প্রতি বছর শরতের প্রথম শুভ্র সকালে ঢাকের শব্দে মুখরিত হয়ে ফিরে আসে শারদীয় দুর্গোউৎসব। ভক্তদের ভক্তি আর আনন্দের যূথবদ্ধ ধারণাকে মনে গেঁথে তার রূপায়নের জন্য দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করে যান প্রতিমা শিল্পীরা।
তবে গভীর আত্মনিবেদন আর ভক্তির সমাহারে গড়া প্রতিমা ভক্তানুরাগীদের আনন্দ দিতে পারলেও পালদের নিজেদের ঘরে আনন্দে নেই তারা। কর্মহীনতার প্রভাবে নিত্য অভাব-অনটন তাদের ছায়ার মত ঘিরে আছে।
আগের মত চরকা আর ঘোরে না তাদের ঘরে। দিনমান কর্মব্যস্ততার কারণে পালদের ঘরবাড়ি আর বউঝিদের গায়ে-মুখে হর-হামেশা কাদামাটি লেগে থাকতেও দেখা যায় না। চরকা ঘুরিয়ে যতেœ গড়া মাটির পণ্যের বেচাবিক্রি শেষতক তেমন না থাকায় পালরা প্রতিনিয়ত ঝুঁকছেন অন্য পেশায়।
অবস্থা এমন যে, তারা ভুলতে বসেছে বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী পেশা। একই সঙ্গে মাটির তৈরি বাসন-কোসন, পুতুলসহ নানান নিত্য ব্যবহার্য্য আর সৌখিন পণ্যসামগ্রীর প্রচলন হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার বুক থেকে। এর জায়গা দখল করে নিয়েছে বিকল্প উপাদানে তৈরি আধুনিক প্রযুক্তির নিত্যনতুন পণ্য।
তারপরও বছর ঘুরে শরৎ (শারদীয় দুর্গোৎসব) আসলে পালদের ঘরে দেখা দেয় ব্যস্ততা। এ সময়টায় ব্যস্ত, অর্ধব্যস্ত, বেকার আর অন্য পেশায় চলে যাওয়া পাল বংশের শিল্পীদের সিংহভাগ কোমড় বেঁধে নেমে লেগে পড়েন প্রতিমা গড়ার প্রতিযোগিতায়। দক্ষহাতে গড়ার পর আরও শৈল্পিক নৈপূণ্যে রাঙিয়ে তোলেন আরাধ্য প্রতিমার মুখ।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোউৎসব শুরু হতে বাকি আছে আর মাত্র ১৫ দিন। ২ অক্টোবর ষষ্টীর মধ্যদিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ এ ধর্মীয় উৎসব। চলবে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত। উৎসবকে সামনে রেখে দেশের অন্যান্য এলাকার মত নড়াইলেও দ্রুত গতিতে চলছে শত শত প্রতিমা তৈরির কাজ।
যে মানুষগুলোর হাতের নিপূণ ছোঁয়ায় গড়ে উঠছে একের পর এক প্রতিমা- কেমন আছেন তারা? এবারের শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রাক্কালে নড়াইলের প্রতিমা শিল্পীদের খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল- তারা একেবারেই ভালো নেই।
কথা প্রসঙ্গে শিল্পীরা জানান, বছরে তিন মাস প্রতিমা তৈরির কাজ ছাড়া বাকি সময়টা বেকার থাকতে হয়। অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন এবং বাকিরা ক্রমশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন পূর্বপুরুষের এ পেশা। বছরে তিন মাস প্রতিমা তৈরির কাজ করলেও তা দিয়ে কি আর সারা বছর সংসার চলে? এভাবে ক্রমশ চেপে বসা দারিদ্র্যের জগদ্দল পাথরটা আর নামছেই না তাদের বুক থেকে। আর তাই দিন দিন সহায়হীন, আশাহীন হয়ে পড়ছেন এখনো এ পেশায় লেগে মানুষগুলো।
নড়াইল সদরের রঘুনাথপুর উপজেলার প্রতিমা শিল্পী জগদিস পাল বাংলানিউজকে বলেন, ‘একটি প্রতিমা তৈরি করতে ৩-৪ জনের একটি দলের ১০ থেকে ১২ দিন সময় লাগে। এক একটি দল পূজার সময় ৭-৮টি থেকে শুরু করে ১৪-১৫টি প্রতিমা তৈরি করে থাকেন। আমাদের দলটি এবার সাতটি প্রতিমা তৈরির কাজ করছে।’
অপর শিল্পী অসিম পাল জানান, একটি প্রতিমা তৈরি করে ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা পাই আমরা। তবে বর্তমান বাজারে এ কাজ করে জীবন যাপন করা অত্যন্ত কষ্ট সাধ্য। আগে এ পেশায় অনেকেই থাকলেও বর্তমানে রং, চুন এবং চুলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় পূর্ব পুরুষের এ পেশা ছাড়তে অনেকেই বাধ্য হচ্ছেন।
রমেশ পাল বললেন, ‘পূজার পূর্বে আমরা প্রতিমা তৈরির কাজ করি। বাকি সময় মাঠে কৃষি কাজ করে সংসার চালাই।’
নড়াইলের প্রবীণ ঠাকুর প্রদ্যুৎ মুখার্জী বলেন, ‘এ বছর দেবী আসবেন হাতিতে চড়ে আর যাবেন দোলায় চড়ে।’
তিনি আরো জানান, প্রতি বছরই নড়াইলে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে শারদিয় দুর্গোৎসব পালিত হয়ে থাকে।’
জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমলাখী বিশ্বাস বাংলানিউজকে জাননি, জেলায় প্রায় ৬০০ মন্দিরে দুর্গাপূজা উৎসব উদযাপিত হবে।
পৌরসভার মাছিমদিয়া এলাকার নির্মল পাল জানান, তার স্ত্রী, সন্তানসহ পাঁচজনের সংসার। প্রতিবছরে দুর্গাপ’জাতে প্রতিমা তৈরি করে যে টাকা পান তা দিয়ে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচসহ খেয়ে না খেয়ে সংসার চালাতে হয়।
নির্মল বললেন, ‘আমাদের পরিবারে আমি ছাড়া আর কেউ এ কাজের সঙ্গে জড়িত নেই। অনেক কষ্টে পরিবার নিয়ে বেঁচে আছি।’
তার ছেলে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র অঞ্জন পাল বললো, ‘বাবার আয়ে আমাদের সংসার চলে না। মাঝে মাঝে না খেয়ে স্কুলে যেতে হয়।’
নির্মলের প্রতিবেশি অলোক পাল বলেন, ‘আমরা আগে প্রতিমা তৈরির কাজ করতাম। বর্তমানে প্রতিমা তৈরির জিনিসপত্রের দম বেড়ে যাওয়ায় এ কাজ বন্ধ করে দিয়েছি।’
একই এলাকার সন্তোষ পাল, মুকুন্দ পাল, নারায়ণ পাল বললেন, আমরা একসময় মাটির জিনিসপত্র তৈরির কাজ করতাম। মাটির তৈরি হাড়ি-পাতিলের চাহিদা কমে যাওয়ায় এখন আর এ কাজ করি না।