সৌন্দর্য নগরী চট্টগ্রামের পথে পথে হেটে আমি বড় হয়েছি। এখানেই কাটয়েছি আমার ছোটবেলা। এখানেই পুজোর সময় এ পাড়া ও পাড়া ঘুরে ঘুরে কেটেছে আমার আনন্দের দিন গুলো- আজ আপনাদের দেখাতে নিয়ে যাবো সেই চট্টগ্রামের পাড়ায় পাড়ায়- দেখে আসবো অনেক গুলো মন্দির- আসুন তবে ঘুরে আসি-
আদিনাথ মন্দির- মহেষখালী- চট্টগ্রাম
লোককাহিনী
অনুসারে শিবের সাথে স্থানীয় জমিদার হাজী নুর মোহাম্মদ শিকদারের সম্পর্ক
গড়ে উঠে একটি গাভির মাধ্যমে। শিকদার সাহেবের একটি দুগ্ধবতী গাভী ছিল।
গাভীটি কিছুতেই বাড়িতে দুধ দিত না। দুধ
না দেওয়ার কারণ অনুসন্ধান করে তিনি জানতে পারেন যে, গাভীটি প্রতিদিন
পাহাড়ের গভীর জঙ্গলের অভ্যন্তরে একটি পাথরের উপর দাঁড়ালে স্বতঃস্ফুর্তভাবে
সাফেদ দুধে পাথরটি স্নাত হয়। এ কাজ থেকে গাভীকে বিরত রাখতে শিকদার সাহেব
রশি দিয়ে দুধের জন্য গাভীকে বেঁধে রাখেন। কিন্তু শিকদার সাহেবকে ব্যর্থ করে
দিয়ে রশি ছিঁড়ে গাভীটি নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে পাথরটিকে সফেদ দুধে স্নাত
করতে থাকে। এভঅবে
তিনি গাভীকে ওঠার করণীয় কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এবং
স্বপ্নে মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য আদিষ্ট হন। স্বপ্নাদেশ পেয়ে শিকদার সাহেব
একশত একর জমি দান করেন এবং একজন সৼ ব্রাহ্মন দ্বারা কাঁচা ঘরের মন্দির
প্রতিষ্ঠা করেন। সে মন্দিরটি এখন আর নেই। এর পাশেই বর্তমান মন্দির নির্মিত
হয়। এর কিছু দিন পর শিকদার সাহেব পুনরায় স্বপ্নে আদিনাথের পাশে অষ্টভূজা
মন্দির প্রতিষ্ঠা করার জন্য আদিষ্ট হন।
শিবের
শক্তি অষ্টভূজা মুর্তটি নেপাল থেকে আনতে হবে। এক নাগা সন্যাসীর সহায়তায়
নেপাল থেকে পাথরের অষ্টভূজা দূর্গা মূর্তি আনয়ন করে আদিনাথ মন্দিরের
প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।মন্দির প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মহেশখালীর জমিদার হাজী
নূর মোহাম্মদ শিকদার তিনি রামুর জমিদার প্রভাবতী দেবী এবং নেপালের রাজার
পৃষ্টপোষকতায় ও আর্থিক সহযোগিতায় মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কথিত
লোককাহিনী অনুসারে কিংবদন্তীর দ্বীপ মহেশখালিতে শিবের আগমন ঘটে ত্রেতা
যুগে। রাম-রাবণ যুদ্ধের সময় শিবের কৃপা লাভের জন্য রাবণ টমনাক পর্বতে
শিবকে আনতে যান। দেবতাদের অনুরোধে শিব রাবণকে শর্ত দেন যে, বিরতিহীনভাবে
নিয়ে যেতে পারলে শিব লংকায় যেতে রাজী আছেন। শর্ত
মেনে নিয়ে রাবণ শিবকে কাঁধে করে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। পথিমধ্যে রাবণের
প্রস্রাবের বেগ পেলে মৈনাক পাহাড়ে যাত্রা বিরতি এবং শর্ত ভঙ্গের কারণে শিব
মৈনাক পাহাড়ে থেকে যান।
সুপ্রাচীন ধর্মগ্রন্থ রামায়ণের সুন্দরাকাণ্ডের প্রথম সর্গের ৮৭তম শ্লোক
তস্মিন প্লবগশার্দ্ধলে প্লবমানে হণুমতি, ইক্ষাকুকুল মানাথী চিন্তায়ামাস
সাগর, এ রামায়ণে সমুদ্রের মধ্যে টমনাক পর্বতের অবস্থানের কথা বলা হয়েছে।
লোক কাহিনী অনুসারে আদিনাথ মন্দিরে অবস্থিত পাহাড়ের নাম টমনাক। টমনাক
শব্দটি পরিবর্তিত হয়ে মৈনাক-মইসখাল-মইশখালী শব্দে পরিণত হয়েছে বলে অনুমিত
হয়। শিবের অবর নাম মহেশ। সে হিসেবে মহেশখালী নামে ধারণা লোক মুখে শোনা
যায়। তবে প্রথম ধারণার শব্দগুলোর প্রচলন বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন সময়ে দেখা
যায়।
কক্সবাজার জেলার মহেশখালী থানায় অবস্থিত এই শ্রী শ্রী আদিনাত মন্দির
বিশ্বের হিন্দু সম্প্রদায়ের নিকট অন্যতম তীর্থস্থান। তাহা শাস্ত্রীয মতে
