বাংলায় দুর্গোৎসবের প্রবর্তনা কে কবে করেছিল, সে সম্পর্কে কিছুই
নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। সাধারণভাবে মনে করা হয়, অধুনা বাংলাদেশের
তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ নাকি প্রথম দুর্গাপূজা করেন। যদিও বাংলায়
দুর্গোৎসবের ইতিহাস যে কংসনারায়ণের সময়কাল থেকে শুরু হয় না, তা প্রায়
হলপ করেই বলা যায়। কংসনারায়ণ দুর্গোৎসব করেছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর শেষলগ্নে
কিংবা সপ্তদশ শতাব্দীর সূচনায়। কিন্তু তারও আগেকার সাহিত্যে ও অন্যান্য
সূত্রে বাংলায় দুর্গাপূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। খুব সম্ভবত, যে বিপুল
ব্যয়ে কংসনারায়ণ দুর্গোৎসব করেন, তা-ই সেযুগের জনমানসে দুর্গাপূজার
সংজ্ঞা দিয়েছিল বদলে। আর সেই থেকেই কংসনারায়ণী মিথের উৎপত্তি।
শরৎকালের দুর্গাপূজার একটি প্রাচীন গল্প প্রচলিত আছে হিউয়েন সাংকে
নিয়ে। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কোনো এক সময়ে শরৎকালে গঙ্গাপথে চলেছিলেন এই
চীনা পর্যটক। পথে পড়লেন দস্যুর কবলে। দস্যুরা তাকে দেবী দুর্গার সামনে বলি
দেওয়ার জন্য ধরে নিয়ে চলল। বলির আয়োজন সারা। এমন সময় খ্যাপা শ্রাবণ
ছুটে এল আশ্বিনের আঙিনায়। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল সব আয়োজন। দস্যুরা মাথা
বাঁচাতে যে যেদিকে পারল দিল ছুট। সেই সুযোগে নিজেকে মুক্ত করে পালালেন
হিউয়েন সাং।
এই গল্প সত্য কি মিথ্যা বলা যায় না। তবে একথা সত্যি যে দুর্গাপূজার
ইতিহাস একেবারেই অর্বাচীন নয়। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি বলেছেন,
‘দুর্গাপূজা বৈদিক যজ্ঞের রূপান্তর, তন্ত্র দ্বারা সমাচ্ছন্ন।’ তাঁর মতে,
বৈদিক যুগে প্রত্যেক ঋতুর প্রারম্ভে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হত। শরৎঋতুর আরম্ভেও হত।
‘এই শরৎকালীন যজ্ঞই রূপান্তরিত হইয়া দুর্গাপূজা হইয়াছে।’ তাঁর যুক্তি?
তিনি বলেন, বৈদিক যজ্ঞ ও দুর্গাপূজার মধ্যে অনেক প্রভেদ রয়েছে। কিন্তু
উভয়ের উদ্দেশ্য একই। বৈদিক যজ্ঞের উদ্দেশ্য, ধন-ধান্য-পুত্র, রোগমুক্তি ও
শক্তিনাশের শক্তি প্রার্থনা। দুর্গার পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র বলে,
‘আয়ুরারোগ্যং বিজয়ং দেহি দেবি নমস্তুতে। রূপং দেহি যশো দেহি ভাগ্যং ভগবতি
দেহি মে। পুত্রান দেহি ধনং দেহি সর্ব্বকামাংশ্চ দেহি মে।।’ (হে ভগবতী,
আপনাকে প্রণাম করি, আপনি আমাকে রোগমুক্ত করুন, বিজয়ী করুন, যশ ও সৌভাগ্য
প্রদান করুন, পুত্র ও ধন দিন এবং আমার সকল কামনা পূর্ণ করুন।) যোগেশচন্দ্র
আরও দেখাচ্ছেন, দুর্গাপূজার মন্ত্রে ‘যজ্ঞ’ শব্দটির পরিব্যাপ্তি কতটা।
বৈদিক হিন্দুধর্ম ছিল যজ্ঞসর্বস্ব। দুর্গাপূজাতেও দেখি, দেবীকে যজ্ঞভাগ
