মূল রচনা: ডব্লিউ. জে. উইলকিনস (হিন্দু মিথোলজি: বৈদিক অ্যান্ড পৌরাণিক থেকে)
অনুবাদ: অর্ণব দত্ত
এই রূপে দেবী শুধুই শিবজায়া। তবে এই রূপেও তিনি কিছু লীলা করেছেন।
পুরাণে হরপার্বতীর যে ছবিগুলি চিত্রিত হয়ে থাকে, তাতে দেখি হয় তাঁরা
প্রেমালাপ করছেন, নয় কৈলাস পর্বতের শিখরে বসে হিন্দু দর্শনের গূঢ় তত্ত্ব
নিয়ে আলোচনা করছেন। আবার মাঝেমধ্যে তাঁরা কলহও করে থাকেন। পার্বতীর গায়ের
রং কালো ছিল বলে একবার শিব তাঁকে উপহাস করেছিলেন। সেই উপহাসে দুঃখিতা হয়ে
পার্বতী কিছুদিনের জন্য স্বামীকে ছেড়ে বনে গিয়ে এক ভয়ানক তপস্যা করলেন।
সেই তপস্যার ফলে ব্রহ্মার বরে তাঁর গায়ের রং হল সোনার মতো; পার্বতী
অভিহিতা হলেন গৌরী নামে। (কেনেডি, "হিন্দু মিথোলজি”, পৃ. ৩৩৪)
শিব ও পার্বতী
"বরাহ পুরাণ”-এ উল্লিখিত একটি গল্পে পার্বতীর জন্মের বিবরণ পাওয়া যায়।
গল্পটি এইরকম: একবার ব্রহ্মা শিবের সঙ্গে দেখা করতে এলেন কৈলাস পর্বতে।
শিব তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন: "হে ব্রহ্মাদেব, কিসের টানে আমার সঙ্গে দেখা
করতে এলেন এখন, সে কথা শীঘ্র বলুন।” ব্রহ্মা উত্তর দিলেন, "অন্ধক নামে এক
পরাক্রমশালী অসুর আছে। তার অত্যাচারে অতিষ্ট দেবগণ এসেছিলেন আমার কাছে
অভিযোগ জানাতে। আমি এসেছি তাঁদের অভিযোগ সম্পর্কে আপনাকে অবহিত করতে।
ব্রহ্মা চাইলেন শিবের পানে। শিব ধ্যানযোগে বিষ্ণুকে আনলেন ডেকে। তিন দেবতা
একে অপরের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। "তাঁদের নীলোৎপল-তুল্য নীলাভ জ্যোতির্ময়
দৃষ্টি থেকে এক দিব্য কুমারীর জন্ম হল। রত্নভূষিতা সেই কন্যা ব্রহ্মা,
বিষ্ণু ও শিবকে প্রণাম করলেন। তাঁরা কন্যাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তিনি কে; আর
কেনই বা তিনি নিজেকে সাদা, লাল ও কালো – এই তিন রঙে বিভক্ত করে রেখেছেন।
শুনে দেবী বললেন, "আপনাদেরই দৃষ্টি থেকে উৎপন্না আমি। আপনারা কি আপনাদের
শক্তি সম্পর্কে অবহিত নন?” ব্রহ্মা তখন তাঁর স্তব করে বললেন, "আপনি হবেন
ত্রিকালেশ্বরী জগদ্ধাত্রী। নানা রূপে পূজিতা হবেন আপনি। কিন্তু হে দেবী,
আপনি যে তিন রঙে প্রকাশিত হচ্ছেন, সেই তিন রঙে স্বীয় সত্ত্বাকে বিভাজিত
করুন।” ব্রহ্মার কথামতো দেবী নিজেকে তিন অংশে বিভাজিত করলেন; একটি
শ্বেতবর্ণ, একটি রক্তবর্ণ ও একটি কৃষ্ণবর্ণ সত্ত্বা। শ্বেতবর্ণ সত্ত্বাটি
হলেন” সরস্বতী; তিনি প্রিয়দর্শনা ও মঙ্গলরূপিণী; তিনি ব্রহ্মার
