হিন্দু আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে দায়ভাগ আইন প্রচলিত।
Principles of Hindu Law by D F Mulla অনুযায়ী Bengal School Governs the
Inheritance of People of Bengal. একাদশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানেশ্বরের
মিতাক্ষরা আইন এবং ত্রয়োদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর কোনো একসময় পণ্ডিত
জীমূতবাহনের দায়ভাগ মতবাদ প্রচলিত হয় বাংলাভাষী হিন্দুদের মধ্যে। ওই
জীমূতবাহন কর্তৃক লিখিত দায়ভাগ মতবাদই আমাদের বাংলাদেশে প্রচলিত হিন্দু
আইন।
ধর্ম সূত্রে লিখিত আছে, 'পিতা রক্ষিত কৌমারে, যৌবনে রক্ষতি ভর্তা,
বার্ধক্যে রক্ষতি পুত্রঃ ন স্ত্রী স্বাতন্ত্রম ইতি।' মনুসংহিতায় নারীরা
সম্পত্তির অধিকারিণী হওয়া সম্পূর্ণ অযোগ্য বিবেচিত হয়েছে।
হিন্দু উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী পুত্র সন্তানের উপস্থিতিতে হিন্দু নারী
কখনোই উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পায় না। স্ত্রীধনসম্পর্কিত আইন অনুযায়ী
যেসব সম্পত্তিতে মহিলারা সম্পূর্ণ স্বত্বের অধিকারিণী, তাকে বলা হয়
'স্ত্রীধন'। একজন অবিবাহিতা নারী বা বিধবা উত্তরাধিকার ব্যতীত অন্য
যেকোনোভাবেই কোনো সম্পত্তি অর্জন করে থাকেন, তা হবে তাঁর absolute (পরম)
স্ত্রীধন। সেই স্ত্রীধন, সেই স্ত্রী যেকোনোভাবে ভোগদখল, হস্তান্তর
যদৃচ্ছাক্রমে করতে পারেন।
The Hindu Women's Right to Property Act 1937 অনুযায়ী হিন্দু মহিলারা যে
সম্পত্তি পায়, তাতে জীবনস্বত্ব পায়। মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে ছেলে থাকলেও
Equal to a son's share cvq, পায়, কিন্তু সেটাও জীবনস্বত্বে। Legal
necessity অনুযায়ী মৃত স্বামীর আত্দার মঙ্গলার্থে বা পিণ্ডদান বা গয়া, কাশী
ইত্যাদি তীর্থে গমন উপলক্ষে সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন।
হিন্দু আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি যদি কোনো পুত্র সন্তান না রেখে শুধু মেয়ে
সন্তান রেখে মারা যান, তবে তাঁর ত্যাজ্য বিত্তে মেয়ে জীবিতকাল পর্যন্ত
জীবনস্বত্বের অধিকারিণী হবেন এবং মেয়ের গর্ভজাত ছেলে বা ছেলেরা ওই মৃত
ব্যক্তির সম্পত্তিতে Absolute right exercise করে মালিক স্বত্বাধিকারী
হবেন। তবে ওই নাতি সাবালকত্বের আগে যদি কোনো সম্পত্তি হস্তান্তরের প্রয়োজন
হবে, তবে Legal necessity অনুযায়ী ওই মহিলা হস্তান্তর করতে পারবেন।
ওই আলোচনায় হিন্দু আইন অনুযায়ী হিন্দু নারীর পৈতৃক সম্পত্তিতে অধিকার নেই,
এটা বলা যায় না। তবে যদৃচ্ছাক্রমে স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করার অধিকার
হিন্দু মহিলার না থাকলেও জীমূতবাহনের দায়ভাগ আইন অনুযায়ী প্রচলিত ব্যবস্থা
এ যাবৎকাল আমাদের দেশে চলমান থাকায় বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হিন্দু
দায়ভাগ আইন সংস্কারের মতো কোনো পরিস্থিতি বাংলাদেশে নেই।
হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের সঙ্গে সঙ্গে এই আইনে এ দেশে প্রচলিত হিন্দু বিবাহ
প্রথা বা আইনটিও পরিবর্তনের বা সংস্কারের ব্যাপারে স্বার্থান্বেষী মহল
উঠেপড়ে লেগেছে বা আমাদের দেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতির কেন্দ্রীয়