গ্রহণে আহ্বান জানানো হচ্ছে (‘দেবি যজ্ঞভাগান্ গৃহাণ’) এবং পশুবলি দেওয়ার
সময় বলা হচ্ছে, যজ্ঞের নিমিত্তই পশুর সৃষ্টি (‘যজ্ঞার্থে পশবঃ সৃষ্টাঃ
তস্মিন্ যজ্ঞে বধোঽবধঃ’)। যোগেশচন্দ্রের তাই অনুমান, বৈদিক শারদ যজ্ঞই
তন্ত্রের প্রভাবে পর্যবসিত হয়েছে আধুনিক দুর্গোৎসবে। হৃদয়ে যা জাগে,
শরৎমেঘে তাই তো দেখা যায়।
বাংলায় যে দুর্গাপূজা প্রচলিত, তা মূলত মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা। মহিষাসুরমর্দিনীর পূজার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এ (রচনাকাল আনুমানিক অষ্টম শতাব্দী)। এছাড়া দুর্গাপূজার কথা পাওয়া যায় মার্কণ্ডেয় পুরাণ (মূল পুরাণটি চতুর্থ শতাব্দীর রচনা, তবে দুর্গাপূজার বিবরণ-সম্বলিত সপ্তশতী চণ্ডী অংশটি পরবর্তীকালের সংযোজন), বৃহন্নন্দীকেশ্বর পুরাণ (সঠিক রচনাকাল অজ্ঞাত), কালিকা পুরাণ (রচনাকাল ৯ম-১০ম শতাব্দী) ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ-এ
(রচনাকাল ১২শ শতাব্দী)। ৯ম-১২শ শতাব্দীর মধ্যকার সময়ে নির্মিত একাধিক
মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি বাংলার নানা স্থান থেকে আবিষ্কৃতও হয়েছে। সুতরাং,
ষোড়শ শতাব্দীর কোনো এক শরততপনে প্রভাতস্বপনে কংসনারায়ণের পরান কী চাইল,
আর তিনি মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি গড়িয়ে ফেলে পূজা করলেন–একথা মনে করার
কোনো কারণ নেই।
দুর্গাপূজার প্রাচীনত্ব অনুধাবনে আরও একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ
রঘুনন্দনের (১৫৪০-১৫৭৫) ‘দুর্গাপূজা তত্ত্ব’ গ্রন্থখানি। নবদ্বীপের এই
স্মার্ত পণ্ডিতের লেখা গ্রন্থটিতে দুর্গাপূজার যাবতীয় বিধান রয়েছে। এই সব
বিধান তিনি নিজে সৃষ্টি করেননি। আগেকার পুরাণ ও স্মৃতিশাস্ত্র থেকে প্রমাণ
সংগ্রহ করে পূজাপদ্ধতি লিখেছেন। কোনো কোনো বিধানের পৌরাণিক প্রমাণ দিতে
পারেননি। তাকে তিনি বলেছেন আচার–দেশাচার বা কুলাচার। আচার তাকেই বলে যা,
দেশে বা বংশে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত। স্মৃতিশাস্ত্রের ধর্ম: যা কিছু পুরনো,
সে পৌরাণিকই হোক আর আচারগতই হোক, তাকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং নতুনকে খারিজ
করা। স্মার্ত রঘুনন্দনের দেওয়া স্বীকৃতির বহর দেখলে মনে হয়, দুর্গাপূজার
যাবতীয় রীতিনীতি বহু বছর আগে থেকেই বাংলায় প্রচলিত ছিল। সম্ভবত, প্রাচীন
দুর্গাপূজাকে রঘুনন্দন তাঁর গ্রন্থের মাধ্যমে একটি সুসংবদ্ধ রূপ
দিয়েছিলেন। সেই কীর্তিই নতুন করে এই পূজার প্রতি বাঙালির দৃষ্টি আকর্ষণ
করে। কালক্রমে ঘটনাচক্রে তা বাঙালি হিন্দুর জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। মনে
রাখতে হবে, কংসনারায়ণের বংশে প্রথম দুর্গাপূজার বাসনা প্রকাশ করেছিলেন
