স্বামী নিগমানন্দের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা
- আধ্যাত্মিকভাবে মুক্ত হওয়ার জন্য একজন মুক্ত মানুষ (একজন সৎগুরু বা
শুধু গুরু) এর সাহায্য প্রয়োজন। হিন্দু শাস্ত্রসমূহে সেই ব্যক্তিকে সৎগুরু
হিসেবে পরিচিত। তাঁর অনুগ্রহ বা আনুকূল্য ব্যতীত কেউ মুক্তির পথে কোনো
অগ্রগতি করতে পারে না। আবার যিনি পরম বাস্তবতাকে (পরমাত্মা বা ব্রহ্ম)
নিজের (আত্মা) সাথে একাত্ম হিসেবে অধিগত হয়েছেন তিনি গুরু।
- গুরু যিনি কাউকে মুক্ত হতে সাহায্য করেন তাঁকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা,
তীর্থ বা দেবত্বের গুরুত্বের সাথে সমান বিবেচনা করা যেতে পারে না। যদি আমরা
তাঁর নিকট গভীর ভক্তি এবং প্রেম নিবেদন না করি, তবে অন্য আর কে আমাদের পরম
সম্মান পাওয়ার যোগ্য?
- বেদান্ত যা শিক্ষা দেয় গুরু প্রকৃতপক্ষে তার মূর্ত প্রকাশ - আত্মা এবং পরমাত্মা বা ব্রহ্ম একই।
- একজন সৎগুরু কখনই কাউকে অভিশাপ দেন না। যদি তাঁকে রাগান্বিত বলে মনেও
হয়, তবে তাও শিষ্যের মঙ্গলের জন্য। সৎগুরু উপর নির্ভরতার উপকারিতা অনন্য।
এমনকি ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিও সমান উপকারিতা পান না কারণ ঈশ্বর
কখনই নির্দেশনা দিতে বাস্তবে মূর্ত হন না। গুরু বাস্তবে শিষ্যকে চূড়ান্ত
লক্ষ্যে পৌঁছতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন।
- এক দিক দিয়ে গুরু এবং শিষ্য অবিচ্ছেদ্য। একজন সত্যিকারের শিষ্যের ব্যক্তিত্ব বা চরিত্রের অংশ না হয়ে গুরু থাকতে পারেন না।
- আধ্যাত্মিক মুক্তি লাভের দুটি পথ আছে: একটি হচ্ছে সন্ন্যাস যোগে
দীক্ষাগ্রহণের ও কঠোরতা পালনের মাধ্যমে এবং অন্যটি - ব্রহ্ম উপলব্ধি লাভ
করা সৎগুরুর প্রতি সেবা নিবেদনের মাধ্যমে। পূর্বোক্তটি অত্যন্ত
দুঃসাধ্য/কষ্টকর একটি পথ - শিষ্যটিকে এক অর্থে দেহে থাকা অবস্থাতেই
মৃত্যুবরণ করতে হবে। অন্য ভাবে বললে তাকে তার দেহ চেতনা ছেড়ে যেতে হবে।
কিন্ত্তু কেউ যদি গুরুকে আন্তরিকভাবে সেবা নিবেদনের মাধ্যমে শর্তহীনভাবে
তাঁকে ভালবাসে, তবে তার পক্ষে তুলনামূলকভাবে সহজে আধ্যাত্মিক মুক্তি লাভ
করা সম্ভব।
- গুরুর অনুগ্রহ ব্যতীত সারগর্ভ কিছুই অর্জন সম্ভব নয়। আমি আহত
কণ্ঠস্বরওয়ালা পাখির মত ইতস্তত সর্বত্র ঘুরছিলাম কিন্ত্তু ঈশ্বর আমাকে
সাহায্য করতে আসছিলেন না। কিন্ত্তু যেদিন আমি গুরুর (যিনি মানব রুপে ঈশ্বর)
অনুগ্রহ কিংবা কৃপা লাভে সমর্থ হলাম, সেদিন আমি প্রকৃত উন্নতি করতে শুরু
করলাম।
- গুরু, দীক্ষাগ্রহণের সময় তাঁর দেয়া 'মন্ত্র', এবং শিষ্যের পছন্দকৃত
দেবতা (বা ইষ্ট) এক। যদি গুরু পছন্দকৃত দেবতা/ইষ্টে পরিণত না হন, তবে তাঁর
থেকে পাওয়া মন্ত্র এর শক্তি হারিয়ে ফেলে।
