লালন (১৭৭৪-১৮৯০) বাংলার বাউল ঘরানার সর্বশ্রেষ্ট সাধক। লালন এর জীবন
অস্টাদশ শতকের শেষ প্রান্ত থেকে উনিশ শতকের শেষ প্রান্ত অবধি অবধি
বিস্তৃত; জীবনভর যে সাধক কর্ষন করেছেন নান্দনিক ও আধ্যাত্মিক সংগীতশস্য-
যা একাধারে মরমী ও মানবিক। যে কারণে লালন-এর জীবনদর্শনই বাঙালির ভাবজগতের
অন্যতম ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে লালন এর ভাবদর্শন এক দিনে তৈরি
হয়নি, সে জন্য বাংলার ভাব জগতে এক দীর্ঘকালীন প্রস্তুতি চলছিল, যে
প্রস্তুতিপর্বে ক’জন বাঙালি তত্ত্বদর্শী গভীর অবদান রেখে গেছেন। লালন তাঁর
এক গানে সবিনয়ে তাদের মাহাত্ম বর্ননা করেছেন, এবং আমরা সেই গুরু-স্তুতির
গভীরতায় বিস্মৃত হয়ে যাই ...
লালন এর একজন গুরুর কথা আমরা জানি। তিনি হলেন সিরাজ সাঁই। এ প্রসঙ্গে আবুল
আহসান চৌধুরী তাঁর ‘লালন সাঁইয়ের সন্ধানে’ বইয়ে লিখেছেন, ‘লালন সাঁই
বাউলসাধনার সিদ্ধ-পুরুষ। কাহার-সম্প্রদায়ভুক্ত সিরাজ সাঁইয়ের নিকট দীক্ষা
গ্রহনের পর তাঁর প্রকৃত সাধকজীবনের সূচনা। (পৃষ্ঠা, ২৩) সিরাজ সাঁই ছাড়াও
লালন এর আরও তিনজন গুরু ছিলেন। গুরু বলতে এখানে লালনের চোখে শ্রদ্ধাভাজন
ব্যক্তিকে বোঝানো হচ্ছে -যাদের কথা লালন তাঁর একটি গানে উল্লেখ করেছেন:
তিন পাগলে হৈল মেলা নদে এসে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।
একটা পাগলামী করে
জাত দেয় সে অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে
আবার হরি বলে পড়ছে ঢলে ধূলার মাঝে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।
একটা নারকেলের মালা
তাতে জল তোলাফেলা করঙ্গ সে
পাগলের সঙ্গে যাবি পাগল হবি বুঝবি শেষে
পাগলের নামটি এমন
বলিতে ফকিল লালন ভয় তরাসে
চৈতে নিতে অদ্বৈয় পাগল নাম ধরেছে।
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।
এই গানটি বেশ জনপ্রিয়। এদেশের হাটে-মাঠে-ঘাটে শোনা যায়। গানটি জনপ্রিয়
বলেই মনে প্রশ্ন জানে গানটির মানে নিয়ে সাধারণ শ্রোতা আগ্রহ বোধ করে কি
না। নাকি তারা কেবলি সুর ও তালের ঘোরে মাথা ঝাঁকায়? লালন এর গান নিয়ে
আলোচনা হয় সাধুসঙ্গে-এটা আমরা জানি, কিন্তু সে তো মুষ্টিমেয়
তত্ত্বজিজ্ঞাসুর কর্ম, ওই আসরে সাধারণ্যের প্রবেশ দুঃসাধ্য। তা সত্ত্বেও
কি বাউল গানের মানে নিয়ে সাধারণ শ্রোতার মনে কি প্রশ্নের উদয় হয় না? যা
হোক। এই গানটির মানে বোঝার চেষ্টা করা যাক।
তিন পাগলে হৈল মেলা নদে এসে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।
নদে মানে ধরে নিচ্ছি, নদীয়া, নদীয়া জেলা। জ্ঞানপীঠ বলে যে জায়গাটির এককালে
বিপুল খ্যাতি ছিল। সেই নদীয়া জেলায় তিনজন পাগলের মেলা বসেছে। আমরা অনেক
সময় বিদ্যাধর পন্ডিতব্যাক্তিকে পাগল বলি। ‘হৈল মেলা’ বলতে দেখা হয়েছে
বোঝানো হয়েছে। তিনজন সাধারণ মানুষের দেখা হয়। আর তিনজন জ্ঞানী মানুষের
দেখা হলে মেলা বসে যায়। আশেপাশে লোকের ভিড় বাড়ে, চলতে থাকে প্রশ্ন-উত্তর।
যা হোক। লালন প্রথমেই কিন্তু তিন জন পাগলের নাম বলেননি, নাম বলেছেন গানের
শেষ স্তবকে। তবে লালন বলেছেন, কেউ যেন পাগলের কাছে না যায়।
কেন?
