রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা
অদ্বৈত
আশ্রম, মায়াবতী, রামকৃষ্ণ মঠের একটি শাখা, প্রতিষ্ঠাকাল মার্চ ১৯, ১৮৯৯,
পরবর্তীতে স্বামী বিবেকানন্দের অনেক লেখা প্রকাশ করে, বর্তমানে "প্রবুদ্ধ
ভারত" সাময়িকী প্রকাশ করে
১৮৯৭ সালের ১লা মে কলকাতায়
বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠা করেন ধর্ম প্রচারের জন্য সংগঠন "রামকৃষ্ণ মঠ" এবং
সামাজিক কাজের জন্য সংগঠন "রামকৃষ্ণ মিশন"।এটি ছিল শিক্ষামূলক, সাংস্কৃতিক, চিকিৎসা-সংক্রান্ত এবং দাতব্য কাজের মধ্য
দিয়ে জনগণকে সাহায্য করার এক সামাজিক-ধর্মীয় আন্দোলনের প্রারম্ভ। রামকৃষ্ণ মিশনের আদর্শের ভিত্তি হচ্ছে কর্ম যোগ।তাঁর দ্বারা দুটি মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যার মধ্যে কলকাতার নিকট বেলুড়ের
মঠটি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের হেডকোয়ার্টার করা হয়েছিল এবং অন্যটি হিমালয়ের
মায়াবতীতে আলমোরার নিকটে অদ্বৈত আশ্রম নামে পরিচিত এবং পরে তৃতীয় মঠটি মাদ্রাজে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ইংরেজীতে প্রবুদ্ধ ভারত ও বাংলায় উদ্বোধন নামে দুটি সাময়িকী চালু করা হয়েছিল। একই বছর মুর্শিদাবাদ জেলায় স্বামী দুর্ভিক্ষের জন্য অখন্ডানন্দ কর্তৃক ত্রাণ কাজ চালু করা হয়েছিল।
১৮৯৩ সালে পাশ্চাত্যে স্বামীজির প্রথম ভ্রমণের সময় যখন তারা একত্রে ইয়োকাহামা থেকে শিকাগো
যাত্রা করেছিলেন তখন বিবেকানন্দ স্যার জামশেদজী টাটাকে একটি গবেষণা ও
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। আনুমানিক এ সময়ে
স্বামীজি টাটার প্রতিষ্ঠিত "বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান" এর প্রধান হবার
অনুরোধ সম্বলিত একটি চিঠি পান। কিন্ত্তু বিবেকানন্দ প্রস্তাবটি
প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে সেটি তাঁর আধ্যাত্মিক আগ্রহের সাথে
সংঘাতপূর্ণ।
তিনি পরে পুনঃসংস্কারকৃত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পক্ষের আর্য সমাজ ও গোঁড়া হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পক্ষের সনাতনপন্থীদের মধ্যে ঐক্যতান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাঞ্জাব ভ্রমণ করেন। রাওয়ালপিন্ডীতে তিনি আর্য সমাজবাদী ও মুসলিমদের মধ্যকার সক্রিয় বিরোধ নির্মূল করার পদ্ধতি সম্পর্কে পরামর্শ দেন। তাঁর লাহোর
ভ্রমণ স্মরণীয় তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতার জন্য এবং একজন গণিতের অধ্যাপক তীর্থ
রাম গোস্বামীর সাথে তাঁর সম্পৃক্ততার জন্য যে অধ্যাপক পরে স্বামী রাম
তীর্থ নামে সন্ন্যাসজীবন গ্রহণ করেন এবং ভারতে ও আমেরিকায় বেদান্ত প্রচার