সভায় ও শাখাগুলোর বিভিন্ন সভায় পর্যায়ক্রমে আলোচিত হয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত
গৃহীত হয়েছে যে হিন্দু আইনের কোনো সংস্কার বাংলাদেশে প্রয়োজন নেই এবং
প্রায় সব হিন্দুর অভিমত, বর্তমান প্রচলিত হিন্দু আইনের কোনো সংস্কার দরকার
নেই। হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ নেই। হিন্দু ধর্মে জন্মের পর দশবিধ সংস্কার
আছে, বিবাহ ওই দশবিধ সংস্কারের একটি। বিবাহ শব্দের বাংলা অর্থ হলো
বিশেষভাবে বহন করা। অর্থাৎ বিশেষভাবে বহন করার অপর নাম 'বিবাহ'। বিবাহের
উদ্দেশ্য স্বামী-স্ত্রীরূপে পবিত্র জীবনযাপন করে ধর্মাচরণ এবং পুত্রসন্তান
লাভ করা। হিন্দুশাস্ত্রে যা বলা আছে, 'পুত্রার্থে ক্রিয়াতে ভার্যা'।
'পুৎনাম নরকাত য ত্রায়তে স পুত্র'। শাস্ত্রে স্ত্রীকে অর্ধাঙ্গিনী বলা হয়
এবং স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক জন্ম-জন্মান্তরের। হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ
নেই, কিন্তু বিবাহ inseparable এবং এটা কোনো contract নয়, হিন্দু বিবাহ
একটি sacrament বা পবিত্র বন্ধন। হিন্দু বিবাহে অগি্নসাক্ষী করে সপ্তপদী
করে বেদবাক্য উচ্চারণ করে স্বামী-স্ত্রীর ওই বন্ধন গঠিত হয়। বাংলায় ঐক্য
বিবাহের বন্ধনে কন্যা সম্প্রদানের পর বর ও কনে হাতে হাত মিলিয়ে উচ্চারণ করে
থাকে_'যদিদং হৃদয়ং তব, তদিদং হৃদয়ং মম' ইত্যাদি।
সেই বন্ধন একটি উরাড়ৎপব তুচ্ছ ঘটনা বা একটি বা তালাকের নোটিশেই ছিন্ন হয়ে
যাবে হিন্দু ধর্মের ঋক, সাম, যজুঃ, অথর্ব বেদের কোনো মন্ত্রে বা বিধানে তা
নেই। ঋগ্বেদের অনেক সূক্তে নারী ঋষিদের নাম উল্লেখ আছে, যেমন_অপালা, ঘোষা,
সূর্য্যা, লোপামুদ্রা, বিশ্ববারা, ইন্দ্রানী প্রমুখ। তাঁরা কেউ বিবাহ
বন্ধনকে বিচ্ছেদ করার মতো অমঙ্গলজনক মন্ত্র উচ্চারণ করেননি বা ব্যবস্থাপত্র
দেননি। কিন্তু কালের বিবর্তনের ফলে ব্রিটিশ আমলে Act XIX of 1946 Hindu
Married Women's Right to Separate and Maintenance Act, 1946-এ হিন্দু
আইনের এক বিধান অনুযায়ী নিম্নলিখিতভাবে নিতান্ত প্রয়োজনে প্রতিকার পাওয়া
যায়। যেমন :
1. If he is suffering from any loathsome disease not contracted from her;
2. If he is guilty of such cruelty towards her as renders it unsafe or undesirable for her to live with him;
3. If he is guilty of desertion, that is to say of abandoning her without her consent or against her wish;
4. If he marries again;
5. If he ceases to be a Hindu by conversion to another religion;
6. If he kept a concubine in the house or habitually resides with a concubine;
7. For any other justifiable cause;
ওই আইন অনুযায়ী কোনো হিন্দু বিবাহিতা মহিলা প্রয়োজনবোধে স্বামী থেকে
Separation ইত্যাদি চাইতে পারে, এটা হিন্দু আইনের বিধান। কিন্তু কোনো কোনো
এনজিও এবং মহিলা সমিতি হিন্দু আইন সংস্কার করার এবং Divorce প্রথা ভারতের
মতো এবং পাশাপাশি মুসলমান আইনের মতো চালু করতে চায়, সেটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক
এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। চলমান হিন্দু আইন সংস্কার