সৃষ্টিকর্মে সহযোগিতা করতে লাগলেন। রক্তবর্ণ সত্ত্বাটি হলেন বিষ্ণুপ্রিয়া
জগদ্ধাত্রী লক্ষ্মী। কৃষ্ণবর্ণ সত্ত্বাটি হলেন পার্বতী; তিনি শিবের গুণাবলি
লাভ করে তাঁরই শক্তি হলেন।” আগের গল্পটিতে বলা হয়েছে, কিভাবে
কৃষ্ণাঙ্গিনী পার্বতী কনকবরণা হয়েছিলেন।
"ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ”-এ (তদেব, পৃ. ৩৩১) পৃথিবীতে উমার পুনরায়
জন্মগ্রহণের বৃত্তান্ত আছে। তিনি তো আত্মাহুতি দিয়ে হলেন সতী। এদিকে
পত্নীর মৃত্যুসংবাদে শিব শোকে হারালেন জ্ঞান। জ্ঞান ফিরতেই ছুটে গেলেন
স্বর্গনদীর তীরে। সেখানে দেখলেন "জপমালা হাতে সাদা পট্টবস্ত্রে শোভিত তাঁর
প্রিয় সতীর মৃতদেহ থেকে ঠিকরে পড়ছে গলিত সোনার মতো দ্যূতি। দেখামাত্র
শোকে উন্মাদবৎ হলেন শিব।” খানিকটা সুস্থ হলে পত্নীর সুন্দর মুখখানির দিকে
অশ্রুপূর্ণ নয়নে তাকিয়ে শোকার্ত কণ্ঠে বললেন: "ওঠো, প্রিয়ে, সতি, ওঠো!
দেখো, আমি এসেছি, আমি শঙ্কর, তোমার স্বামী, আমার দিকে তাকাও। তোমাকে পাশে
নিয়ে আমি সর্বশক্তিমান, সর্বস্রষ্টা, সর্বকামফলপ্রদ; কিন্তু তুমি ছাড়া,
শক্তিরূপে! আমি মৃতের ন্যায় শক্তিহীন, কার্যে অক্ষম: তাহলে কেমন করে,
প্রিয়ে, আমাকে তুমি ছেড়ে যাবে? তোমার হাসি আর তোমার দৃষ্টি অমৃতবৎ মধুর,
আমার শোকার্ত হৃদয় শান্ত কর তোমার মধুর বাক্যের বৃষ্টিতে। অন্যদিন দূর
থেকে দেখেই কত কথা বলো। আজ আমার উপর রাগ করেছ? কথা বলছ না কেন? তাই তো আমি
দুঃখ পাচ্ছি? হৃদয়েশ্বরি, জাগো! বিশ্বজননী, জাগো! আমাকে এখানে কাঁদতে দেখে
তোমার ভাল লাগছে? সুন্দরি! তুমি মরতে পারো না। সতি, আমাকে যেমন পূজা করো,
তেমন করছ না কেন? আমার কথা শুনছ না কেন? বিবাহের সময় কি শপথ করেছিলে, তা
কি বিস্মৃত হয়েছ?”
"এই কথা বলে সতীর প্রাণহীন দেহটি তুলে ধরলেন শিব। বিচ্ছেদশোকে চেপে
ধরলেন তাঁকে বুকে। চুম্বন করলেন বারংবার। এমন করে কতবার সতীকে আলিঙ্গন
করেছিলেন তিনি। সেই সব ছবি তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। শোকে তিনি
পাগল হয়ে গেলেন। পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন সপ্তদ্বীপ। শেষে ক্লান্ত ও
শোকাচ্ছন্ন হয়ে বসে পড়লেন একটি বটবৃক্ষের তলায়। শিবের এহেন আচরণ দেখে
দেবতারা আশ্চর্য হয়ে গেলেন। শিব যেখানে বসেছিলেন, ব্রহ্মা ও বিষ্ণুকে
সঙ্গে তাঁরা নিয়ে গেলেন সেইখানে। শিবের মাথাটি নিজের বুকে চেপে ধরে
উচ্চৈস্বরে কাঁদলেন বিষ্ণুও। খানিকবাদে বন্ধুকে উৎসাহ দিতে বললেন, "হে শিব!