কলিযুগের মহাতীর্থ নামে খ্যাত। চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালতের সিভিল স্যুট নং
-০১-১৯১১ ইং মূলে ১৯৪৫ সালে ১৫৮৬/এফ সিভিল রুলে মহামান্য হাইকোর্ট প্রণীত
স্কীম মোতাবেক গঠিত সীতাকুন্ড স্রাইন কমিটি আদিনাথ মন্দিরের সার্বিক
দায়িত্ব পালন করে আসছেন। আদিনাথ মন্দিরে প্রতিদিন প্রধান পুরোহিত দৈনন্দিন পূজা অর্চ্চণা করেন এছাড়াও শিবচতুর্দশীতে বিশেষ পুজা ও উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
তুলসী ধাম- নন্দনকানন- চট্টগ্রাম
মন্দিরের প্রধান ফটকের সিঁড়ি
আশ্রম প্রাঙ্গন
আশ্রমের সন্মুখভাগ
হনুমান মন্দির ও স্বামী অদ্বৈতানন্দজী সমাধি মন্দির
শ্রী শ্রী চট্টেশ্বরী মন্দির- চট্টগ্রাম সবুজ
নীলিমায় ভরা নয়নাভিরাম তিন পাহাড়ের কোনে অবস্থিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের
আদি ঐতিহ্যবাহী তীর্থস্থান 'শ্রী শ্রী চট্টেশ্বরী কালী মায়ের বিগ্রহ
মন্দির। নির্ধারিত পূজা-অর্চনা, আচার-অনুষ্ঠান ছাড়াও প্রায় প্রতিদিন থাকে
ভক্তপ্রাণ দর্শনার্থীর সমাগম। প্রার্থনা করা হয় বিশ্বশান্তির। এই
প্রাচীন মন্দির চট্টেশ্বরী মায়ের নামে মুলত চট্টেশ্বরী রোড নামকরণ হয়।
রোডের পাশে সবুজ শ্যামল পাহাড়ের উপর নিরব শান্ত রূপে চুড়া উঁচু করে
দাঁড়িয়ে ধর্মপ্রাণ এবং নর-নারীকে অনবরত ছায়া বৃত্ত হয়ে ধর্মীয় সুধায় ধর্মের
বার্তা বিলিয়ে যাচ্ছে। পরিচয় বহন করে চলছে সনাতনীর চিরন্তন স্মৃতি।
জনশ্রুতি ও বংশ পরাম্পরা থেকে প্রাপ্ত কথা। আজ হতে প্রায় ৩০০-৩৫০ বছর
পূর্বে আর্য ঋষি যোগী ও সাধু সন্ন্যাসীদের মাধ্যমে শ্রী শ্রী চট্টেশ্বরী
মায়ের আত্বপ্রকাশ ঘটে। স্মরণাতীত কাল ও প্রাক ঐতিহাসিক যুগ হতে বিভিন্ন
ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে আজ অবধি স্বাক্ষী বহন করে টিকে আছে এই অমূল্য
দৃষ্টিনন্দন মায়ের বিগ্রহ ও মন্দির। কথিত আছে চট্টেশ্বরী মায়ের মন্দির
নির্মাণের পূর্বে নাগা সন্ন্যাসীরা ঐ স্থানে ধুনা অর্থাৎ যজ্ঞের বড় বড়
কাস্ট জ্বালিয়ে হোম যজ্ঞ করতেন নিম গাছের তলে ঐ স্থানে চট্টেশ্বরী মায়ের
আত্বপ্রকাশ। পরবর্তীতে স্প্তম ও অষ্টম শতকে ভারত উপমহাদেশে নানা অরাজকতা
শুরু হয় এর প্রভাব পড়ে ধর্মীয় অনুভুতিতে। তখন চট্টগ্রাম জেলায় বোয়ালখালী
থানার সারোয়ারতলী গ্রামে মায়ের সাধক রামসুন্দর শর্মা রাম ঠাকুর অধিকারী
নামে পরিচিত প্রথম নিম কাটের তৈরী মায়ের মুর্তি দিয়ে মায়ের পূজা শুরু
করেন। ঐ মুর্তি তৈরি করেছিলেন খ্রিষানগীর নামে এক মহারাজা। রামঠাকুরের পর
মন্দিরের দায়িত্ব গ্রহন করে তাঁর ছেলে প্রাণকৃষ্ণ অধিকারী। এর পর তাঁর
ছেলে ডাঃ তারাপদ অধিকারী। এভাবে তাদের বংশধরার চট্টেশ্বরী কালী মায়ের
মন্দিরের সেবায়েত হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছে। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা
যুদ্ধের সময় পাকহানাদার বাহিনী মন্দিরের সেবায়েতের বাড়ী, বিগ্রহ ও মন্দির
বিনষ্ট করে ফেলে। এরপর ডাঃ তারাপদ অধিকারী তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের বাণিজ্য
মন্ত্রী তরুণ কান্তি ঘোষ এবং ধর্মপ্রাণ নরনারীর ঐকান্তিক সাহায্য
সহযোগিতায় কলিকাতার বিখ্যাত প্রত্ন শিল্পী গোষ্টি পালের ছেলে শিশুপাল
কর্তৃক নির্মিত কষ্টি পাথরের কালীমূর্তি ও শ্বেত পাথরের শিব ও অন্যান্য
উপকরণসহ বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সাড়ম্বরে পুনঃ নির্মান
করেন।
{লেখা ও ছবির জন্য www.hindupage.org এর কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকলাম}