ব্রত অর্থে কোন কিছুকে উপলক্ষ্য করিয়া যে নিয়মাদি পালন এবং কোন কারণেই সেই নিয়ম লংঘন না করা হয় সেই অপিতত নিয়মকেই ব্রত বলে। এক সময় মহর্ষি জৈমিনি ঋষি নিজ গুরুদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন “হে গুরুদেব একাদশীর জন্ম কখন হয়েছিল এবং তার জন্মের উৎসই বা কি? একাদশীর দিন উপবাস পালনের বিধি বা কি? দয়া করে এই ব্রত পালনে কি লাভ এবং কখন এই ব্রত উদযাপন করতে হবে, তা বর্ণনা করুন। শ্রী একাদশীর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা কে? একাদশীর নিয়ম পালন না করার অপরাধ কি? দয়া করে এই বিষয়ে আপনার কৃপা বর্ষন করুন।” শ্র্রীল ব্যাসদেব জৈমিনি ঋষির প্রশ্ন শুনে অপ্রাকৃতআনন্দ ধামে উন্নীতি হয়ে বললেন,হে জৈমিনি ব্রহ্মার্ষি। একাদশী পালনের ফল প্রকৃতরূপে পরমেশ্বর নারায়ণই শুধু মাত্র শুদ্ধভাবে বণর্না করতে পারেন। পরমেশ্বর ভগবান সৃষ্ঠির প্রথম লগ্নে মানুষ সৃষ্ঠির পর পাপী মানুষের শাস্তি দেওয়ার নিমিত্তে এক অদ্ভুতদশী পাপ পুরুষ সৃষ্টি করেন। এই পাপ পুরুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আদি নানা প্রকার পাপ কার্য দ্বারা গঠন করেছিলেন। তার মস্তকটি ছিল ব্রহ্মহত্যার পাপ, চোখ দুটি নেশায় আসক্তি জনিত পাপ, মুখটি ছিল স্বর্ণচৌর্য জনিত পাপ, কান দুটি সদগুরুর পত্নী উপগমন জনিত পাপ, নাসিকা পরপত্নী হত্যা জনিত পাপ, হাত দুটি গোহত্যা জনিত পাপ, গ্রীবা পরধন চৌর্য জনিত পাপ, ব্রহ্মদেশ ভ্রুণহত্যা জনিত পাপ, নিম্নবক্ষ পরকীয় উপগমন জনিত পাপ, উদর আত্মীয় হননের পাপ, নাভীমূল অধীনস্থ জনকে হত্যার পাপ, কটিদেশ আত্মস্তুতি পাপ, জংঘা গুরুর প্রতি অপরাধ জনিত পাপ, লিঙ্গ নিজ কন্যা বিক্রয় জনিত পাপ, পশ্চাত দেশ গোপন বিষয় প্রকাশ করার পাপ, পদদ্বয় পিতৃ হত্যার পাপ, তার কেশরাজি অন্যান্য পাপ কর্মাদি। এই প্রকার একটি বীভৎস পাপময় জীব সৃষ্টি করেছিলেন। যার শরীর ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, চোখ দুটি পীতবর্ণ। সে পাপীদের অতীব দুর্দশা দান করে। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ণু এই পাপ পুরুষকে দেখে নিজ মনে চিন্তা করতে লাগলেন, আমিই জীবনগণের সুখ দুঃখের স্রষ্টা।আমি তাদের প্রভু, কারণ পাপ পুরুষ আমি সৃষ্টি করেছি। সে অসাধু, প্রতারক এবং পাপীদের দুঃখ কষ্ট দেয়। এই পাপ পুরুষের নিয়ন্ত্রক সৃষ্টি করতে হবে।এই সময় ভগবান যমরাজ ও নানা প্রকার নরক সৃষ্টি করলেন। মৃত্যুর পর পাপীদের যমরাজের নিকট পাঠান হবে এবং তিনি তাদের পাপ অনুসারে বিভিন্ন নরকে যন্ত্রনা ভোগের জন্য পাঠান এবং কঠোর শাস্তি দেন। এইরূপ ব্যবস্থা করে পরমেশ্বর ভগবান পক্ষীরাজ গুরুরে চড়ে যমরাজের গৃহে উপস্থিত হলেন। যমরাজ বিষ্ণুকে দেখেই পাদ্য অর্ঘ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করলেন, তাকে স্বর্ণ সিংহাসনে বসালেন। পরমেশ্বর ভগবান বসেই বিভিন্ন প্রকার পাপকর্ম জনিত শাস্তি প্রাপ্ত পাপীদের দক্ষিন দিকে উচ্চ চিৎকার শুনতে পেলেন। এই আর্তনাদ শুনে ভগবান নরকে উপস্থিত হলেন। তাকে দেখে নরকবাসীগন অধিক উচ্চস্বরে কান্নাজড়িত কন্ঠে চিৎকার করতে