শান্ত হও। যা বলি শোনো। সতীকে তুমি ফিরে পাবে। মনে রেখো, শিব ও সতী
অবিচ্ছেদ্য। যেমন অবিচ্ছেদ্য জল ও তার শীতলতা, যেমন অবিচ্ছেদ্য আগুন আর
আগুনের তাপ, যেমন অবিচ্ছেদ্য পৃথিবী ও তার গন্ধ, যেমন অবিচ্ছেদ্য সূর্য ও
তার দীপ্তি!”
"এই কথা শুনে, শিব অশ্রুবিধৌত অর্ধনিমিত চোখ খুলে চাইলেন। বললেন, "হে
সুন্দরের প্রতিমূর্তি! কে তুমি? তোমার সঙ্গে এরা কারা? আমি কে? আমার
সঙ্গীরা সব কই? তোমরা কোথায় যাচ্ছ? আমি কোথায়? কোথায়ই বা যাচ্ছি?” শিবের
মুখে এমনতরো কথা শুনে বিষ্ণুর বুক ফেটে গেল। তাঁর চোখের জল শিবের চোখের
জলের সঙ্গে মিশে সৃষ্টি হল এক হ্রদের। সেই হ্রদ হল এক পবিত্র তীর্থ। অনন্তর
শিবকে শান্ত করলেন বিষ্ণু। শিব দেখলেন এক রত্নখচিত রথে বহুমূল্য বসন ও
ভূষণে শোভিতা এবং বহুসখীপরিবৃতা সতী তাঁর সুন্দর মুখমণ্ডলে মধুর হাসিটি
নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন সম্মুখে। শিবের বিচ্ছেদব্যথা হল দূর। আনন্দে তাঁর
হৃদয় হল পরিপূর্ণ। সতী তাঁকে সম্বোধন করে বললেন: ‘মহাদেব! হৃদয়েশ্বর!
শান্ত হও। যে রূপেই আমি বিরাজ করি না কেন, তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারব
না আমি। তোমার পত্নী হবার উদ্দেশ্যে তাই আবার আমি জন্মেছি হিমালয়ের
কন্যারূপে। অতএব আমার বিচ্ছেদে আর শোক করো না।’ এই কথা বলে শিবকে সান্ত্বনা
দিয়ে সতী অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
শিবলিঙ্গ পূজা করছেন পার্বতী
একই পুরাণের অন্য একটি অধ্যায়ে আমরা তাঁদের পুনর্মিলনেরও বর্ণনা পাই।
(তদেব, পৃ. ৩৩৪) "হিমালয়ের পত্নী মেনকার গর্ভে শীঘ্রই জন্ম নিলেন সতী।
এদিকে সতীর চিতা থেকে অস্থি ও ভষ্মাবশেষ সংগ্রহ করে আনলেন শিব। অস্থির মালা
করে পরলেন গলায় আর অঙ্গে মাখলেন সেই চিতাভষ্ম। এইভাবে প্রিয়তমা পত্নীর
কথা স্মরণে রাখলেন তিনি।
এর কিছুকালের মধ্যেই সতী মেনকার কন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করলেন। সকল
রূপেগুণে লোকশ্রেষ্ঠা এই কন্যা হিমালয়ের গৃহে বাড়তে লাগলেন চন্দ্রকলার
মতো। শৈশবে তিনি একটি দিব্যবাণী শুনেছিলেন, ‘কঠোর তপস্যা করো। তবেই শিবকে
পতিরূপে পাবে। অন্যথায় তাঁকে পাওয়ার আশা নেই।’ যৌবনগর্বা পার্বতী এই
দৈববাণী শুনে অবজ্ঞাভরে হেসেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, ‘তিনি তো পূর্বজন্মে
আমাকে হারিয়ে কত শোক করেছিলেন। জন্মান্তরে এসেছি বলে কি তিনি আমাকে