সে কথায় পরে আসছি।
এরপর লালন বলছেন:
একটা পাগলামী করে
জাত দেয় সে অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে
আবার হরি বলে পড়ছে ঢলে ধূলার মাঝে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।
এ ক’টি চরণে পাগলের মানসিক প্রবণতা সম্বন্ধে অনেকটাই বোঝা গেল। একজন
পাগলামী করে ‘ জাত দেয় সে অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে’। এই চরণে যেন লালন পাগলের
‘জাত’ অনেকটাই চিনিয়ে দিলেন। এই পাগলেরা বৈপ্লবিক চিন্তাচেতনায় আচ্ছন্ন।
কেননা, বাংলায়-যেখানে জাতপাতের অলঙ্ঘনীয় প্রাচীর উঠেছে-সেখানে জাতহীনকে
জাত দেওয়া সহজ কথা নয়: এক অর্থে এটি পাগলামীই বটে। কেননা, অজাতকে জাত দিলে
নিজের জাত খোয়ানোর আশঙ্কা থাকে। সে আশঙ্কা মাথায় নিয়েই উনিশ শতকে লালন
গেয়ে উঠেছিলেন-
জগত জুড়ে জাতের কথা
লোকে গল্প করে যথাতথা
লালন বলে জাতের ফাতা ডুবিয়েছি সাধবাজারে।
বোঝা গেল, লালনের পাগলেরা সময়ের চেয়েও অগ্রসর চিন্তার অধিকারী এবং
মানবতাবাদী। তবে তারা জাতপাত না-মানলেও ঈশ্বরে বিশ্বাসী। কেননা, ‘ আবার
হরি বলে পড়ছে ঢলে ধূলার মাঝে।’ হরি এবং আল্লাহ্ সমার্থক। তার মানে ওই
মানবিক পাগলেরা সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত অবস্থায় আল্লাহর
জিকির (স্মরণ) করতে করতে (সুফিদের মতো?) ধুলায় লুটিয়ে পড়ছে। শোষিত শ্রেণির
পাশে দাঁড়ানো এবং ঈশ্বরের প্রতি গভীর বিশ্বাস-এটাই বাংলার মানবতাবাদীদের
পবিত্র আদর্শ ...কিন্তু,লালন এও বলছেন, ‘তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।’
কেন?