তাঁর ঠাকুরদা উদয়নারায়ণ। সে ছিল ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ। রঘুনন্দন তখন বাঙালি
হিন্দুসমাজের অন্যতম প্রতীক।
কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণেও ফলাও করে রামচন্দ্রের দুর্গোৎসবের বিবরণ
পাওয়া যায়। এই বিবরণ মূল বাল্মীকি রামায়ণে নেই। কৃত্তিবাস তা সংগ্রহ
করেছিলেন দেবীভাগবত ও কালিকা পুরাণ থেকে। কিন্তু
রামচন্দ্রের জীবনবৃত্তান্ত লিখতে গিয়ে বৈষ্ণব কবি কেন তাকালেন দুই শাক্ত
পুরাণের দিকে? উত্তর পাওয়া যাবে, কৃত্তিবাসী রামায়ণের একটি প্রবণতার
মধ্যে–রামায়ণের চরিত্রদের বেশভূষায়, খাদ্যাভ্যাসে, স্বভাবে কৃত্তিবাস করে
তুলেছিলেন বাঙালি। তাই হয়ত রঘুবীরকে দিয়ে তাঁর ‘নয়ন-ভুলানো’কে
ডাকিয়েছিলেন। কৃত্তিবাস পঞ্চদশ শতাব্দীর মানুষ–জন্ম তাঁর কংসনারায়ণের বহু
আগে।
স্মার্ত রঘুনন্দনকেও আমরা দুর্গাপূজার প্রথম বিধানদাতা বলতে পারি না।
একাদশ শতাব্দীর বাঙালি পণ্ডিত ভবদেব ভট্ট দুর্গার মাটির মূর্তি পূজার বিধান
দিয়েছেন। বিধান দিতে তিনি উল্লেখ করেছেন তাঁরও চেয়েও প্রাচীন কয়েকজন
স্মৃতিকারের নাম। চর্তুদশ শতাব্দীর দুজন পণ্ডিত দুর্গাপূজার পদ্ধতি উল্লেখ
করেছেন। একজন মিথিলার কবি বিদ্যাপতি। তাঁর লেখা বইটির নাম
‘দুর্গাভক্তি-তরঙ্গিনী’। অপর জন বাঙালি পণ্ডিত শূলপাণি। তাঁর বইটির নাম
‘দুর্গোৎসব-বিবেক’। অর্থাৎ, চতুর্দশ শতাব্দীতেই বাংলায় দুর্গাপূজা ছিল
রীতিমতো ‘উৎসব’।
বাংলার অন্যতম প্রাচীন দুর্গাপূজা হল বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের
মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা। দেবী মৃণ্ময়ী ছিলেন মল্লভূম রাজ্যের
রাজরাজেশ্বরী–মল্ল রাজবংশের কুলদেবী। মল্লরাজ জগৎমল্ল ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে এই
পূজার প্রবর্তন করেন। এখানকার পূজাপদ্ধতি বাংলায় প্রচলিত দুর্গাপূজার থেকে
অনেকটাই আলাদা; কিছুটা আলাদা এখানকার দুর্গাপ্রতিমার গড়নও। মৃন্ময়ী দেবী
সপরিবারা বটে, কিন্তু লক্ষ্মী-গণেশ ও কার্তিক-সরস্বতী এখানে স্থানবদল করে
থাকে। অর্থাৎ, লক্ষ্মীর স্থলে গণেশ ও গণেশের স্থলে লক্ষ্মী এবং কার্তিকের
স্থলে সরস্বতী ও সরস্বতীর স্থলে কার্তিক। এই রূপে দুর্গাপ্রতিমা নির্মাণের
রীতিকে জগৎমল্ল-প্রথা বলা হয়। বাঁকুড়া জেলার অনেক প্রাচীন পরিবারেও
জগৎমল্ল-প্রথায় নির্মিত দুর্গামূর্তি পূজিত হয়। মল্ল রাজবাড়ির পূজায়
দেবীপটের যে ব্যবহার লক্ষিত হয়, তা অনেকটাই স্বতন্ত্র প্রকৃতির। বাংলার
সাধারণ দুর্গাপূজায় এমন পটের ব্যবহার দেখা যায় না। এই পূজাও কংসনারায়ণ
প্রবর্তিত পূজার অনেক আগে প্রচলন লাভ করে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রধান
শিষ্য নিত্যানন্দ খড়দহে স্বগৃহে প্রতিমায় দুর্গোৎসব করেছিলেন। সেও