করেন। তিনি দিল্লী এবং খেতরীসহ অন্যান্য জায়গায়ও ভ্রমণ করেন এবং ১৮৯৬ সালের জানুয়ারীতে কলকাতায় ফিরে আসেন। পরবর্তী কয়েক মাস তিনি মঠের কাজ সংহত করতে এবং শিষ্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অতিবাহিত করেন।
দ্বিতীয় পাশ্চাত্য ভ্রমণ
তাঁর ভগ্ন স্বাস্থ্য সত্ত্বেও তিনি পুনরায় ১৮৯৯ সালের জুন মাসে পাশ্চাত্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন সিস্টার নিবেদিতা এবং স্বামী তুরিয়ানন্দ। তিনি স্বল্প সময় ইংল্যান্ডে অবস্থান করে তারপর আমেরিকায় যান। তাঁর এ ভ্রমণয়াকালে তিনি সানফ্রান্সিসকো ও নিউইয়র্কে
বেদান্ত সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এক সহৃদয় আমেরিকান ভক্তের নিকট
থেকে পাওয়া ১৬০-একর জমিতে (০.৬৫ বর্গকি.মি.) ক্যালিফোর্ণিয়ায় শান্তি আশ্রমও প্রতিষ্ঠা করেন।পরে তিনি ১৯০০ সালে প্যারিসে ধর্ম মহাসভায় যোগ দেন। লিঙ্গ পূজা ও গীতার
যথার্থতা সম্পর্কিত বিবেকানন্দের পান্ডিত্যপূর্ণ প্রকাশের জন্য প্যারিস
বক্তৃতা স্মরণীয়। প্যারিস থেকে স্বল্প সময়ের জন্য তিনি ভ্রমণ করেন ব্রিটানি, ভিয়েনা, ইস্তান্বুল, এথেন্স এবং মিশর। এ সময়ের বেশীর ভাগ অংশে তিনি ছিলেন বিখ্যাত চিন্তাবিদ জুলস বয়েসের অতিথি।তিনি ১৯০০ সালের ২৪শে অক্টোবর প্যারিস ত্যাগ করেন এবং একই সালের ৯ই ডিসেম্বর বেলুড় মঠে পৌঁছান।
শেষ জীবন
বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দ মন্দির, বিবেকানন্দকে দাহ করার স্থানে
বিবেকানন্দ কিছু দিন মায়াবতীর অদ্বৈত আশ্রমে এবং পরে বেলুড় মঠে
অতিবাহিত করেন। অতঃপর শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বেলুড় মঠে অবস্থান করে
রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের কাজ এবং ইংল্যান্ড ও আমেরিকার কাজ দেখাশোনা করে
অতিবাহিত করেন। গোয়ালিয়রের মহারাজাসহ এ বছরগুলিতে হাজার হাজার দর্শক
তাঁকে দেখতে আসেন। ১৯০১ সালের ডিসেম্বরে তাঁকে দেখতে আসেন লোকমান্য তিলকসহ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের
নেতৃস্থানীয়রা। জাপানের ধর্ম মহাসভায় যোগ দেয়ার জন্য তিনি ১৯০১ সালের
ডিসেম্বরে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন, কিন্ত্তু তাঁর ভগ্ন স্বাস্থ্য সেটি অসম্ভব
করে তোলে। তাঁর শেষ দিনগুলিতে তিনি বোধগয়া ও বারাণসী তীর্থ করেন।
তাঁর
ভ্রমণসমূহ, উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতাদান, ব্যক্তিগত আলোচনা এবং চিঠিপত্রের
আদান-প্রদান তাঁর স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করেছিল। তিনি
হাঁপানি, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য শারীরীক অসুখে ভুগছিলেন।
তাঁর দেহ ত্যাগের কিছুদিন পূর্বে তাঁকে ইচ্ছাকৃতভাবে বর্ষপঞ্জি/পঞ্জিকা
পড়তে দেখা যেত। তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার তিনি দিন পূর্বে তাঁকে দাহ