লাগলেন। তাদের করুন আর্তনাদ শ্রীভগবানের মন করুণায় বিগলিত হল। ভগবান শ্রীবিষ্ণু ভাবলেন, এদের সৃষ্ঠি আমি করেছি এবং আমার কারণে তারা কষ্ট ভোগ করছে। ব্যাসদেব বলতে লাগলেন, হে জৈমিনি! পরমেশ্বর ভগবান তারপর কি করলেন শোন। করুণাময় পরমেশ্বর ভগবান পূর্বের বিচারধারা পুনঃ চিন্তা করলেন। তিনি হঠাৎ একাদশীরূপে আবির্ভূত হলেন। ভগবানের এহেন করুণামূর্তি প্রকটিভ দেখে নরক বাসীগণ একাদশী পালনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে পাপমুক্ত হল এবং বৈকুন্ঠ ধামে গমন করল। এই একাদশী এবং পরমেশ্বর ও তার বিগ্রহ এক ও অভিন্ন। শ্রী একাদশী আবির্ভাবের সাথে সাথে এই পাপ পুরুষ একাদশীর প্রতিকুল প্রভাব অনুভব করল।সে বিষ্ণুর স্তুতি করতে লাগল।বিষ্ণু প্রসন্ন হয়ে তাকে বর দিতে চাইলেন। পাপ পুরুষ বলল, আমি আপনার সৃষ্ট। পাপির শাস্তি আমার মাধ্যমে দিতে আপনি ইচ্ছা করেছিলেন। কিন্তু শ্রী একাদশীর প্রভাবে আমার অস্তিত্ত¡ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। হে প্রভু! আমার মৃত্যুর পর আপনার অংশগুলি যারা জড়দেহ ধারন করেছে তারা সবাই মুক্তি লাভ করে বৈকুন্ঠ ধাম প্রাপ্ত হবে। সবাাই মুক্ত হয়ে গেলে আপনার এই লীলায় কে অংশ গ্রহণ করবে। হে কেশব! আপনি যদি শাশ্বত লীলায় প্রকাশ চান তা হলে একাদশীর ভয় থেকে আমার বাচাঁন। একাদশী তো আপনার বিগ্রহেরই বি¯তৃতি। শ্রী একাদশীর ভয়ে আমি পালিয়ে মানুষ, পশু, কীট, পাহাড়, বৃৃক্ষ, স্থাবর ও অস্থাবর জীবগণ, নদী, সমুদ্র, জঙ্গল,স্বর্গ, মর্ত, নরক, দেবতা ও গন্ধর্বগণের নিকট যাই। কিন্তু শ্রী একাদশীর প্রভাবে মুক্ত স্থান খুজে পাই না। হে প্রভু! আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমাকে এমন একটি বাসস্থান দিন যেখানে থাকলে একাদশীর ভয় থেকে মুক্ত হতে পারব। ব্যাসদেব জৈমিনিকে বললেন, “ এইরূপ প্রার্থনা করে পাপ পুরুষ পরমেশ্বর বিষ্ণুর পাদপদ্মে নিপতিত হয়ে কাঁদতে লাগল। অতঃপর বিষ্ণু পুরুষের দুর্দশা সহাস্যে বললেন, হে পাপ পুরুষ আর কেঁদ না। একাদশীর দিন তোমার আশ্রয় কোথায় হবে মন দিয়ে শোন। একাদশীর দিন তুমি খাদ্য শষ্যে আশ্রয় গ্রহণ করবে। আর ভাবনা করো না, কারণ শ্রী একাদশী সেখানে বাধা সৃষ্টি করবে না। পাপ পুরুষকে এইরূপ বলে পরমেশ্বর বিষ্ণু অন্তর্ধান হলেন এবং পাপ পুরুষ নিজের কাজে লিপ্ত হলেন। সেই থেকে পরম লাভে চেষ্টাবান ব্যক্তিগণ একাদশীর দিন পঞ্চ রবি শষ্য গ্রহণ করে না। বিষ্ণুর আদেশে জড় জগতের সকল প্রকার পাপ কর্ম একাদশীর দিন পঞ্চ রবিশষ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে। একাদশী পালন কর পাপ থেকে মুক্তি লাভ করা যায় এবং কখনো নরক গামী হতে হয় না। একাদশীর দিন এক মুষ্টি শস্য খেলে কোটি ব্রাহ্মণ হত্যার পাপ হয়, একাদশী পালন যারা না করে তারা তো পাপীর অধম। সেই কারণে আমি বার বার বলছি যে, একাদশীতে কখনও শস্য ভক্ষণ করো না । ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র নির্বিশেষে একাদশী পালন করা অবশ্য করণীয় ইহাই শুদ্ধ বর্ণাশ্রমের ভিত্তি। একাদশী পালন করলেই সর্বপাপ নাশ হয় ও অবশ্যই বৈকুন্ঠ ধাম লাভ করা যায়। ( পদ্মপুরাণ )