“ঢাকের তালে জীবন চলে..আজি বাজা কাসর..জমা আসর, আজবেরে মা আসবেরে... বলো দুর্গা মায় কি... জয়...” শারদীয় দুর্গা পুজার উৎসবের প্রধান আকর্ষণই হচ্ছে ঢাক। পূজার সময় সন্ধ্যা গড়ানোর সাথে সাথেই ঢাকের বাদ্যে মুখরীত হয়ে ওঠে দুর্গা মন্দিরের আশপাশসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা। সন্ধ্যা শেষে মধ্যরাতে ঢাকের শব্দ শুনলেই বোঝা যায় মন্দিরের সম্মুখে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। তাই ঢাকের শব্দ শুনেই ধর্মবর্ণ নিবিশেষে অনুষ্ঠান প্রেমীরা দলবেঁধে ছুটে চলেন মন্দির আঙ্গিনায়।
এছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের বারো মাসের প্রায় প্রতিটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও বিয়ে বাড়িতে ঢাক-ঢোল আর বাঁশির শব্দ এবং ঢুলীদের কোমর ঢোলানো নাচ-ই হচ্ছে অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ।কবে কখন কেইবা প্রথম এই ঢাকের বাদ্যের প্রচলন ঘটিয়েছে, তা সঠিক করে কেউ বলতে না পারলেও প্রাচীনকাল থেকেই এ ঢাক বাদ্যের প্রথা চলে আসছে। এককথায় ঢাকের বাদ্য (শব্দ) ছাড়া দুর্গা পুজার অনুষ্ঠানসহ হিন্দু ধর্মাবোলম্বীদের কোন অনুষ্ঠানই জমে না। এছাড়াও অতীতের জমিদারদের পাইক পেয়াদারা ঢাক পিটিয়ে (বাজিয়ে) প্রজাদের মাঝে জমিদারদের হুকুম জারি কিংবা নিমন্ত্রণ করতেন। যুগ যুগ ধরে ঢাক বাদ্য তৈরি ও ঢাক বাজিয়ে লাখ লাখ মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। বর্তমান আধুনিকতার যুগও প্রাচীনকালের ঢাকের প্রথাকে আজো বিলুপ্তি ঘটাতে পারেনি।
বিশেষ করে দুর্গা পুজা আসলেই ঢাকের চাহিদা অনেকাংশে বেড়ে যায়। তাই ঢাক তৈরির কারিগর ও শ্রমিকেরা এখন মহাব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। আর মাত্র কয়েকদিন পরেই হিন্দু ধর্মাবোলম্বীদের প্রধান ও সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পুজা উপলে ঢাক বাজানো বাদ্যকার ও বিভিন্ন মিউজিক পার্টি থেকে অর্ডার নেয়া ঢাক সঠিক সময়ে সরবরাহ করার জন্য ঢাক তৈরির কারিগর ও শ্রমিকদের এখন দিনরাত এককার হয়ে গেছে। বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলা সদরের ঢাক তৈরির কারিগর শ্যামল দাস (৫০)। বংশ পরস্পরায় দীর্ঘ ৩০ বছর পর্যন্ত তিনি এ পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। তার জন্মস্থান মানিকগঞ্জে। শ্যামল দাস জানান, তার পূর্ব পুরুষ ঢাকসহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র তৈরির কাজ করেছেন। তিনি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থেকে কাজ শিখেছেন। তার শ্বশুর বরিশাল বিভাগের একমাত্র হিন্দু অধ্যুষিত আগৈলঝাড়া উপজেলা সদরে দীর্ঘদিন ধরে এ কাজ করেছেন। সে হিসেবে তিনি (শ্যামল) গত ২০ বছর ধরে আগৈলঝাড়ায় স্থায়ী দোকান দিয়ে এ কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি আরো জানান, একটি মাঝারি ঢাক তৈরি করতে তার ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা খরচ হয়। আর সেটি বিক্রি করছেন ৭ থেকে ৮ হাজার টাকায়।
হিন্দু অধ্যুষিত আগৈলঝাড়া বারো মাসই তিনি এ কাজ করে যাচ্ছেন। দুর্গা পুজা উপলে ইতোমধ্যে তার কাছে নতুন ঢাক তৈরি ও মেরামতের বেশ অর্ডার এসেছে। পাঁচ সদস্যের সংসারে ঢাকসহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র তৈরি ও মেরামত করে শ্যামল দাস তার পরিবার পরিজন নিয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দেই বসবাস করছেন।
বরিশালের গৌরনদীর একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বসে কথা হয় পূর্ব পুরুষের পেশা হিসেবে এখনো নিজেকে জড়িয়ে রাখা ঢাক বাদ্যকার (ঢুলী) অরুন চন্দ্র ঋষির (৩৫) সাথে। কালকিনি উপজেলার কানাইপুর গ্রামে তার বাড়ি। তার বাবা কান্দেব চন্দ্র ঋষির কাছে তিনি ১২ বছর বয়সে ঢোল বাজানো শিখেছেন। বংশ পরস্পরায় তার বাবা-দাদা ও তাদের পূর্ব পুরুষেরা এ পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
অরুন জানায়, বাব-দাদার এ পেশাকে ধরে রাখতে দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, কালকিনিসহ বিভিন্নস্থানের বিয়েবাড়ি, হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান (পূজা মন্ডবে), সিনেমার প্রচারণা ও নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি ঢুলী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি আরো জানান, নরদের এ পেশায় থাকার কথা থাকলেও তারা ঋষি সম্প্রদায়ের হয়েও পূর্ব পুরুষের পেশাকে ধরে রাখতে এখনও নিরলশ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাদের গ্রামের প্রায় ৪০টি পরিবার বংশ পরস্পরায় এখনো এ পেশাকে আঁকরে রেখেছেন। অরুনের ঢোলের তালে যেকোন অনুষ্ঠানে আগত দশনার্থীদের নাচিয়ে তোলে।
অরুনের মতে, বারোমাস তাদের অনুষ্ঠান লেগেই রয়েছে। আয়ও হচ্ছে বেশ। প্রতিমাসে তিনি ৭/৮ হাজার টাকা আয় করেন বলেও উলেখ করেন।[