কংসনারায়ণের বহু আগে।
প্রাচীন দুর্গাপূজার এত নিদর্শন থাকা সত্ত্বেও কিভাবে কংসনারায়ণী মিথের
উদ্ভব হল? মনে রাখতে হবে, কংসনারায়ণ দুর্গোৎসব করেছিলেন রাজসূয় ও
অশ্বমেধ যজ্ঞের বিকল্প হিসেবে। সে যুগের বাজারে দুর্গাপূজা করতে তিনি খরচ
করেছিলেন আট লক্ষ টাকা। এবং বাংলার প্রাচীন জমিদার বাড়ির দুর্গাপূজাগুলিও
সব কংসনারায়ণের পূজার পরপরই প্রবর্তিত হয় এবং কংসনারায়ণ-প্রদর্শিত পথে
সাড়ম্বরে পালিত হতে থাকে। নদিয়ার ভবানন্দ মজুমদার, বড়িশার সাবর্ণ
রায়চৌধুরী, কোচবিহার রাজবাড়ি সর্বত্রই ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতেই
দুর্গোৎসবের সূচনা। খুব সম্ভবত, দুর্গাপূজার শাস্ত্রীয় রূপটি ছাপিয়ে
আড়ম্বরের চাকচিক্যটাই বড়ো হয়ে ধরা দেয় মানুষের মনে। আর তা থেকেই
কংসনারায়ণকে দুর্গাপূজার প্রবর্তকের স্বীকৃতি দেওয়ার ভুল প্রবণতাটির
সৃষ্টি হয়।
কারো কারো ধারণা, জমিদার বাড়ির প্রাঙ্গন থেকেই দুর্গাপূজা হয়েছে
বাঙালির জাতীয় উৎসব। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। বৈদিক শারদ যজ্ঞ ছিল
সর্বজনীন এক ধর্মানুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানই যুগে যুগে নানা বিবর্তনের মধ্য
দিয়ে আধুনিক চার-দিনের দুর্গোৎসবে পরিণত হয়েছে। স্মার্ত পণ্ডিতদের লেখা
থেকে দুর্গাপূজার যে সুপ্রাচীন দেশাচার ও লোকাচারের কথা জানা যায়, তাই
প্রমাণ করে এই উৎসব আদতে ছিল বাঙালির মাটির উৎস। শাক্ত কবির আগমনী-বিজয়ায়
যে মাটির সুর বাজে, তাতে জমিদারগৃহের বাইজি নাচের নূপুরধ্বনি শোনা যায়
না, শোনা যায় মাথার উপর খড়ের চাল বয়ে চলা বঙ্গজীবনের প্রাণের
আশা-আকাঙ্খার কথা। এই সুর আবহমান। রবীন্দ্রনাথ তাই তাঁর গানে বাঙালি জাতির
হাজার বছরের হৃদয়ে লালিত প্রাণের কথাটিই লিখেছিলেন–
শস্যক্ষেতের সোনার গানে যোগ দে রে আজ সমান তানে,
ভাসিয়ে দে সুর ভরা নদীর অমল জলধারে।
যে এসেছে তাহার মুখে দেখ্ রে চেয়ে গভীর সুখে,
দুয়ার খুলে তাহার সাথে বাহির হয়ে যা রে।।
শরতে আজ কোন্ অতিথি এল প্রাণের দ্বারে।
আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে।।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার–
১। পূজা-পার্বণ, যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা।
২। Durga Puja: Yesterday, Today & Tomorrow, Sudeshna Banerjee, Rupa & Co.,New Delhi.
৩। মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা, দেব সাহিত্য কুটির সম্পাদনা, দেব সাহিত্য কুটির, কলকাতা।
৪। পূজাবিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা।
৫। সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস, ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা।
|