করার স্থান দেখিয়ে দেন-যে স্থানে বর্তমানে তাঁর স্মৃতিতে একটি মন্দির
দাঁড়িয়ে আছে। তিনি কতিপয় লোকের কাছে মন্তব্য করেছিলেন যে তিনি চল্লিশ
বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচবেন না।
তাঁর দেহ ত্যাগ করার দিন তিনি বেলুড় মঠে সকালে কিছু ছাত্রকে শুক্লা-যজুর্বেদ শেখান। তিনি ভ্রাতা-শিষ্য স্বামী প্রেমানন্দের সাথে হাটেন এবং তাকে রামকৃষ্ণ মঠের
ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নির্দেশনা দেন। বিবেকানন্দ ধ্যান করার সময় ১৯০২ সালের
৪ঠা জুলাই রাত ৯টা ১০ মিনিটে দেহ ত্যাগ করেন। তাঁর শিষ্যদের মতে এটা ছিল মহাসমাধি। পরবর্তীতে তাঁর শিষ্যগণ লিপিবদ্ধ করেন যে তারা স্বামীজির নাসারন্ধ্র, তাঁর মুখ এবং চোখে "সামান্য রক্ত" লক্ষ্য করেছেন।
ডাক্তাররা মন্তব্য করেন যে এটি হয়েছে তাঁর মস্তিষ্কে একটি রক্তনালী ফেটে
যাবার কারণে, কিন্ত্তু তারা মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বের করতে পারেননি। তাঁর
শিষ্যদের মতানুসারে ব্রহ্মরন্ধ্র-মস্তিষ্কের চূড়ার রন্ধ্র-অবশ্যই ফেটে থাকবে যখন তিনি মহাসমাধি অর্জন করেছিলেন। বিবেকানন্দ তাঁর চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত বেচে না থাকার তাঁর নিজের ভবিষ্যৎবাণী পূরণ করেছিলেন।
শিক্ষা ও দর্শন
স্বামী
বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন যে আদি শঙ্করের ভাষ্যের ভিত্তিতে বেদান্ত দর্শনে
হিন্দু ধর্মের সারাংশ সবচেয়ে ভালভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি
নিম্নলিখিতভাবে বেদান্তের শিক্ষাসমূহের সারসংক্ষেপ করেন,
- প্রত্যেক আত্মাই সম্ভাব্যরুপে ঐশ্বরিক/দেবসুলভ।
- লক্ষ্য হচ্ছে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের দ্বারা এ দেবত্বকে সুষ্পষ্টভাবে দেখানো।
- কর্ম, বা পূজা, বা মন নিয়ন্ত্রণ, বা দর্শন - একটির দ্বারা, বা অধিকের দ্বারা, বা এ সকলগুলির দ্বারা এটি কর - এবং মুক্ত হ্ও।
- এটি
হচ্ছে ধর্মের সমগ্রতা। মতবাদ, বা গোঁড়া মতবাদ, বা ধর্মীয় আচার, বা
গ্রন্থ, বা মন্দির, বা মূর্তি হচ্ছে গৌণ খুঁটিনাটি বিষয় ছাড়া কিছুই নয়।
- যতক্ষণ
পর্যন্ত আমার দেশের একটি কুকুরও ক্ষুধার্ত, আমার সমগ্র ধর্মকে একে
খাওয়াতে হবে এবং এর সেবা করতে হবে, তা না করে অন্য যাই করা হোক না কেন তার
সবই অধার্মিক।
- জেগে ওঠো, সচেতন হও এবং লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত থেমো না।
- শিক্ষা হচ্ছে মানুষের মধ্যে ইতোমধ্যে থাকা উৎকর্ষের প্রকাশ।
- ধর্ম হচ্ছে মানুষের মধ্যে ইতোমধ্যে থাকা দেবত্বের প্রকাশ।
- মানুষের সেবা করা হচ্ছে ঈশ্বরের সেবা করা।
বিবেকানন্দের মতানুসারে, রামকৃষ্ণ থেকে পাওয়া তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে "জীব হচ্ছে শিব"। এটি তাঁর মন্ত্রে পরিণত হয়, এবং দরিদ্র নারায়ণ সেবার
