চৈতে-নিত্যে-অদ্বৈ এই তিন পাগলের ভাবশিস্য বাউল ধর্মের শিরোমণি সিদ্ধপুরুষ ফকির লালন শাহ - 11 September 2011 - হিন্দু ধর্ম ব্লগ - A Total Knowledge Of Hinduism, সনাতন ধর্ম
Hinduism Site
Main » 2011»September»11 » চৈতে-নিত্যে-অদ্বৈ এই তিন পাগলের ভাবশিস্য বাউল ধর্মের শিরোমণি সিদ্ধপুরুষ ফকির লালন শাহ
Added by: rajendra
0:48 AM
চৈতে-নিত্যে-অদ্বৈ এই তিন পাগলের ভাবশিস্য বাউল ধর্মের শিরোমণি সিদ্ধপুরুষ ফকির লালন শাহ
বাঙালির ধর্ম প্রচারক কলিকালের অবতার চৈতন্য।জাত-পাতের যাঁতাকলে পিষ্ট
দরিদ্র মানুষের গৌরাঙ্গ-জাতহীন। নারী পুরুষ এক দেহে ধারণ করে
আবির্ভূত।সিদ্ধপুরুষ লালন বাংলা ও এর বাইরে থেকে আসা সমস্ত মতবাদ
আত্তীকরণের সর্বোচ্চ বঙ্গীয় প্রকাশ।'রবি ঠাকুরকে কিছুটা আধুনিককালের লালন
বলা যেতে পারে'।
সমগ্র সিন্দ্ধু ও গাঙ্গেয় উপত্যকা তথা ভারতবর্ষ হাজার হাজার বছর ধরে ধারণ
করছে অসংখ্য মানবের জীবন।নৃতাত্বিকভাবে জন্ম হয়েছে অনেক ভাষা, সংস্কৃতি বা
এর বিশেষ রূপ ধর্ম।শত শত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের হাজারো রীতি-নীতি,
আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-অর্চনার যে সনাতনী সংস্কৃতি তাই পরবর্তিতে হিন্দু ধর্ম
নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।পারসিয়ান ও আরবীয়রা মশলার ব্যবসাসূত্রে ভারতের সাথে
পরিচিত হয়। এবং সিন্দ্ধু অঞ্চলের মানুষদেরকে সিন্দ্ধ্ বা ইন্দু (Indus
Valley) বা হিন্দু বলে তারা অভিহিত করে ফলশ্রুতিতে তাবত দুনিয়ার মানুষের
কাছে ভারতীয়রা হিন্দু ও তাদের সংস্কৃতি বা ধর্ম হিন্দু ধর্ম নাম লাভ করে
বলে অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মত। বহুবিধ তণ্ত্র-মণ্ত্র- ডাক-যোগ দর্শনের
প্রকাশ্য ও গোপন চর্চা অথবা কপিল, বৃহস্পতিদের বস্তুবাদী চার্বাক দর্শনের
অভূতপূর্ব ভূমি ইন্ডিয়া। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় বা দার্শনিক সম্প্রদায়ের সহ
অবস্থানের ফলে জীবনাচরনের মিলন (fusion), ভিন্নতা (fission), ধর্মের
ক্রমবিকাশ, নতুন নতুন ধর্মের আবির্ভাবে ভারত যেন এক গরম তাওয়া (melting
pot)।এখানে উদ্ভুত বৌদ্ধ ধর্ম পারস্য, মধ্যপ্রাচ্য আর মধ্য এশিয়া বাদ দিলে
সমগ্র এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করে।ভারতীয় ধর্ম বিস্তারিত (diffusion) হয়েছে
অর্থাৎ রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়া ধর্মের অনুপ্রবেশ আর সেমেটিক(Semitic) ধর্মসমূহ
প্রবাহিত (current/tide) হয়েছে অর্থাৎ রাষ্ট্রক্ষমতা ও ধর্ম অনুপ্রবেশ
করেছে যুগপৎভাবে।দার্শনিক এই অবস্থানের কারণেই হয়তো ভারতীয়রা উপনিবেশ গড়ে
তুলে নি কখনো কিন্তু উপনিবশিত হয়েছে বার বার।উপনিবেশকারীদের মধ্যে
উল্লেখযোগ্য হল মোগল আর ইংরেজরা।
সপ্তম শতকের তিরিশের দশকে মক্কা জয়ের পর আরবরা ইসলামের দর্শন হাতে নিয়ে
দিগ্বিজয়ে বের হয় এবং ইসলাম ধর্ম প্রবাহিত হয়ে পশ্চিম দিকে মরোক্ক পর্যন্ত
পুরানো সকল সংস্কৃতি খোলনলচে পালটে ফেলে এমন কী মুখের ভাষা পর্যন্ত
প্রতিস্থাপিত করে কায়েম করে আরব বিশ্ব।এ প্রবাহের অতিরিক্ত সংযোজন স্পেন,
এরপর ফ্রান্সের গলে গিয়ে ক্ষান্ত হয় আরবদের পশ্চিমমূখী যাত্রা। পূর্ব
প্রবাহ ব্যাপকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয় পারস্যে।পারসিক সংস্কৃতির কাছে মুষড়ে পড়ে
আরব সংস্কৃতি।ইরানে ইসলাম রূপান্তরিত হয়। ইরানের পার্শ্বে বাগদাদ দীর্ঘ
দিন ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু ছিল।আব্বাসীয়রা মুতাজিলাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
ইসলামে যৌক্তিকভাবে আল্লার উপস্থিতি প্রমাণে প্রভাব বিস্তারকারী
মুতাজিলারা ব্যর্থ হলে প্রভাব বিস্তার করে সূফীজম।যার উর্বর ভূমি হলো
পারস্য বা ইরান।
সপ্তম শতক থেকে শুরু করে ত্রয়োদশ শতকে এসে মুসলমানরা মোটামুটি পুরো
ভারতবর্ষ দখল করে।কিন্তু ততোদিনে ইরানে দেয়ালে ধাক্কা খাওয়া ইসলাম অনেকটা