হোক_এটা এ দেশের বেশির ভাগ হিন্দু চায় না।
এ প্রসঙ্গে কিছু লেখালেখি হয়েছিল পত্রপত্রিকায়, তাতে তৎকালীন মানিকগঞ্জের
জেলা জজ কৃষ্ণা দেবনাথের দুটি লেখা পত্রিকায় দেখেছিলাম, যার শিরোনাম 'কন্যা
তোমার ঠিকানা কী' এবং 'হিন্দু আইন ও নারী, কোথায় ফাঁকি কোথায় বৈষম্য'।
সেখানে তিনি লিখেছিলেন, "আমাদের দেশে হিন্দু আইনের সংশোধনের জন্য একটি
কমিটি গঠন করা হয়। তারা কিছু কাজও করার চেষ্টা করে। কিন্তু এ বিষয়ে সর্বশেষ
চমকটি পাওয়া যায় ২২ জুলাই ২০০০ সালের দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার ১১ পাতার ৬
ও ৭ কলামে উদ্ধৃত বিবরণে। এ বিবরণে পাওয়া যায়, ঢাকা আইনজীবী সমিতি
মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ২১ জুলাই, ২০০০-এর সভায় হিন্দু আইন সংস্কারের উদ্যোগ
বন্ধে সারা দেশে 'প্রতিরোধ কমিটি' গঠন, অবিলম্বে ঢাকার রাজপথে মিছিল ও
প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। সভায় হিন্দু
নেতৃবৃন্দ বলেন, 'অর্পিত সম্পত্তি আইনসহ বিভিন্ন কালো আইনের কারণে এ দেশের
সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দেশ ছেড়ে চলে গেছে। হিন্দু আইন সংস্কার করে বাকিদেরও
দেশত্যাগে বাধ্য করা হবে। কারণ এই আইন সংস্কারের ফলে হিন্দুদের ধারাবাহিক
জীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠবে। সম্পত্তির লোভে হিন্দু মেয়ে বিয়ে বা অপহরণের ঘটনা
বেড়ে যাবে। এমনকি বিবাহিত মহিলাদেরও অপহরণ করে স্বামীকে বিচ্ছেদপত্র
পাঠাতে বাধ্য করা হতে পারে।' জজ আরো লিখেছেন, 'পত্রিকার এ বিষয়টি দেখে এবং
যাঁরা এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন, তাঁদের নাম দেখে কেন জানি মন সায় দিচ্ছিল
না। সংগত কারণেই বক্তব্যদাতাদের একজনকে টেলিফোন করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এ
ধরনের বক্তব্য সত্যিই কি সভায় বলা হয়েছিল, নাকি মিস রিপোর্টিং হয়েছে। উত্তর
এসেছিল, রিপোর্টিং সঠিক।'
এসব অবস্থা বাস্তবে এবং বর্তমান বাংলাদেশের সামাজিক ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, তা
অনেকেই চক্ষু বন্ধ করে কাকের মতো খাদ্য লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে নিজের
পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতো অবস্থায় পড়ে হিন্দু আইন সংস্কারে জন্য লাফালাফি
করছেন, যেটার পরিণামও খুব ভয়াবহ হতে বাধ্য। গত কয়েক বছরে সংখ্যালঘু হিন্দু
পরিবারের বেশ কিছু মেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দুষ্ট, লোভী ছেলে কর্তৃক অপহৃত হয়েছে।
প্রতিকারের জন্য মামলা করতে গেলে সহজে মামলা হয়নি। জেলা প্রশাসনের
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেন-দরবার করে মামলা করতে হয়েছে। এখনো অনেক
অপহৃতা উদ্ধার হয়নি। অপহৃতের আত্দীয়দের কী অবস্থা বুঝতে পারবে কে? কবিতায়
আছে 'কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে, কভু আশীবিষে দংশেনি যারে?' এভাবেই
নারী, বাড়ি, ধন-সম্পত্তি হিন্দুদের হাতছাড়া হয়ে চলেছে অনবরত। সুতরাং দেশের
বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে আর হিন্দু আইনের সংস্কার তো হতেই পারে না, নিজেদের
অস্তিত্ব বজায় রাখার চিন্তা-ভাবনা ও চেষ্টা করা আশু দরকার।
লেখক : আইনজীবী