ধারণা উদ্ভাবন করেন-(দরিদ্র) মানুষের মধ্যে এবং মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের সেবা।
"যদি সত্যিই সকল ইন্দ্রিয়গোচর বস্ত্তু বা বিষয়ের নিমিত্তে ব্রহ্মের একতা
থাকে, তাহলে কিসের ভিত্তিতে আমরা অন্যদের থেকে আমাদের ভাল বা মন্দ বিবেচনা
করব?" - এ প্রশ্ন তিনি নিজেকে করতেন। শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছান
যে এ পার্থক্য বা স্বাতন্ত্র্যসমূহ একতা/সমগ্রতার মধ্যস্থিত আলোর শূন্যতায়
মিলিয়ে যায় যখন ভক্ত মোক্ষে পৌঁছেন। তখন এ একতা/সমগ্রতা সম্পর্কে অসচেতন
"ব্যক্তিদের" জন্য সমবেদনা এবং তাদের সাহায্য করার দৃঢসংকল্প জাগ্রত হয়।
বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল রাত্রে, কন্যাকুমারী, তামিলনাড়ু
স্বামী
বিবেকানন্দ বেদান্তের সে শাখার অঙ্গীভূত বলে নিজেকে মনে করতেন যে শাখার
মতে কেউই প্রকৃতভাবে মুক্ত হতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাদের সকলেই
মুক্ত হচ্ছি। এমনকি ব্যক্তিগত পাপমোচনের আকাঙ্খা ত্যাগ করতে হবে, এবং
শুধুমাত্র অন্যদের পাপমোচনের জন্য ক্লান্তিহীন কর্ম আলোকিত মানুষের প্রকৃত
চিহ্ন। আত্মনো মোক্ষার্থম জগতহিতায় চ (নিজের পাপমোচনের জন্য এবং জগতের মঙ্গলের জন্য) - এ নীতিতে তিনি শ্রী রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করেন।
বিবেকানন্দ
তাঁর শিষ্যদের পবিত্র, অস্বার্থপর হতে এবং শ্রদ্ধা/বিশ্বাস যাতে থাকে সে
উপদেশ দেন। তিনি ব্রহ্মাচর্য চর্চা করতে উপদেশ দেন। তাঁর শৈশবের বন্ধু
প্রিয় নাথ সিনহার সাথে এক আলোচনায় তিনি তার দৈহিক ও মানসিক শক্তি এবং
বাগ্মিতার উৎস/কারণ হিসেবে ব্রহ্মাচর্য চর্চাকে অভিহিত করেন।
বিবেকানন্দ প্যারাসাইকোলজি এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের আবির্ভূত ক্ষেত্রকে সমর্থন করেননি (এর এক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় তাঁর এ বক্তৃতায় মানুষ নিজেই তাঁর ভাগ্য নির্মাতা, সম্পূর্ণ কর্ম, ভলিউম ৮, নোটস অফ ক্লাস টকস এবং বক্তৃতাসমূহ) এ কারণে যে তাঁর মতে এ ধরণের কৌতুহল আধ্যাত্মিক অগ্রগতিকে সাহায্য করেনা বরং তা ব্যাহত করে।
প্রভাব
বিংশ
শতাব্দীর কয়েকজন ভারতীয় নেতা এবং দার্শনিক বিবেকানন্দের প্রভাবকে
স্বীকার করেছেন। স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্ণর জেনারেল চক্রবর্তী
রাজাগোপালচারী একদা লক্ষ্য করেন যে "বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্মকে বাঁচিয়েছেন,
ভারতকে বাঁচিয়েছেন।" সুভাষ চন্দ্র বোসের মতে বিবেকানন্দ "আধুনিক ভারতের নির্মাতা" এবং মহাত্মা গান্ধীর
জন্য, বিবেকানন্দের প্রভাব বাড়িয়েছে তাঁর "দেশের জন্য ভালবাসা কয়েক
হাজার গুণ।" তাঁকে স্মরণ করতে ভারতে ১২ই জানুয়ারী তাঁর জন্মদিনে ভারতীয়