- দীক্ষাদানের মাধ্যমে শিষ্য অর্জন গুরুর পেশা নয়; এটি তাঁর হৃদয়ের
অনুপ্রেরণা। গুরু শিষ্যকে দীক্ষা দেন, যত্ন নেন এবং তাকে পথ দেখান এই আশায়
যে শিষ্য আধ্যাত্মিকভাবে আলোকপ্রাপ্ত বা অজ্ঞতামুক্ত হবে।
জীবন্মুক্ত উপাসনা তত্ত্ব
নিগমানন্দের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ছিল জীবন্মুক্ত উপাসনা তত্ত্ব যা সাধককে দ্রুত আত্ম-উপলব্ধির পথে চালিত করতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন ।
কর্ম তত্ত্ব
স্বামী নিগমানন্দের মতে, কর্ম তিন প্রকারের যথা: ক্রীয়মান, সঞ্চিত, এবং প্রারব্ধ। যখন কেউ তার শ্রমের ফল তার জীবদ্দশাতেই উপভোগ করতে পারে, তখন তাকে বলা হয় ক্রীয়মান; তার শ্রমের ফল ভোগ করার পূর্বেই যদি সে মারা যায়, তবে তাকে বলা হয় সঞ্চিত কর্ম। পূর্ব জন্মের সঞ্চিত কর্মের উদ্বৃত্ত অংশ ভোগ করার জন্য যদি তার পুনর্জন্ম হয়, তবে তাকে বলা হয় প্রারব্ধ। সাধনার গুণে কারো পক্ষে ক্রীয়মান ও সঞ্চিতের প্রভাব নিজের জীবন থেকে মুছে ফেলা যেতে পারে কিন্ত্তু প্রারব্ধ
কর্মের প্রভাব মুছে ফেলা সম্ভব নয়। পার্থিব উচ্চাকাঙ্ক্ষা দ্বারা যতক্ষণ
কোন ব্যক্তি আবিষ্ট থাকে ততক্ষণ তাকে নিশ্চিতভাবে জন্ম-মৃত্যুর অন্তহীন
ভ্রমণ গ্রহণ করতে হবে। জীবাত্মা কখনও কখনও নাক্ষত্রিক জগতে ভ্রমণ করার জন্য স্থূল দেহ ত্যাগ করে যাকে বলা হয় প্রেত
লোক। এর কর্মের প্রভাবের মধ্য দিয়ে যাবার পর এটি স্থূল দেহের সাথে স্থূল
জগতে ফিরে আসে তার অতিরিক্ত বাসনাসমূহ যা তার পূর্ব জন্মে ছিল তা পূরণ করার
জন্য। এ ব্যাপারে অজ্ঞ হয়ে কিভাবে এটি এক জগত থেকে অন্য জগতে চলাফেরা করে
তা এক বড় রহস্যের বিষয়। যোগীরা এ রহস্য স্পষ্টভাবে হৃদয়ঙ্গম বা
প্রত্যক্ষ করতে পারেন এবং জীবের পূর্ব সংস্কার সম্পর্কে বলতে পারেন।
মৃত্যু চিন্তা প্রক্রিয়া তত্ত্ব
মৃত্যুরহস্য বিষয়ে স্বামী নিগমানন্দের অন্তর্দৃষ্টি তাদের জন্য সৎগুণ
এবং ন্যায়ের পথে হাঁটতে এবং সামান্যতম ভয় ছাড়াই মৃত্যুর রুদ্রমূর্তিকে
সম্মুখীন হতে এক পথনির্দেশিকা হিসেবে থেকে যাবে।
স্বামী নিগমানন্দ বলেন যে প্রত্যককেই সব সময় মনে রাখা উচিত যে তাকে
একদিন মৃত্যুবরণ করতে হবে। আমরা জানি না কোন মুহূর্তে মৃত্যু আমাদের
সাক্ষাৎ দিবে। ভাল বা মন্দ কাজ করার পূর্বে তার এও মনে রাখা উচিত যে তাকে
একদিন মৃত্যুবরণ করতে হবে এবং সে দিন খুব বেশী দূরে নয়। মৃত্যু তার মন
থেকে ইন্দ্রিয় সুখ এবং মন্দ চিন্তার জন্য দুশ্চিন্তা দূর করবে। যদি সে এটা
চিন্তা করে তবে মানুষ দরিদ্রের উপর কোন অন্যায় কাজ করা থেকে বিরত থাকবে।
সম্পদ ও সম্পর্ক তখন মানুষের অনুভূতির উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে ব্যর্থ