এবার সে প্রসঙ্গে আসব।
একটা নারকেলের মালা
তাতে জল তোলাফেলা -করঙ্গ সে;
পাগলের সঙ্গে যাবি পাগল হবি বুঝবি শেষে
কি শব্দচয়ন, কি ছন্দ, কি ভাব- এ কটি চরণের ভাঁজে ভাঁজে লালনের
প্রজ্ঞাপ্রতিভার কী অপূর্ব বিকিরণ! এ কটি চরণ মনের ভিতরে যতই গুঞ্জরিত হতে
থাকে-ততই মহাত্মা লালনের উপলব্দির গভীরতায় বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ি ।
আপতাদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এই তিনটি চরণ গানটিতে এসেছে
অপ্রাসঙ্গিকভাবে-গানের মূল বক্তব্যের সঙ্গে মিল নেই। আসলে তা নয় এবং
এখানেই আমার বিস্ময়। এ তিনটি চরণ লালন এর প্রজ্ঞার বিরল উদাহরণ। বুঝিয়ে
বলি-একদা গ্রামাঞ্চলে নারকেলের মালাকে ‘কাপ’ কিংবা ‘মগ’ হিসেবে ব্যবহার
করা হত; এই নারকেলের মালার আরেক নাম-‘করঙ্গ’। এই করঙ্গ-র বৈশিষ্ট্য স্থির
বা Fixed. কেননা, এতে কেবল ‘জল তেলাফেলা-ই’ হয় -আর কিছু হয় না। এই ধরনের
স্থির চরিত্র দিয়ে সমাজ (বা কর্পোরেট সোসাইটি) তৈরি হয়, এরা বোধবুদ্ধিহীন
অনঢ় বলেই পরিবর্তনের প্রয়োজন বোধ করে না । সোসাল সিসটেম পরিচালনার জন্য
এরকম বোধবুদ্ধিহীন অনঢ় চরিত্রের প্রয়োজন। কাজেই দীর্ঘকাল সমাজের শুভ
পরিবর্তন হয়নি। এরা সমাজ টিকিয়ে রাখার স্বার্থে জাতপাত, বর্ণবৈষম্য ও
শ্রেণিবৈষম্য টিকিয়ে রাখে। যে জাতপাত নদীয়ার তিন ‘বিপ্লবী পাগল’ ভেঙে
ফেলতে চান। লালন যে কারণে র্ভৎসনা করে বললেন, ‘পাগলের সঙ্গে যাবি পাগল হবি
বুঝবি শেষে।’ কেননা, পাগলের সঙ্গে গেলে ‘প্লেটো কথিত’ গুড বয়দের
পরিবর্তনহীন অনঢ় সমাজটি ধ্বসে পড়বে যে! তা কি ঠিক হবে? তাহলে তো জগতে
শান্তি বিরাজ করবে। তা কি ঠিক হবে? বরং তোরা চিরটিকাল ফিক্সড চরিত্রের
‘করঙ্গ’ হয়েই থাক।
লালন এবার তিনজন গুরুর নাম বলেছেন।
পাগলের নামটি এমন
বলিতে ফকিল লালন ভয় তরাসে।
চৈতে নিতে অদ্বৈয় পাগল নাম ধরেছে।
মহৎ মানুষের নাম সহজে উচ্চারণ করা যায় না। যেমনটি, এককালে বাংলায় বউরা
স্বামীর নামটি মুখে আনতে ভয় পেত। তেমনি, পাগলের নাম উচ্চারণ করতে লালন ভয়
পান। এত বড় মাপের মানুষ, ভয় তো হবেই। এখন তবে বলি: চৈতে হলেন
শ্রীচৈতন্যদেব; নিতে হলেন শ্রী নিত্যানন্দ এবং অদ্বৈয় হলেন অদ্বৈত আচার্য।
এবার এই তিনজনের মাহাত্ব বর্ণনা করি।
শ্রীচৈতন্যদেব গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্রবর্তক এবং শ্রী নিত্যানন্দ এবং
অদ্বৈত আচার্য সে আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন-বাংলার ইতিহাসে এ কথা
স্বর্ণক্ষরে লেখা রয়েছে। স্বর্ণক্ষরে-এই কারণে যে, গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের
মূলকথা হল গানের মাধ্যমে প্রেমের কথা বলা। এককথায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মটি হল