যুব দিবস পালিত হয়। এটা ছিল ভারতীয় যুবকদের সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের
সবচেয়ে যথাযথ ইঙ্গিত এবং কিভাবে আধুনিক জগতে সম্পূর্ণভাবে অংশগ্রহণের
সাথে সাথে তাদের প্রাচীন মূল্যবোধসমূহ ধরে রাখতে লড়াই করা উচিত।
স্বামী
বিবেকানন্দ ভারতের স্বাধীনতা লড়াইয়ের আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছেন বলে
ব্যাপকভাবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর লেখাসমূহ সুভাষ চন্দ্র বোস, অরবিন্দ ঘোষ এবং বাঘা যতীনসহ
স্বাধীনতা যোদ্ধাদের এক পুরো প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছিল। বিবেকানন্দ
ছিলেন বিপ্লবী স্বাধীনতা যোদ্ধা ভুপেন্দ্রনাথ দত্তের ভাই। ভারতের স্বাধীনতা
আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব সুভাষ চন্দ্র বোস বলেছিলেন,
আমি
বিবেকানন্দ সম্পর্কে না লিখে পারছি না। এমনকি তাঁর সঙ্গে যারা অন্তরঙ্গ
হবার বিশেষাধিকার পেয়েছে তাদের মধ্যে খুব অল্প কয়েকজনই তাঁকে বুঝতে পারত
বা তাঁর গভীরতা মাপতে পারত। তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল সমৃদ্ধ, সুগভীর,
জটিল...ত্যাগে তিনি বেপরোয়া, কর্মে তিনি বিরতিহীন, ভালবাসায় তিনি
সীমাহীন, জ্ঞানে তিনি প্রগাঢ় ও বিচিত্রগামী, আবেগে তিনি প্রাণোচ্ছ্বল,
আক্রমণে তিনি করুণাহীন তথাপি শিশুর মত সরল, আমাদের পৃথিবীতে তিনি ছিলেন এক
বিরল ব্যক্তিত্ব।
অরবিন্দ ঘোষ বিবেকানন্দকে তাঁর আধ্যাত্মিক বিষয়ে বিজ্ঞ পরামর্শদাতা হিসেবে বিবেচনা করতেন।
বিবেকানন্দ
ছিলেন এক সক্ষম আত্মা যদি কখনও এ ধরণের কিছু থেকে থাকে, মানুষের মধ্যে এক
সিংহ, কিন্ত্তু তাঁর সৃষ্টিশীল ক্ষমতা ও শক্তির যে নিশ্চায়ক কর্ম তিনি
রেখে গেছেন তা আমাদের ধারণায় তুলনায় অযোগ্য। তাঁর প্রভাব এখনও
প্রচন্ডভাবে কাজ করছে বলে আমরা মনে মনে উপলব্ধি করি, আমরা ভালভাবে জানি না
কিভাবে, আমরা ভালভাবে জানি না কোথায়, কোন কিছুতে যার এখনও আকার দেয়া
হয়নি, কিছুটা সিংহসদৃশ, মহিমান্বিত, অন্তর্জ্ঞানী, বৈপ্লবিক উত্থান যা
ভারতের আত্মায় প্রবেশ করেছে এবং আমরা বলি, "লক্ষ করো, বিবেকানন্দ এখনও
তাঁর মাতার আত্মায় বেঁচে আছে এবং তাঁর শিশু-সন্তানদের আত্মায় বেঁচে আছে। —শ্রী অরবিন্দ বৈদিক পত্রিকায়(১৯১৫)
ফরাসী নোবেল বিজয়ী রোমা রোলা লেখেন,
তাঁর
শব্দসমূহ যেন মহৎ সঙ্গীত, বাক্যাংশসমূহ বিটোভেনের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত,
হ্যান্ডলের কোরাসের কুচকাওয়াজের মত সক্রিয় ছন্দময়। আমি তাঁর এ কথাসমূহ
স্পর্শ করতে পারি না, বইয়ের পাতাগুলোর মধ্য দিয়ে সেগুলো ইতস্তত ছড়ানো,
ত্রিশ বছরের দূরত্বে, কোন রোমাঞ্চ গ্রহণ ছাড়াই আমার শরীরের মধ্য দিয়ে এক
বৈদ্যুতিক চোটের মত। এবং যা চোট পাওয়ায়, যা পরিবহন করে, অবশ্যই উৎপন্ন
হয়ে থাকবে যখন সেগুলো নায়কের ঠোঁট থেকে নির্গত হয়েছিল!