হবে। সকল পার্থিব বিষয়সমূহ যার সাথে সে বাঁধা সেগুলি তার এ পৃথিবী ত্যাগের
পরেও একই রকম থাকবে। শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক সম্পদ যা তিনি জীবদ্দশাতে অর্জন
করেছেন তা ব্যক্তির সম্পদ হিসেবে থেকে যাবে। যারা তাদের বুদ্ধির জোরে
সম্পদ ও জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং সে কারণে অহংকারে স্ফীত হয়েছেন তারা
মৃত্যুর ঈশ্বরের নিকট নম্রভাবে আত্মসমর্পণ করবেন যখন সে নির্দিষ্ট মুহূর্ত
আসবে। অহংকারে উল্লসিত হয়ে কিছু অবিবেচক মানুষ তাদের সহ-ভ্রাতৃগণের সাথে
দুর্ব্যবহার করেন এটা ভুলে গিয়ে যে যথাসময়ে সুদ-সমেত তাদের একই রকম কিছু
ফেরত পেতে হবে। তাদের জন্য সে দিন অপেক্ষা করছে যখন তারা জনশূন্য শ্মশান
ভূমিতে ত্যাক্ত হবেন এবং সেখানকার জীব-জন্ত্ত তার অস্থি-চর্ম-মাংস নিয়ে
আনন্দের সাথে ভোজ করার জন্য অপেক্ষা করবে। তাদের জড় অচেতন দেহ সে সকল
প্রাণীর নিকট নীরব আত্মসমর্পণের জন্য পড়ে থাকবে। যদি সে এসব চিন্তা করে
তবে সকল মন্দ চিন্তা তার মন থেকে দূর হয়ে যাবে। যারা জীবনের সত্যের প্রতি
অন্ধ এবং সাময়িক পার্থিব আনন্দে নিজেদের নিমজ্জিত করেছেন তারা তাদের
জীবনের গতি পরিবর্তন করতে সমর্থ হবেন যদি পূর্বোক্ত লাইনগুলো তাদের মনে
থাকে। তোমাদের যারা সত্যের ব্যাপারে যথেষ্ট জ্ঞানী এবং সতর্ক হয়েছ তারা
মৃত্যুর ব্যাপারে ভীত হবে না এবং তারা এটিকে উচ্চতর জগতে উত্তরণ হিসেবে
গ্রহণ করবে।
প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহ
গারোহিল যোগ আশ্রম
১৩১২ বঙ্গাব্দে, নিগমানন্দ আসামের (বর্তমানে মেঘালয়) গারোহিলে একটি যোগ আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।
সারস্বত মঠ
১৯১২ সালে স্বামী নিগমানন্দের প্রতিষ্ঠিত শান্তি আশ্রম এখন "আসাম বঙ্গীয় সারস্বত মঠ" নামে পরিচিত
স্বামী নিগমানন্দ শিবসাগর জেলার জোড়হাটে এক খন্ড জমি নেন এবং ১৩১৯
বঙ্গাব্দের (১৯১২ সালে) বৈশাখ মাসের অক্ষয়া তৃতীয়ায় সেখানে একটি আশ্রম
প্রতিষ্ঠা করেন। এটাকে বলা হতো "শান্তি আশ্রম" বা সারস্বত মঠ, যা পরবর্তীকালে আসাম-বঙ্গীয় সারস্বত মঠ নামে পরিচালিত হয়ে আসছে। মঠের উদ্দেশ্য/ব্রত ছিল সনাতন ধর্ম ব্যাপকভাবে প্রচার, প্রকৃত শিক্ষা বিস্তার এবং সকলকে ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি হিসেবে সেবা করা।
সারস্বত মঠ জোড়হাটের ছয় মাইলের মধ্যে এক দারুণ তৃণভূমির কোলে আশ্রিত
ছিল। মঠের এক পাশে ছিল এক উপজাতীয় গ্রাম আর এর তিন দিক গভীর বনে ঘেরা ছিল।
মারিয়ানি-জোড়হাট রেলপথ উপজাতীয় গ্রামটির মধ্য দিয়ে কোকিলামুখ পর্যন্ত
গিয়েছে। হিমালয় পর্বতমালা এ জায়গার উত্তরে, উদয়গিরি পূর্বে এবং নাগা
পর্বত দক্ষিণে অবস্থিত। আশ্রমের দৃশ্য প্রাচীনকালের আশ্রমের দৃশ্য মনে
