।’
"দূত তার প্রভুর কাছে গিয়ে সব খুলে বলল। শুনে শুম্ভ রেগে উঠলে। সে তার
সেনানায়ক ধূম্রলোচনকে পাঠাল, হিমালয়ে গিয়ে দেবীকে ধরে আনতে আর যদি কেউ
তাঁকে উদ্ধার করতে আসে, তাহলে তাকে ধ্বংস করে ফেলতে।
ধূম্রলোচন হিমালয়ে গিয়ে দেবীকে তার প্রভুর আদেশের কথা জানাল। দেবী
তাকে যুদ্ধে আহ্বান জানালেন। ধূম্রলোচন কাছে আসতেই দেবী এমন এক হুঙ্কার
ছাড়লেন যে, এক হুঙ্কারেই সে ভষ্ম হয়ে গেল। দেবী দৈত্যসেনাদেরও ধ্বংস করে
ফেললেন। কেবল কয়েক জন প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসে তাদের প্রভুকে সব ঘটনা
জানাল। শুম্ভ-নিশুম্ভ মহাক্রোধে চণ্ড-মুণ্ডকে পাঠাল। তারা পর্বতে আরোহণ
করে দেখল, এক দেবী গর্দভের উপর বসে বসে হাসছেন। তাদের দেখেই দেবী রেগে
উঠলেন, গাছের ফলের মধ্যে টপাটপ দৈত্যসেনাদের ধরে খেয়ে ফেলতে লাগলেন।
তারপর তিনি মুণ্ডের মুণ্ডটি ধরে কেটে তার রক্ত পান করলেন। চণ্ড তার
সহযোদ্ধার এহেন মৃত্যু দেখে দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে এগিয়ে এল। দেবী তখন
সিংহের পিঠে বসে মুণ্ডের মতো চণ্ডেরও মাথাটি কেটে ফেললেন। তারপর
দৈত্যসেনাদের বধ করে তাদের রক্ত খেতে লাগলেন।
"এই খবর পেয়ে দৈত্যরা পিছু হটে আরও দৈত্যসেনা জুটিয়ে আনল। তখন অগণিত
দৈত্য চলল হিমালয়ের পথে। দেবতারা আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, দেবী মহামায়া
দুর্গার সাহায্যকল্পে নেমে আসছেন অন্যান্য দেবীগণ। দুর্গা দৈত্যদের বধ
করতে লাগলেন। শুম্ভের প্রধান সেনানায়ক রক্তবীজ ও নিশুম্ভ দৈত্যদের নিহত
হতে দেখে দেবীকে আক্রমণ করল। রক্তবীজ দৈত্যের রক্ত মাটিতে পড়ামাত্রই
প্রতিটি ফোঁটা থেকে রক্তবীজের সমতুল্য এক হাজার দৈত্যের উদ্ভব হয়ে লাগল।
তারা সবাই দুর্গাকে ঘিরে ধরল। দেবতারা পর্যন্ত এই অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখে
শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন চণ্ডী ও কালী। চণ্ডী
বললেন, কালী যদি দৈত্যদের রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই পান করে নিতে পারেন,
তাহলে চণ্ডী তাদের বধ করতে পারবেন। কালী রাজি হলেন। এইভাবে কালীর সাহায্যে
চণ্ডী রক্তবীজের ঝাড় ধ্বংস করলেন।
"শুম্ভ-নিশুম্ভ মরিয়া হয়ে দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে এল। প্রথমে এল
শুম্ভ। দুই তরফে ভয়ানক যুদ্ধ হল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই দৈত্যই নিহত হল।
কালী নিহত অসুরসেনাদের খেয়ে ফেলতে লাগল। দেবতারা দুর্গার জয়গান গাইতে
লাগলেন। দুর্গাও সকলকে আশীর্বাদ করলেন।”
দেবী দুর্গার এই সব রূপকে ঠিক অবতার বলা চলে না। এগুলি তাঁর রূপান্তর।
বিভিন্ন সময় অসুরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তিনি এই সব রূপ ধারণ
করেছিলেন। পার্বতী আর কালীর রূপের মধ্যে পার্থক্য এত বেশি যে, এঁদের একই
দেবীর দুই রূপ হিসেবে সহজে চেনা যায় না। দুর্গা সশস্ত্র দেবীর রূপে পূজিত
হলেও, আগে ছিলেন কনকবর্ণা এক শান্ত দেবী। মনে হয়, কালী ও উমা বা পার্বতী
প্রথম দিকে দুই ভিন্ন দেবী ছিলেন।
মহাভারতে অর্জুন দুর্গার যে স্তবটি গেয়েছিলেন, তা নিচে দেওয়া হল। এই
স্তবে তাঁর নানা নামের উল্লেখ আছে:—"হে সিদ্ধসেনানী, মহতী,
মন্দারপর্বতবাসিনী, কুমারী, কালী, কপালী, কপিলা, কৃষ্ণপিঙ্গলা, আপনাকে
প্রণাম। হে ভদ্রকালী, আপনাকে প্রণাম, হে মহাকালী, চণ্ডী, চণ্ডা, তারিণী,
বরবর্ণিনী। হে সৌভাগ্যদায়িনী কাত্যায়নী, হে করালি, হে বিজয়া, হে জয়া,
কৃষ্ণভগিনী, মহিষমর্দিনী! হে উমা, শাকম্ভরী, হে শ্বেতা, হে কৃষ্ণা! হে
কৈটভনাশিনী! তুমি ব্রহ্মবিদ্যা (বেদ), তুমিই যোগনিদ্রা। হে স্কন্দমাতা,
বনদুর্গা! হে মহাদেবী শুদ্ধচিত্তে তোমার স্তব করি; আমাকে যুদ্ধে বিজয়ী
করুন।” মহাভারতের আর একটি স্তবে দুর্গাকে বিন্ধ্যবাসিনী, মকার ও
বলিপ্রিয়া বলা হয়েছে।
দুর্গাকে কৃষ্ণের ভগিনী বলার পিছনে একটি গল্প আছে। কংসের হাত থেকে
কৃষ্ণকে রক্ষা করতে বাসুদের তাঁকে নন্দের গৃহে আসলে দুর্গা এসে কৃষ্ণের
স্থান গ্রহণ করেন। কংস তাঁকে পাথরে আছড়ে হত্যা করতে গিয়েও ব্যর্থ হন। এই
জন্য কৃষ্ণ বলেছিলেন, দুর্গা "গৌরবে তাঁর সমতুল্য হবেন; ইন্দ্রাদি দেবতারা
তাঁর পূজা করবেন। বিন্ধ্যপর্বতে তিনি বসবাস করবেন। সেখানেই বিষ্ণুর ধ্যান
করতে করতে তিনি শুম্ভ-নিশুম্ভ অসুরদ্বয়কে বধ করবেন। পশুবলির দ্বারা তাঁর
পূজা করা হবে।”
|