পত্নীরূপে গ্রহণ করবেন না? বিধি যাঁদের স্বামী-স্ত্রী রূপেই গড়েছেন, তাদের
মিলন কি না হয়ে থাকার জো আছে?’ নিজের রূপ-যৌবন সম্পর্কে নিঃসংশয় পার্বতী
ভাবতেন, তাঁর নাম শোনা মাত্র শিব তাঁকে পাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠবেন।
তাই প্রথমে আর তপস্যাই করলেন না পার্বতী। দিনরাত সখীদের নিয়ে মত্ত রইলেন
খেলাধূলায়।” যদিও আশাহত হতে তাঁর সময় লাগল না। স্বামীর সঙ্গে মিলিত হতে
তাঁকে কঠোর তপস্যা করতে হল। দেবতাদের উদ্যোগে কামদেব তাঁকে সাহায্য করতে
গেলেন। পার্বতী যখন শিবের সামনে বসে তপস্যারত সেই সময় কামদেব ধ্যানমগ্ন
মহাদেবকে নিজের বাণে বিদ্ধ করলেন। এহেন মধ্যস্থতায় শিব মোটেই খুশি হলেন
না। কামদেবকে পুরস্কৃত করলেন তৃতীয় নয়নের আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে,
সেই গল্প আমরা স্থানান্তরে শুনেছি।
উপরে যে পুরাণের কথা বলা হল, তার তুলনায় আধুনিক কালের একটি ধর্মগ্রন্থ
থেকে একটি কিংবদন্তি বাংলায় বহুল প্রচলিত। গল্পটি এই রকম:— শিব সতীর দেহ
কাঁধে তুলে নিয়ে পাগলের মতো নৃত্য শুরু করলেন। তাঁর পদভরে পৃথিবী টলমল করে
উঠল। বিষ্ণু দেখলেন জগৎ-সংসার ধ্বংস হয়ে যায় প্রায়। তা তো আর তিনি হতে
দিতে পারেন না। তাই তিনি নিজের সুদর্শন চক্রটি ছুঁড়ে সতীর দেহ একান্ন
টুকরো করে ফেললেন। টুকরোগুলি পড়ল ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় পড়ল। যেখানেই
টুকরোগুলি পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করল, সেইখানটিই হয়ে উঠল একটি পবিত্র পীঠ।
সেখানে স্থাপিত হল দেবীর মূর্তি। গড়ে উঠল মন্দির। আজও সেই সব মন্দিরে লোকে
যায় তীর্থ করতে। কলকাতার কাছে কালীঘাট এইরকমই একটি পীঠস্থান। কথিত আছে,
এখানে সতীর বাঁ পা পড়েছিল। অন্যান্য পীঠেও সতীর কোনো না কোনো অঙ্গের
প্রস্তরীভূত রূপ আজও বিদ্যমান বলে লোকের বিশ্বাস।
পার্বতীর ছবি আঁকা হয় এক সুন্দরী নারীর বেশে। তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ
অ-মানুষী নয়। তবে তিনি কয়েকটি অলৌকিক লীলা করেছেন। দুর্গা, কালী ইত্যাদি
রূপেও তিনি তাঁর দিব্যলীলার সাক্ষর রেখেছেন। এই রূপগুলি পার্বতীর রূপটির
চেয়ে অনেকটাই আলাদা। তাই মনে হয়, আগে এঁরা ছিলেন পৃথক দেবী, অধুনা তাঁদের
পার্বতীর সঙ্গে একীভূত করা হয়েছে।
(কালীঘাট পটচিত্রগুলি মূল গ্রন্থে ব্যবহৃত)
|