করিয়ে দিত। পাশ্ববর্তী জঙ্গল এবং জায়গাটির নির্জনতা ধ্যানের অত্যন্ত
অনুকূল ছিল। ধর্মগ্রন্থ পাঠ ও ধ্যানের সাথে সাথে গবাদি পশু চরানো, ঘাস
খাওয়ানো এবং এদের জন্য শুকনো খাদ্য সংগ্রহ ছিল আশ্রমের ব্রহ্মচারীদের উপর
অর্পিত কাজ। স্বামী নিগমানন্দ কর্তৃক সম্পাদিত "সারস্বত গ্রন্থাবলী"র কাজ
এই মঠের প্রেস হতে প্রকাশিত হয়েছিল। আর্য দর্পণ নামের ধর্মীয়
মাসিক পত্রিকা এখান হতে মুদ্রিত হওয়া অব্যাহত ছিল। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটিকে
স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে আশ্রমটিতে মুদ্রণ, অন্যান্য শিল্প যেমন কাঠের কাজ,
কামারের কাজ এবং হস্তচালিত তাঁত চালু করা হয়েছিল। দাতব্য ঔষধালয়টি মঠের
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে পরিণত হয়েছিল যেখানে গরীব রোগীদের ঔষধসহ চিকিৎসা
সেবা দেয়া হতো। ছাত্রদের যোগ শিক্ষা দেয়ার জন্য ঋষি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
স্বামী নিগমানন্দ মহান শঙ্করাচর্যের আদেশে "সরস্বতী"র ঐতিহ্যে তাঁর দশ জন ধর্মপ্রাণ শিষ্যকে সন্ন্যাসে
দীক্ষা দেন, যাদের মধ্যে কনিষ্ঠতম ছিলেন "স্বামী নির্বাণানন্দ সরস্বতী"
(একজন বিদ্বান, পন্ডিত, দার্শনিক এবং লেখক যিনি পরে অনির্বাণ হিসেবে
বিখ্যাত হন) এবং "স্বামী প্রজনানন্দ সরস্বতী"। স্বামী প্রজনানন্দকে সারস্বত
মঠ ও আশ্রম প্রতিষ্ঠানসমূহের ট্রাস্টি এবং মোহন্ত হিসেবে শপথ পাঠ করিয়ে স্বামী নিগমানন্দ অবসর নেন এবং ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত পুরীতে নীলাচল কুটিরে কয়েক বছর বসবাস করেন।
সারস্বত মঠের ১০০ বছর (১৩১৯ - ১৪১৮ বঙ্গাব্দ)
ভারতের জোড়হাটে (কোকিলামুখে) স্বামী নিগমানন্দের আশ্রম-স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান আসাম বঙ্গীয় সারস্বত মঠ
১৩১৯ বঙ্গাব্দে (১৯১২ সালে) স্বামী নিগমানন্দ প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠান
(শান্তি আশ্রম) বা "সারস্বত মঠ" ১৪১৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখের অক্ষয়া তৃতীয়ায়
(২০১১ সালের ৬ ই মে) এর জীবনের একশত বছরে পদার্পণ করল। স্বামী নিগমানন্দের উক্তিটি নিম্নরুপ:
" |
এই শান্তি আশ্রম আমার সারা
জীবনের সাধনা ও প্রচেষ্টার ফল; এ আশ্রমের সাথে তুলনা করলে আমার জীবনকে
যতসামান্য গুরুত্বের মনে হতে পারে—আমি আমার জীবনকে এ আশ্রমের জন্য শতবার
উৎসর্গ করতে পারি। এটি আমার প্রত্যাশা যে এ আশ্রম থেকে উপযুক্ত সময়ে শত শত
নিগমানন্দ বের হয়ে আসবে। আমার শিষ্যগণ, তোমরা আমার সে আশ্রমের রক্ষক, এবং
আমি আশা করি যে তোমাদের কেউই আমার আত্মা-সদৃশ এ আশ্রমকে অবহেলা করবে না,
