বিশিষ্ট দার্শনিক ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবের জন্ম ১৯০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, সিলেট জেলার তৎকালীন পঞ্চখণ্ড পরগণার লাউতা গ্রামে৷ অসাধারণ মেধার অধিকারী গোবিন্দচন্দ্র দেব ১৯২৫ সালে তৎকালীন পঞ্চখণ্ড হরগোবিন্দ হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স, ১৯২৭ সালে কোলকাতার রিপন কলেজ থেকে এফ.এ, ১৯২৯ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে দর্শন বিষয়ে বি.এ অনার্স এবং ১৯৩১ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন৷ ১৯৪৪ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি 'Reason, Intuition and Reality' শিরোনামে অভিসন্দর্ভ দাখিল করে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন৷
তিনি এম.এ পাশ করার পর বোম্বাই-এর অমলনারে অবস্থিত রিসার্চ ইনস্টিটিউটে কিছুকাল ভারতীয় বেদান্ত দর্শনের উপর গবেষণায় নিযুক্ত থাকেন৷ সেখান থেকে ফিরে কোলকাতা সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন৷ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সুরেন্দ্রনাথ কলেজ কোলকাতা থেকে দিনাজপুরে স্থানান্তরিত হলে অধ্যাপক হিসেবে তিনি দিনাজপুর চলে আসেন৷ ১৯৪৫ সালে ঐ কলেজ আবার কোলকাতায় স্থানান্তরিত হলে তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দিনাজপুরে নতুনভাবে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়৷ এ কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কয়েক বছর কাজ করার পর তিনি ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে যোগদান করেন৷ ১৯৫৭ সালে তিনি জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট নিযুক্ত হন৷ তিনি ১৯৬৩ সালে দর্শন বিভাগের অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করার পর ১৯৬৭ সালে প্রফেসর পদে উন্নীত হন৷ গোবিন্দচন্দ্র দেবেরই আপ্রাণ চেষ্টায় ও অর্থানুক‚ল্যে ১৯৬৪ সালে ঢাকায় ‘দর্শন ভবন’ স্থাপিত হয়৷
তিনি ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া প্রদেশের উইলক্সবার কলেজে যোগদান করেন এবং সেখানে এক বছর অবস্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন৷ ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে উইলক্সবারে অবস্থানের সময় তাঁর প্রচারিত মানবতাবাদী দর্শনে মুগ্ধ হয়ে তাঁর গুণগ্রাহীগণ তাঁর স্মরণে ‘দ্য গোবিন্দদেব ফাউন্ডেশন ফর ওয়ার্ল্ড ব্রাদারহুড’ নামক প্রতিষ্ঠান গঠন করেন৷ ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমেরিকা থেকে ফিরে তিনি পুনরায় অধ্যক্ষ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে যোগ দেন৷ অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র দেব জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন৷ তিনি ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের সেক্রেটারি ছিলেন৷ তদানীন্তন পাকিস্তান ফিলসফিক্যাল কংগ্রেসের সম্পাদক হিসেবেও তিনি বহুকাল দায়িত্ব পালন করেন৷ তিনি তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা-সংস্কার কমিশনসহ বাংলা একাডেমীর কার্যকরী কমিটির অন্যতম সদস্য, যুক্তরাজ্যের ‘দি ইউনিয়ন অব দ্য স্টাডি অব গ্রেট রিলিজিয়নস্’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফিলসফি অব সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সদস্য ছিলেন৷
প্রফেসর জিসি. দেব কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থের রচয়িতা৷ তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি হলো: Idealism and Progress; Idealism: A New Defence and New Application; Aspirations of the Common Man; Buddha the Humanist; Philosophy of Vivekananda and the Future of Man; My American Experience; তত্ত্ববিদ্যাসার এবং আমার জীবনদর্শন৷ এছাড়া দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে৷
বরেণ্য দার্শনিক হিসেবে ড. দেব ভাববাদ, ধর্ম, বিজ্ঞান, যুক্তি প্রভৃতির একটি অখণ্ডরূপ দিতে চেষ্টা করেছেন৷ এ সমন্বয়বোধই তাঁর দর্শনের প্রধান বৈশিষ্ট্য৷ তাঁর ঐকান্তিক ইচছা ছিল আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি, নৈতিক মূল্যবোধ ও মানবতাবাদী দর্শনের উপর গবেষণার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা হবে একটি গবেষণা কেন্দ্র৷ তাঁর ইচছার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে প্রতিষ্ঠিত হয় "গোবিন্দ দেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্র”৷ শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর গৌরবময় অবদানের জন্য ১৯৮৫ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়৷
অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র দেব ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ঢাকার রাজপথে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে মিছিলে অংশগ্রহণ করে আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন৷ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাক-হানাদার বাহিনীর গণহত্যার শিকার হয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন জ্ঞানতাপস দার্শনিক গোবিন্দচন্দ্র দেব৷ যাঁদের আত্মত্যাগে স্বাধীনতা সংগ্রাম মহিমান্বিত হয়েছে শহীদ ড. জিসি. দেব তাঁদের পথিকৃত৷
হত্যা
ড. দেব এর পালিতা কন্যা রোকেয়া বেগম আর তার স্বামী তাঁর বাসায় থাকতেন।
২৫শে মার্চ, ১৯৭১ তারিখে রাতে সারারাত ধরেই তাঁর বাড়ির উপর গুলি বর্ষিত
হয়েছে। ভোরের দিকে তিনি তার মেয়েকে বললেন : মা তুমি একটু চা কর। আমি
ততক্ষণে ভগবানের একটু নাম করি। এ সময় দরজা ভেঙে পাকিস্তানী সেনারা ঘরে
প্রবেশ করে । "কাঁহা মালাউন কাঁহা" বলে তারা প্রফেসর দেবকে খোঁজ করে।
পালিতা কন্যা রোকেয়া বেগমের স্বামী গোবিন্দ চন্দ্র দেবকে বাঁচাতে এগিয়ে
আসেন এবং সৈন্যদের মন গলানোর জন্য কলেমা পড়েন। কিন্তু এতে কাজ হয়নি। ড.
দেব নিজেও দু'হাত ওপরে তুলে "গুড সেন্স গুড সেন্স" বলে তাদের নিবৃত্ত করতে
চেয়েছেন। কিন্তু হাত কয়েক ব্যবধানে থেকে সেনাসদস্যরা ব্রাশ ফায়ার করে
গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও রোকেয়া বেগমের স্বামীকে হত্যা করে। রোকেয়া বেগম
আকস্মিক আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ডে অচেতন হয়ে পড়ায় বেঁচে যান। ২৬ শে মার্চ
বিকেলে জগন্নাথ হলের পশ্চিম পাশ (যেখানে তার লাশ ফেলে রাখা হয় ) ঘেঁষে
উত্তর-দক্ষিণ বরাবর গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দেয়া হয় হলের প্রভোস্ট ড.
দেবসহ অন্যদের লাশ ।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবকে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার ২০০৮’ (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়েছে ।