প্রেমবাদ। যা একাধারে কৃষ্ণপ্রেম এবং জীবপ্রেম। এবং যে ধর্মটি প্রাচীন
গ্রিক দার্শনিক যেনো অভ সিটিয়াম এর মতো উচ্চারণ করে: All
people are manifestations of the one universal spirit and should,
according to the Stoics, live in brotherly love and readily help one
another. They held that external differences such as rank and wealth
are of no importance in social relationships. শ্রীচৈতন্যদেব
গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্রবর্তক-তবে এই মাহাত্মার পরিচয় কেবল এতটুকু নয়, আরও
ব্যাপক তাৎপর্য এই বাঙালি সাধকের। কেননা, শ্রীচৈতনদেব বলেছিলেন,‘আমার
অন্তরে রাধা, বহিরঙ্গে কৃষ্ণ।’
এই কথার তাৎপর্য অতি গভীর।
শ্রীচৈতন্যদের গান গাইতে গাইতে চলছেন। সঙ্গে অন্যরা। গানের নাম
কীর্তন। গানের বাণী অনেকটা এরকম: আমি সঁপেছি/শ্যাম যাহা কিছু ছিল
সঁপেছি/আমার কুলশীলমান দেহমনপ্রাণ রাতুল চরণে সঁপেছি।’
শ্রীচৈতন্যদেবের সমসাময়িক বাংলার সুলতান ছিলেন আলাউদ্দীন হোসেন শাহ
(১৪৯৩-১৫১৯)। শ্রীচৈতন্যদেব যে ভক্ত বাঙালির প্রাণ ভক্তির প্লাবনে ভাসিয়ে
দিচ্ছেন- এ কথাটি ঠিকই সুলতানের কানে পৌঁছেছিল। মিটমিট করে হাসছিলেন
অসাম্প্রদায়িক সুলতান। ভাবপ্রচারে শ্রীচৈতন্যদেবকে যাতে কোনও ধরনের বাধার
সম্মূখীন হতে না হয়-সে নির্দেশ দিলেন সুলতান। শ্রীচৈতন্যদেবের একান্ত সচিব
ছিলেন রূপ গোস্বামী। শ্রীচৈতন্যদেবের শিষ্য হয়েছিলেন রূপ
গোস্বামী-উদারহৃদয় সুলতান তাতে বাধা দেননি। কেননা, তখন বাঙালি সমাজে
প্রচারিত হচ্ছিল এলমে তাসাউস বা সুফিবাদ; সুফিদের জিকিরে বাংলা কেঁপে
কেঁপে উঠছিল...লালন লিখেছেন: আবার হরি বলে পড়ছে ঢলে ধূলার মাঝে ... এর
ব্যাখ্যায় আমি লিখেছি ... ওই মানবিক পাগলেরা সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে
সংগ্রামরত অবস্থায় আল্লাহর জিকির (স্মরণ) করতে করতে (সুফিদের মতো?) ধুলায়
লুটিয়ে পড়ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ লিখেছেন, ‘...চৈতন্যের আন্দোলনকে বিশ্লেষন করলে বোঝা
যায় তিনি ইসলামী চিন্তাকে আত্বস্থ করে তা বৈষ্ণব আন্দোলনের আড়ালে নতুনভাবে
প্রতিস্থাপন করেছিলেন।’ ( বাংলার সংস্কৃতি বাংলার সভ্যতা। পৃষ্ঠা, ১১৬)
অদ্বৈত আচার্য, শ্রীচৈতন্যদেবের অন্যতম সঙ্গী ছিলেন। আমাদের পরম সৌভাগ্য
এই যে, অদ্বৈত আচার্য জন্মেছিলেন বাংলাদেশের সিলেট জেলার নবগ্রাম-লাউর
গ্রামে। ওঁর প্রকৃত নাম ছিল কমলাক্ষ ভট্টাচার্য। ইনি শ্রীচৈতন্যদেবের ৫০
বছরের বড় ছিলেন, জন্মেছিলেন ১৪৩৪ খ্রিস্টাব্দে। গীতার দর্শন শিক্ষা দিতেন
অদ্বৈত আচার্য, জীবনের অনেকটা সময় গৃহীজীবন কাটিয়েছেন পরিবার নিয়ে।
তারপর?