এবং তদনুযায়ী আমার মৃত্যুর কারণ হবে না। - স্বামী নিগমানন্দ |
” |
গুরু ব্রহ্ম আশ্রম
স্বামী নিগমানন্দ গুরু ব্রহ্ম আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে যে কোন
বিশ্বাসের ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজস্ব পথে ঈশ্বরের আরাধনা করতে পারতেন। তিনি অবিভক্ত বাংলার পাঁচটি বিভাগে পাঁচটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন: বাংলাদেশের কুমিল্লার ময়নামতিতে "পূর্ব বাংলা সারস্বত আশ্রম", বাংলাদেশের ঢাকার কালনিতে "মধ্য বাংলা সারস্বত আশ্রম", বগুড়াতে "উত্তর বাংলা সারস্বত আশ্রম", মেদিনীপুরের খরখুসামায় "পশ্চিম বাংলা সারস্বত আশ্রম" এবং ২৪ পরগণার হালিশহরে "দক্ষিণ বাংলা সারস্বত আশ্রম"। তিনি অনেক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং গুরু-শিষ্য ঐতিহ্যে হাজার হাজার শিষ্য তৈরী করেন।আসামের জোড়হাটের কোকিলামুখে স্বামী নিগমানন্দ ১৯১৫ সালে জগৎ গুরু আসন সংস্থাপন করেন।
নীলাচল সারস্বত সঙ্ঘ, পুরী
ভারতের পুরীর নীলাচল সারস্বত সঙ্ঘের প্রতীক
স্বামী নিগমানন্দ তাঁর কাজ থেকে অবসর নেন এবং ওড়িশার পুরীর নীলাচল কুটিরে বসবাস করেন। পুরী চার ধাম তীর্থযাত্রার অংশ হিসেবে হিন্দুদের একটি পবিত্র শহর যা ভগবান জগন্নাথের শহর হিসেবেও পরিচিত। স্বামী নিগমানন্দ বিশ্বাস করতেন যে ভগবান জগন্নাথ হচ্ছেন "সত্যের প্রতীক" কারণ ওড়িশার পুরীর ভগবান জগন্নাথের ধর্মানুষ্ঠানের মধ্যে সাংস্কৃতিক সত্যতা, একতা এবং অখন্ডতা মূর্ত/অন্তর্ভূক্ত করে। তিনি তাঁর জীবনের বাকী ১২ বছর পুরীতে অতিবাহিত করেন।
২৪শে আগষ্ট ১৯৩৪ (শুক্রবার), শ্রাবণ পূর্ণিমা দিবস, নীলাচল সারস্বত সঙ্ঘ স্বামী নিগমানন্দের নিজের দ্বারা পুরীতে নীলাচল কুটিরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।ওড়িশার
ভক্তবৃন্দ তাঁর জন্মদিন উদ্যাপন করতে সেখানে জড় হন। তিনি তাদের মধ্যে
একটি ধর্মীয় বৃত্ত গঠনের উপদেশ দেন। তাঁর ইচ্ছানুসারে কিছু ভক্ত ধর্মীয়
আলোচনার জন্য একটি সমিতি বা সংসদ চালু করেন এবং গ্রুপভিত্তিক আলোচনা এবং
উপাসনার পর্যায়ক্রমিক বৃদ্ধির দ্বারা "নীলাচল সারস্বত সঙ্ঘ" (সঙ্ঘ) চালু হয়, তিনটি উদ্দেশ্য পূরণের জন্য, (১) আদর্শ গৃহস্থ জীবন যাপন, (২) মিলিত শক্তি প্রতিষ্ঠা এবং (৩) ভাব বিনিময়।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠান
বর্তমানে ভারতের কিছু জায়গায় স্বামী নিগমানন্দের অনুসারীদের দ্বারা যোগ, শিক্ষা এবং দর্শনের কিছু প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে।
কর্ম
প্রকাশনাসমূহ
আধ্যাত্মিক পুস্তক এবং সাময়িকী সমূহ: সারস্বত গ্রন্থাবলী এবং আর্য দর্পণ ছিল সত্যানুরাগীদের জন্য তাঁর অবদান।