বিবেকানন্দ ভারতের উত্তম প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম ভারতীয় বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠায় জামশেদজী টাটাকে
অনুপ্রাণিত করেছিলেন। বিদেশে ম্যাক্স মুলারের সাথে কিছু যোগাযোগ ছিল।
স্বামী বিবেকানন্দের বেদান্ত দর্শনের দ্বারা প্রভাবিতদের মধ্যে অন্যতম
ছিলেন বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলা।
সর্বোপরি
হিন্দুধর্ম বর্ণাশ্রম-প্রথা শাসিত নারীবিদ্বেষী বিশ্বাসের এক ধর্ম -
ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনকারী প্রশাসকদের এ প্রচারণা থেকে মুক্ত করে ভারতের
প্রাচীন শিক্ষাসমূহ পাশ্চাত্যের দর্শক-শ্রোতাদের নিকট এর শুদ্ধতম আকারে
উপস্থাপন করে স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দুদের মধ্যে এক গৌরববোধ পুনরুদ্ধারে
সাহায্য করেন। বস্ত্তত পাশ্চাত্যে তাঁর প্রারম্ভিক আকস্মিক আক্রমণ পরবর্তী
ভারতীয় ধর্মীয় নেতাদের বিশ্বে তাদের নিজেদের চিহ্ন রেখে যাবার পথ
উন্মুক্ত করেছিল, সেই সাথে হিন্দুদের এবং তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যসমূহ
পাশ্চাত্য জগতে প্রবেশের বার্তা ঘোষনা করেছিল।
স্বামী বিবেকানন্দের
ধারণাসমূহ ভারতীয় যুবকদের উপর প্রচুর প্রভাব বিস্তার করেছিল। অনেক
প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররা একত্র হয়ে আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণাসমূহ আলোচনা এবং এ
ধরণের নীতিসমূহ চর্চা ত্বরান্বিত করতে সংঘ গড়ে তুলেছিল। এ ধরণের অনেক সংঘ
তাঁর নাম অবলম্বন/পরিগ্রহণ করেছিল। আই আই টি মাদ্রাজে এ ধরণের একটি গ্রুপের
অস্তিত্ব আছে যা লোকত বিবেকাননন্দ পাঠ চক্র বা বিবেকানন্দ স্টাডি সার্কেল
নামে পরিচিত। বিবেকানন্দ সমিতি নামে আই আই টি কানপুরে এ ধরণের আরেকটি গ্রুপ
আছে। অধিকন্ত্তু বিবেকানন্দের ধারণা ও শিক্ষাসমূহ বিশ্বব্যাপী
প্রতিষ্ঠানসমূহে চর্চিত হয়ে প্রচলিত আছে।
মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন,
"বিবেকানন্দের লেখাসমূহ কারো কাছ থেকে পরিচয় করিয়ে দেবার দরকার নেই। সেগুলোর নিজের অপ্রতিরোধ্য আবেদন আছে।"
বেলুড়
মঠে গান্ধীজিকে বলতে শোনা গেছে যে তাঁর সমস্ত জীবন ছিল বিবেকানন্দের
ধারণাসমূহ কার্যে পরিণত করার প্রচেষ্টা। বিবেকানন্দের মৃত্যুর অনেক বছর পর
নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন,
"তুমি যদি ভারতকে জানতে চাও তবে বিবেকানন্দ পড়। তাঁর সবকিছুই ইতিবাচক, কিছুই নেতিবাচক নয়।"
১৯৯৫
সালের ১১ই নভেম্বর শিকাগোর প্রধানতম সড়কগুলোর একটি মিশিগান এভিনিউর একটি