অদ্বৈত আচার্যর জীবনীকার লিখেছেন: In
his latter years Advaita Acharya became increasingly saddened by the
pursuit of materialistic goals that, he believed, lead to a
dysfunctional, unhappy society and concluded that the only solution was
to offer prayers, begging his Supreme Lord Krishna to come as an avatar
and attract people back to the joy of the spiritual life. http://en.wikipedia.org/wiki/Advaita_Acharya
নিতে বা শ্রী নিত্যানন্দ জন্ম ১৪৭৪ সালে। ইনিও ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবের
অন্যতম সহচর ও শিষ্য। এঁরা দুজন এতই ঘনিষ্ট যে-দুজনকে বলা হত ‘গৌড় নিতাই’।
কখনও ‘নিমাই-নিতাই’। নিমাই শ্রীচৈতন্যদেবের ডাক নাম।
এক্ষণে অন্য একটি প্রসঙ্গ উত্থাপন করি।
এই যে আমরা প্রায়শ কাঙালিনী সুফিয়ার একটি সুপারহিট গান শুনি :
এই নিতাইগঞ্জ কি শ্রী নিত্যানন্দ কে বোঝানো হয়েছে? কিংবা নিমাইগঞ্জ?
শ্রীচৈতন্যদেবকে? কোন-বা পথে নিতাইগঞ্জে যাই? এই চরণটি কি প্রেমবাদী
বৈষ্ণবদের কাছে যাওয়ার কাতরতা ফুটে উঠেছে ? যদ্দূর জানি, কাঙালিনী সুফিয়ার
সংগীতে দীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে এক এলমে তাসাউফপন্থির নিকট । এই পরস্পরের
কাছাকাছি যাওযার পন্থাটি অভিনব ... বাংলার এই বিস্ময় ...
যাক। শ্রী নিত্যানন্দের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের একচক্র গ্রামে।
ছোটবেলা থেকেই চমৎকার ভজন গাইতেন। তেরো বছর বয়েস থেকে একজন সন্ন্যাসী
সঙ্গে ভারতবর্ষের পবিত্র তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়ান। সেই সন্ন্যাসীর নাম
লক্ষ্মীপতি তীর্থ। একবার। নিত্যানন্দ রাস্তায় হাঁটছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে
কৃষ্ণের নাম জপ করছিলেন। এরকম সময় দুজন ভাই তার সামনে এসে দাঁড়াল। এদের
নাম ছিল জগাই আর মাধাই। এরা দুজই মাতাল হয়ে ছিল। মাধাই মাটির পাত্র ছুড়ে
মারল, তাতে নিত্যানন্দর কপাল কেটে দরদর করে রক্ত ঝরল। তা সত্ত্বেও এই
মানবপ্রেমিক বললেন,
মেরেছিস, কলসির কানা
তাই বলে কি প্রেম দেব না?
এই রকম প্রেমবাদী হয়ে ওঠার জন্যই কি কাঙালিনী সুফিয়ার গান-
কোন-বা পথে নিতাইগঞ্জে যাই?
শ্রীচৈতন্য কাছাকাছি ছিলেন। পাগল মানুষ তো ... মাধাই কে মারতে ছুটে গেলেন।
শ্রীচৈতন্যের পা জড়িয়ে ধরে নিত্যানন্দ বললেন, ওকে ক্ষমা কর প্রভূ। ক্ষমা কর। ও অবুঝ মানুষ, কি করতে কি করেছে।
সম্ভবত কাছাকাছি থেকে এই অপরূপ দৃশ্য দেখছিলেন আমাদের সিলেটের অদ্বৈত আচার্য।
শ্রীচৈতন্য, নিত্যানন্দ এবং অদ্বৈত আচার্য- এই তিনজন ‘পাগল’ই লালন এর গুরু।
যোগ্য গুরুই বটে! যে গুরু সম্বন্ধে লালন গেয়েছেন-
পাগলের নামটি এমন
বলিতে ফকিল লালন ভয় তরাসে।
চৈতে নিতে অদ্বৈয় পাগল নাম ধরেছে।
‘নাম ধরেছে’ শব্দ দুটোয় খটকা লাগে। কি এর মানে? কেউ অনন্ত থেকে এসে নাম
ধরেনি তো ? অনন্ত থেকে এসে বারবার মানুষকে শুদ্ধ হতে বলছেন কি? মাতাল
মাধাই ও পাগল নিত্যানন্দের মধ্যে দূস্তর ফারাক ঘোচানোর জন্য?