৪ সেপ্টেম্বর ২০১১ সম্প্রতি একটি পত্রিকার ব্যানার হেডের প্রধান খবরের শিরোনামটি ছিল ‘সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে জামাত’। খবরটি ঐ দিন বাংলাদেশের প্রায় সব কাগজই ছাপে। খবরটির সোর্স ‘উইকিলিকস’। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স নিকোলাস ডিন ২০১০ সালের ৩ জানুয়ারি ‘জামাতে ইসলামী : দ্য টরটয়েজ, নট দ্য হেয়ার’ শিরোনামে ওয়াশিংটনে এই তার বার্তাটি পাঠিয়েছিল। সম্প্রতি উইকিলিকস তা ফাঁস করে দেয়। প্রায় দেড় লাখ নতুন তথ্যের সঙ্গে এ বার্তাটিও গত ৩০ আগস্ট প্রকাশ করেছে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের সাড়া জাগানো ওয়েবসাইট উইকিলিকস। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের জামাতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসন বাড়ানোর মতো স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে জামাত চিন্তিত নয়। আমরা বাংলাদেশকে পরিপূর্ণ ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়েই এগুচ্ছি।’ কারণ তিনি মনে করেন যে, বাংলাদেশের সমস্যাগুলো দূর হবে শুধু ইসলামি রাষ্ট্র বাস্তবায়নের মাধ্যমে। গত সংসদ নির্বাচনে তারা মাত্র ৩টি আসনে জয়ী হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধের অপরাধে ২০১০ সালে গ্রেপ্তার হন জামাতের শীর্ষ ৫ জন নেতা। বিশ্বের অন্য কোনো দেশের ‘জামাতে ইসলামী’ নামের কোনো দলের সঙ্গে আর্থিক, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই বলেও দাবি করেন। ১৯৪১ সালে অবিভিক্ত ভারতে জামাতে-ইসলামী নামের দলটির প্রতিষ্ঠা করেন সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী। দেশভাগের পর মওদুদী পাকিস্তানে হিজরত করেন। পাকিস্তানে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের হত্যার অপরাধে বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে মৃত্যুদ-ে দ-িত হন। কিন্তু সৌদি আরবের হস্তক্ষেপে তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের পর সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে জামাত নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু শেখ মুজিবের হত্যার পর জিয়াউর রহমানের সময়ে দলটি পুনরুজ্জীবিত হয়।
দুই. শুধু মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স নিকোলাস ডিনের তার বার্তার খবর এটা নয় যে জামাতে ইসলামী দলের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালতে একজন খুনি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিলেন। এটা ইতিহাসের কথা যে জামাতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আমির একজন খুনি। তাই অনেকেই জামাতকে খুনির দল বলে মনে করেন। সেটাও সত্যি। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তানের বিচারালয়ে সেটা প্রমাণিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি গণহত্যায় সহযোগী হিসেবে বর্তমানে জামাতের আমির নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদসহ ৫ জন জেলখানায় বিচারের প্রহর গুনছেন। রাজ্জাকের বয়ান মতো ‘নির্বাচনে আসন বাড়ানো স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য’। অর্থাৎ নির্বাচন বা গণতন্ত্র নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। পশ্চিমী আদর্শ হিসেবে মওদুদী বহু আগেই ‘গণতন্ত্র’কে বিসর্জন দিয়েছেন। তাহলে প্রশ্ন তারা ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ বাস্তবায়ন করবেন কী করে? জামাত যে নির্বাচনের মাধ্যমে কোনোদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে পারবে না সে বিষয়ে তাদের কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের লক্ষ্য ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা। কিভাবে? একাত্তরের মতো? লাখ লাখ মানুষ হত্যা করেই তারা ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। জামাত গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। তারা ‘খুনির’ দল। সন্ত্রাসের মাধ্যমেই রাষ্ট্র দখল করতে চায়। তারা মনে করে একমাত্র ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের সব সমস্যা দূর হবে। তারা চল্লিশ বছর আগের ইতিহাস ভুলে গেছে। ‘ইসলামি রিপাবলিক অব পাকিস্তান’ সে রাষ্ট্রের কোনো সমস্যাই সমাধান করতে পারেনি এবং দেশটিকে দুটুকরো করতে সাহায্য করেছে। ‘ইসলামি রিপাবলিক অব পাকিস্তান’ নামে সে রাষ্ট্রটি এখনো পৃথিবীতে টিকে আছে, সে রাষ্ট্রটিও আজ ভয়াবহ সমস্যার ভারে জর্জরিত। ইসলাম সে রাষ্ট্রের কোনো সমস্যাই সমাধান করতে পারছে না। বরং সে রাষ্ট্রে ‘মুসলমানরাই’ বোমা মেরে মুসলমান মারছে, মসজিদে নামাজ আদায়রত মুসল্লিদের হত্যা করছে। অনৈসলামিক বিশ্বের খেদমতে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে। কাজেই চোখেই দেখা যাচ্ছে পাকিস্তান ইসলামি রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও তার কোনো সমস্যাই ‘ইসলাম’ সমাধান করতে পারছে না। কাজেই আব্দুর রাজ্জাকের এ কথার কোনো সত্যতা নেই। শুধু ইসলাম দিয়ে হবে না, ইসলামের সঙ্গে শক্তিশালী মারণাস্ত্র লাগবে। শত্রুপক্ষের চেয়েও শক্তিশালী অস্ত্র।