ভিন্নরূপে যা কীনা প্রধানত ইরানের সূফীদের দ্বারা প্রচারিত হয়
ভারতে।মোহাম্মদ ও খোলেফায়ে রাশেদীনের পরে যে নামগুলেো শুনা যায় তা হলো-বড়
পীর আব্দুল কাদের জিলানী, খাজা বাবা মইনূদ্দীন চিশতী, বাবা ফরীদ, নিজাম
উদ্দীন আউলিয়া, শাহ জালাল ইত্যাদি যারা সকলেই সূফী।পারস্য আর মধ্য এশিয়া
থেকে ঝাকে ঝাকে পীর-আউলিয়ারা ভারতে ধর্ম প্রচার করে যাকে বলা যায় ইসলামের
বিস্তার(diffusion)।
মরমি কবি ফকির লালনকে জানার চেষ্টার প্রারম্ভে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত
ব-দ্বীপের অনিশ্চিত কৃষিভিত্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন এবং সনাতনী তথা
হিন্দু , বৌদ্ধ এবং ইসলাম এই তিন ধর্মের মিথষ্ক্রিয়ার মানস জগৎ বিবেচনায়
রাখা দরকার। হিন্দু ধর্মজাত বৈষ্ণব ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্মের সহজিয়া মতবাদ,
ইসলামের সূফী মতবাদ বাংলায় যা মূলত মারেফত বা মাইজভাণ্ডারী নামে পরিচিত- এই
তিন মূল ধারার মিলনের ফলে উদ্ভূত বাংলার ধর্ম হলো বাউল ধর্ম।
বাউল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়।বাউলদের ধর্মের তত্ত্ব ও দর্শন আছে, সাধন
পদ্ধতি আছে, সাধক জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা আছে, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাদের
একটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে, এ সমস্তই ব্যক্ত হয়েছে তাদের গানে।এই সম্প্রদা্য়ের
সাধকগণের তত্ত্ব দর্শন ও সাধনা সংবলিত গানই বাউল গান।
রূপ থেকে স্বরূপে ওঠাই বাংলার বাউলদের সাধনা।
কীভাবে পুরূষ-প্রকৃতি ( জীবাত্মা-পরমাত্মা/ নারী-পুরুষ) বিভক্ত হ'ল এবং
কীভাবে দুই দেশে না থেকে একত্রে রইল। পদ্ম কোথায় প্রস্ফুটিত হয়, পদ্ম
পুস্পের রসে কীভাবে সাধন হয় এবং সহস্রদল হতে রজঃস্রোতের সঙ্গে রসরাজ লীলা
করতে করতে অগ্রসর হয়ে তিন দিন তিন রূপ ধারণ করে শেষে সহজ মানুষ রূপে
আত্মপ্রকাশ করেন।তারপর প্রকৃতি-পুরুষের শৃঙ্গার দ্বারা উর্ধ্বগত হয়ে
স্বস্থানে যেয়ে যুগল হয়ে নিত্যরস লীলা আস্বাদন করেন- বাউল সাধনার মূলভাবটি
মোটামুটি এর মধ্যে ব্যক্ত। এর থেকে বোঝা যায় বা্উল সাধনা নারী-পুরুষের যৌথ
সাধন পদ্ধতি।
অদ্বৈতাচার্য ও নিত্যানন্দ প্রকৃতি- পুরুষ-মিলন-ঘটিত ধর্মসাধনার পৃষ্ঠপোষক
ছিলেন। নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্রের সময় হতে বাউলরা সম্প্রদায় হিসেবে
প্রকাশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গুরু পরম্পরায় ব্যাপ্ত হয় সারা বাংলায়।
বাউল সাধনার তিন স্তর
প্রবর্ত-- ভগবানের নিকট দৈন্য ও গুরুর করুণা প্রার্থনা।
সাধক-- দেহতত্ত্ব, মনের মানুষ, সাধনার স্বরূপের জ্ঞান লাভ।
সিদ্ধ--সাধনার পূর্ণতার স্বরূপ।
ফকির লালন ছিলেন সিদ্ধপুরুষ। বিশাখা ছিলেন লালনের সাধিকা।
লালন শাহ বা লালন ফকির (১৭৭৪- অক্টোবর ১৭, ১৮৯০) লালন শাহ ভারতীয় উপমহাদেশ এর সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক সাধকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি একাধারে বাউল সাধক, বাউল গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। তাঁকে বাউল সম্রাট হিসেবেও অভিহিত করা হয়।
বাউল শিরমনি ফকির লালন শাহ্ ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে কুষ্টিয়া জেলার গড়াই তীরবর্তী ভানাড়া গ্রামের এক হিন্দু কায়েস্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। আবার কেউ কেউ বলেন তাঁর জন্মস্থান যশোরের হরিষপুর এবং তিনি মুসলমান। দাদা বাউল শিরমনি ফকির লালন শাহ্ জন্মের আসল ইতিহাস কি যদি বলতেন?
এটা নিয়ে লালনের বেঁচে থাকার সময় ই অনেক অনেক বিতর্কের ঝড় উঠেছে।
কেউ কেউ মনে করে তিনি হিন্দু- কেউ কেউ মনে করে তিনি মুসলমান। কিন্তু মুসলমান হলে তিনি নিজের ধর্ম লুকিয়ে রাখতেন না। তিনি হিন্দু ছিলেন বলেই হয়ত নিজেকে গোপনে রেখেছেন