অংশ আনুষ্ঠানিকভাবে "স্বামী বিবেকানন্দ সড়ক" নামে পুনঃনামকরণ করা হয়েছিল।
বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
যদিও
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনো প্রবন্ধে বিবেকানন্দের সরাসরি উল্লেখ নেই, কবি
রোমা রোলাকে বলেছিলেন, "যদি আপনি ভারতকে জানতে চান, তবে বিবেকানন্দ পড়ুন,
তাঁর মধ্যে সবকিছুই ইতিবাচক এবং কিছুই নেতিবাচক নয়।" এটি বিবেকানন্দের
ব্যপারে ঠাকুর যে উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন তা দেখায়।
বিবেকানন্দের গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সম্পর্কে ঠাকুর একটি কবিতা লেখেন: "রামকৃষ্ণ পরমহংস রামকৃষ্ণ দেবের প্রতি"।
"আপনার
ধ্যানের মধ্যে বিচিত্র সিদ্ধির ঝর্ণার একাধিক গতিপথের পূজা মিলিত হয়েছে।
অসীমের আনন্দের বহুমুখী প্রকাশ একতার সমাধিমন্দিরের আকার দিয়েছে আপনার
জীবনে যেখানে দূর ও নিকট হতে অভিবাদন আগত হয় যাতে আমি আমার নিজেরটাও যুক্ত
করি।"
রামকৃষ্ণ মিশন আয়োজিত রামকৃষ্ণের শততম বার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে ঠাকুর ছিলেন প্রধান অতিথি এবং তিনি রামকৃষ্ণের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ১৯৩৭ সালের ধর্ম মহাসভায় যেটি কলকাতার রামকৃষ্ণ মিশনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে ঠাকুর রামকৃষ্ণকে
(যার জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছিল) একজন মহান ঋষি হিসেবে স্বীকার করেন
কারণ "তাঁর আত্মার বিশালতা আপাতদৃষ্টিতে বিরোধী সাধনার প্রণালীসমূহ উপলব্ধি
করতে পারত, এবং কারণ তাঁর আত্মার সরলতা মুখ্য পুরোহিত ও পন্ডিতদের আড়ম্বর
এবং ক্লান্তিকর ও অপ্রয়োজনীয় পন্ডিতপনাকে সকল সময়ের জন্য লজ্জা দিত।"
কর্ম
বিবেকানন্দ প্রচুর পরিমাণ দার্শনিক কাজ রেখে গেছেন। তাঁর চার যোগের
(রাজযোগ, কর্মযোগ, ভক্তিযোগ এবং জ্ঞানযোগ) উপর গ্রন্থসমূহ (বিশ্বের
বিভিন্ন স্থানে দেয়া বক্তৃতার সংকলন) খুবই প্রভাবশালী এবং হিন্দু যোগ
চর্চায় আগ্রহী যে কারো জন্য এখনও প্রারম্ভিক গ্রন্থ হিসেবে দেখা হয়। তাঁর
চিঠিসমূহের সাহিত্যিক ও আধ্যাত্মিক মূল্য সুবিদিত। তাঁকে একজন ভাল গায়ক ও
কবি হিসেবেও বিবেচনা করা হতো।
মৃত্যুর পূর্বে তিনি অনেক সঙ্গীত রচনা করেন। তিনি তাঁর শিক্ষাবস্ত্তুতে
হাস্যরস ব্যবহার করতেন এবং রান্নার কাজে পটু ছিলেন। তাঁর ভাষা ছিল সাবলীল।
তাঁর নিজের বাংলা লেখাগুলি এ ঘটনার প্রামাণিক সাক্ষ্য দেয় যে তিনি তাঁর
"উচ্চারিত বা লিখিত" বক্তব্যগুলো বিশ্বাস করতেন - বক্তা বা লেখকের জ্ঞান
প্রদর্শনের চেয়ে বরং শ্রোতা ও পাঠকের কাছে সে বিষয়গুলি সহজবোধ্য করাই ছিল
তাঁর উদ্দেশ্য।
|