তিন. পৃথিবীতে একটি রাষ্ট্র গত ৬০/৭০ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। ইসরায়েল একটি ধর্ম রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্র ‘ইহুদি ধর্ম’ দিয়ে মুসলমানদের ঠা-া করে রাখেনি। রেখেছে অস্ত্রের জোরে। সে অস্ত্র সরবরাহ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সৌদি আরবের বাদশাসহ পৃথিবীর বহু মুসলিম প্রধান দেশের শাসক সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোলাম। ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী যুক্তরাষ্ট্রের গোলাম। দেশের মানুষ ধর্মভীরু। ৮০ ভাগ মানুষ মুসলমান। তবুও জামাত ভোট পায় না। বিএনপির ঘাড়ে চেপে গত সংসদ নির্বাচনে তারা মাত্র ৩টি আসন পেয়েছিল। দেশের ৮০ ভাগ মানুষ মুসলমান কিন্তু তারা বোকা নন। জামাতের মতো প্রায় অর্ধশিক্ষিত মধ্যযুগীয় চিন্তার অধিকারী একটি দল যে আজকের সমাজের কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারবে না, দেশবাসী তা জানেন। আর জানেন বলে তারা জামাতকে ভোট দেন না। ভোট পায় শেখ মুজিব ৯৮ ভাগ মানুষ ১৯৭০ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। শেখ মুজিব ইসলাম-ইসলাম করে চিৎকার করেননি। ইহজাগতিক সমস্যার তিনি ইহজাগতিক সমাধানের কথা বলেই ৯৮ ভাগ মানুষের সমর্থন আদায় করেছিলেন। কাজ না করে শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া চাইলে কিছু পাওয়া যায় না। কাজই ফসলÑ শ্রমই বস্তু। ইসলামি রাষ্ট্র হলে বাংলাদেশের সব সমস্যার সমাধান হবে।চার. পাকিস্তান হওয়ার পর আমাদের গ্রামের মসজিদে ঈদের নামাজে মৌলভী সাহেব যে কথা বলেছিলেন, গত ৬০/৬৫ বছর অনর্গল প্রতিটি ঈদের নামাজে একই কথা শুনে আসছি। এবারো ঈদুল ফেতরের নামাজে একই প্রার্থনা শুনলাম। তাহলো, ‘হে আল্লাহ, তুমি পৃথিবীর মুসলমানদের ইজ্জত রক্ষা করো, সহিসালামতে রাখো।’ এবারে ‘লিবিয়ার’ কথা বললেন মৌলভী সাহেব। লিবিয়ার মুসলমানদের রক্ষা করার প্রার্থনা করা হলো। মৌলভী সাহেবকে প্রশ্ন করার কেউ নেই লিবিয়ার গাদ্দাফিও মুসলমান এবং তার বিরুদ্ধে যারা আন্দোলন করছে তারাও মুসলমান। লড়াই হচ্ছে গাদ্দাফির সমর্থক বাহিনীর সঙ্গে দেশের মানুষের যারা প্রায় সবাই মুসলমান। মৌলভী সাহেব কাদের রক্ষা করার মোনাজাত করলেন বোঝা গেলো না। বিগত ৬০/৬৫ বছর ইসরায়েলের হাতে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানরা মার খেয়েই আসছে। প্রতি বছর দুটি ঈদে লাখ-কোটি মুসলমান মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করছেন। কিন্তু আল্লাহর তরফ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ইরাক, আফগানিস্তানের কথাও বললেন মৌলভী সাহেব। কিন্তু এ কথা বললেন না আফগানিস্তান ও ইরাকের শাসকশ্রেণী মুসলমান। তারাই ওই দুটি দেশের মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। আবার সন্ত্রাসী নামধারী মুসলমানরা ওই দুটি দেশের মুসলমানদের ওপরই বোমাবর্ষণ করছে। আল্লাহ কী করবেন? কোন মুসলমানদের পক্ষে দাঁড়াবেন মৌলানার কথায় তা স্পষ্ট হলো না। আগেই বলেছি একাত্তরে আমাদের গৌরব মুক্তিযুদ্ধে আমরা লড়াই করেছিলাম পাকিস্তানি মুসলিম সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর এ দেশের বাঙালি রাজাকার-আলবদরদের বিরুদ্ধে, তারাও মুসলমান। এ দেশের মৌলানা সাহেব, যারা প্রতি ঈদের জামাতে মুসলমানদের হেদায়েত করার মোনাজাত করেন। তারা একাত্তরে কার হয়ে লড়াই করেছিলেন। ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তান নাকি বাঙালির রাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে?
পাঁচ. তাই বলছিলাম, ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের কোনো সমস্যারই সমাধান করতে পারবে না জামাতে ইসলামী। সে ক্ষমতা তাদের নেই। সমস্যা সমাধানের জন্য দরকার আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি। জামাতে ইসলামীতে তেমন কোনো শিক্ষিত, প-িত নেই, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নেই, বিজ্ঞানী নেই, সমাজবিজ্ঞানী নেই, অর্থনীতিবিদ নেই। তাই এ দেশের সজাগ ধর্মভীরু মানুষ, লেখাপড়া জানুক বা না জানুক তারা কেউ জামাতকে ভোট দেবেন না। তাই জামাত গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে নাÑ করে সন্ত্রাসবাদে হত্যা, ক্যু, লুটপাট ইত্যাদি অমানবিক-অসামাজিক কাজে।
শহিদুল ইসলাম : সাবেক অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।