"আমি বাংলার গান গাই, আমি বাংলার কথা কই”। আমার এক বন্ধুর মার কথা দিয়েই
শুরু করি। আমার নির্মলা মাসি Pure Vegetarian,তিনি রক্ত একদমই সহ্য করতে
পারেননা, তা মানুষের রক্তই হোক বা কুকুর-বিড়াল-ছাগল-গরুর রক্ত হোক। যখন
মাসির সাথে আমি কোথাও যেতাম, লক্ষ্য করতাম একটু পরপর মাসি মুখে আঁচল দিত আর
রাস্তার অন্যপাশে তাকিয়ে থাকতো, আমি বুঝতাম না কেন। একদিন আমি মাসিকে
জিজ্ঞাসা করেই বসলাম, কেন মাসি এমন কর? মাসি কিছুক্ষণ
আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, আসহায় সে দৃষ্টি, তারপর বলল, "বাবারে, রাস্তার
যেখানে সেখানে কসায়ের দোকান, জঘন্য ভাবে মাংস গুলো ঝুলিয়ে রাখে, রাক্তের
মাখা মাখি, আমি সহ্য করতে পারি না, আমার ভয় হয় ।”আমার আর কিছু জিজ্ঞাসার
থাকে না।
দেশের বাইরে থাকার কল্যাণে বেশকিছু বড় শহর দেখার ভাগ্য আমার হয়েছে, মিশেছি
বিভিন্ন দেশের মানুষের সাথে, তাদের সাথে কথা বলেছি, কিন্তু কোথাও
শুনিনাই,দেখিনাই এইভাবে প্রকাশে রাস্তার ওপর পশু হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখে,
এইটা কি মানবতা নাকি পাশবিকতা বুঝতে পারি না। আমরা হিন্দুরা হচ্ছি
তৃণভোজী(গরুর সাথে তুলনা করা যেতে পারে), তাই আমি জোর দিয়ে বলতে পারি
আমাদের মাংসের চাইতে এখন পর্যন্ত সবজি বেশী পছন্দ(যদিও পছন্দের পরিবর্তন
হচ্ছে, চিরকাল তো আর একরকম থাকতে পারি না), তা হোক, যার যা ইচ্ছে তাই খাবে,
শাস্ত্র কি বলে তা মানা-না মানা নিয়ে আমি কাউকে কিছু বলতে চাইনা। অন্যদিকে
আমাদের সঙ্খাগুরু ভাইয়েরা হচ্ছেন Pure মাংসাশী, তাই প্রতিটি রাস্তার মোড়ে,
অলিতে গলিতে কসাইখানা এখন যেন নাগরিক অধিকারের মধ্যে পরে গেছে। তাদের মুখে
আবার হালাল ছাড়া কিছু রোচে না, তাই বিসমিল্লা বলে রাস্তার মধ্যে পশু জবাই
না করলে তারা সে মাংস খাবে কেন ! সকল উন্নত দেশ গুলোতে পশু হত্যার কাজটা
করা হয় লোক আড়ালে, কিন্তু আমার সোনার বাংলা সহ সকল মুসলিম প্রধান দেশে এই
কাজটা করাহয় জন সম্মুখে, যেন অনেক বড় বীরত্বের কাজ এইটা, আমাদের চোখে
আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আজ গরু ঝুলাই রাখছি, কাল তোদের ঝুলিয়ে রাখবো।
সকালে যখন স্কুলে যেতাম, প্রতিদিন দেখতাম রাস্তার দুইপাশে সুন্দর সুন্দর
কসায়ের দোকানে কাটা গরুর মাথা গুলকে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে, কতো সুন্দর
লাগতো। ওদের অসহায় চোখগুলো তখনো খোলা থাকতো, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে যেন
সবাইকে দেখত, দেখত শান্তির ধর্ম তাদের কতো সুন্দর ভাবে শান্তি দিচ্ছে, দেখত
চারপাশের মানুষ গুলো তাদের কাটা মাথার মূল্য কতো দিচ্ছে, আর তাকিয়ে তাকিয়ে
দেখত আমাকে। স্কুল থেকে যখন ফিরতাম তখনো দেখতাম এই কাটা মাথা গুলো তাকিয়েই
আছে, যেন কোন ক্লান্তি নেই তাদের। অনেক সময় স্বপ্ন দেখতাম, আমার চারপাশে
অজস্র কাটা মাথা, আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে, তারপর সব ঝাপসা হয়ে যেত, গরুর কাটা
মাথার পরিবর্তে আমি দেখতাম আমার পরিচিতদের মাথা, মানুষের মাথা, হিন্দুদের
মাথা, সেই একই দৃষ্টি, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
পরিবারের বড়রা আমাদের সবসময় উপদেশ দেন, কখনো সংখ্যাগুরুদের সাথে লাগতে যাবে
না, ওরা একটা থাপ্পর দিলে অন্য গাল এগিয়ে দিবে, কারণ ওদের সবার ঘরে আছে বড়
বড় চাকু-ছোঁড়া, ওরা কাটতে অভস্থ, বড় বড় জন্তু জানোয়ার কেটে ছোট থেকে ওরা
হাত পাকায়, তা হবে হয়ত। কেননা, আমি এখনও পর্যন্ত তো কিছু কাটার কথা বা
সুযোগ কোনটাই পেলাম না। আর তাদের এই কাটার Practice এতটাই ভালো যে, তারা
একে অনে্যর গলা কাটতেও দ্বিধা করে না, ইসলামী দেশ গুলোতে যে পরিমান জবাই
করে মানুষ হত্যা করা হয়, পৃথিবীর অন্য কোথাও এতটা হয়না। Practice makes a
man Perfect বলেও তো একটা কথা আছে তাই নয় কি !
আবার ফিরে যাই আমার রক্তাক্ত রাজপথে, পবিত্র ঈদ-উল-আযহার দিন আমি সাধারনত
বাড়ি থেকে বের হতাম না, ভয় হতো, পবিত্র উৎসর্গের দিন এইটা, যদি কেউ বেশী
সোয়াবের আশাই আমাকেই উৎসর্গ করে দেয়। বিকেলের দিকে কখনো কখনো বের হতাম,
চারিদিকে নাকি খুশীর আমেজ, না, আমি তো তা পেতাম না ! আমি পেতাম এক গভীর
হাহাকার, যে পশুগুলো সেদিন প্রাণ হারিয়েছে তাদের গভীর আর্তনাদ আমি যেন কান
পেতে শুনতে পেতাম, কখনো নদীর পারে গিয়ে বসতাম, আমাদের ছোট নদীর জল সেদিন
রক্তে লাল, যেন রক্তের একটা স্রোত বয়ে যাচ্ছে। মনে মনে গান বেজে উঠত, এক
নদী রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলবো না। ৭১
এর সেদিন এইরকম রক্তের স্রোত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই, গীতিকার মনে হয়
দেখেছিলেন, তবে আমার মনে হয়না সে রক্ত আজকের এই রক্তের মতো এতটা গাঢ় ছিল।