সারস্বত গ্রন্থাবলী
শুধু পাঠগত উৎসের ভিত্তিতেই নয় বরং তাঁর প্রথম হাত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে
নিগমানন্দের লেখা বিখ্যাত গ্রন্থসমূহ হচ্ছে "ব্রহ্মচর্য সাধন", "যোগী
গুরু", "তান্ত্রিক গুরু", "জ্ঞানীগুরু" এবং "প্রেমিক গুরু" যেগুলি সনাতন ধর্মে বিদ্যমান মৌলতত্ত্ব এবং সাধনা বা আধ্যাত্মিক অনুশীলনের প্রায় সকল বাস্তব পদ্ধতি সম্পর্কিত। এর অব্যবহিত পরেই তাঁর পর পর লেখা "মায়ের কৃপা", "বেদান্ত বিবেক" এবং "তথ্যমালা" আধ্যাত্মিক জগতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
সনাতন ধর্ম পত্রিকা - আর্য দর্পণ
আর্য দর্পণ
যৌক্তিক ভিত্তি বিবর্জিত সংকীর্ণ ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা ভ্রান্ত পথে
চালিত হতে প্রবণ জনগণের মাঝে অ-উপদলীয় আধ্যাত্মিক জ্ঞান বিতরণের উদ্দেশ্যে
তিনি আর্য দর্পণ নামে এক মাসিক পত্রিকাও প্রকাশ করেন।
এই পত্রিকায় তিনি ধর্মীয় ও ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের
উপর অনেক রচনা লেখেন। নিগমানন্দের অনুসারীরা ঘোষণা করেছেন যে পৃথিবীর যে
কোন বিশ্বাসের অনুসারীদের নিকট এই গ্রন্থসমূহ উপকারী এবং যদি যত্ন সহকারে
সেগুলিতে বর্ণিত বিষয়সমূহ চর্চা করা হয় তবে তা আধ্যাত্মিক সাধনায় যে কোন
মানুষকে সুনির্দিষ্ট সাফল্যে পৌঁছে দেবে। এই সকল গ্রন্থসমূহ বাংলা
থেকে ওড়িয়া ভাষায় অনুবাদ করেন একজন ওড়িয়া সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী
ব্যক্তিত্ব এবং ঠাকুরের শিষ্য শ্রী ডি সি মোহান্তি, পুরী (শ্রী দুর্গা চরণ
মোহান্তি)।যেহেতু স্বামী নিগমানন্দ এক দীর্ঘ এবং অব্যাহত খোঁজের মধ্য দিয়ে তাঁর
গুরুকে আবিষ্কার করেছিলেন, তাঁর অনেক শিষ্যকেও তাঁকে খুঁজে পেতে একই নিয়ম
অনুসরণ করতে হয়েছিল। এ রকম অল্প কিছু সংখ্যক গল্প তাঁর শিষ্যদের দ্বারা
বর্ণিত হয়েছে।
ভক্ত সম্মিলনী ১৯২২: ভক্তদের সাথে স্বামী নিগমানন্দ (মাঝে)
ভক্ত সম্মিলনী
বিভিন্ন উপাসনা উপদলসমূহকে শক্তিশালী, জীবনে গুরু থাকার প্রয়োজনীয়তা
আলোচনা, আশ্রমে থাকা সন্ন্যাসীদের কল্যাণ পর্যালোচনা, সামগ্রিকভাবে তাদের
এবং আশ্রমের সমস্যাসমূহ সমাধানে সাহায্য, বিদ্যালয় বা সম্প্রদায়ের জন্য
সমাজসেবামূলক কাজ এবং পরিশেষে সর্বজনীন আধ্যাত্মিক জীবনের সমসাময়িক
সমস্যাসমূহের উপর আলোকিত বক্তাদের বক্তৃতা শ্রবণে আধ্যাত্মিক সভা আয়োজন
করার জন্য স্বামী নিগমানন্দ গৃহস্থ ও সন্ন্যাসী উভয় ধরণের ভক্তদের
বার্ষিকভাবে এক সম্মেলনে মিলিত হওয়ার আহ্বান করেন যাকে বলা হয় ভক্ত সম্মিলনী।নিগমানন্দ
বলেন যে এই সকল কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হলো শিষ্যদের আধ্যাত্মিকভাবে অগ্রসর
হতে সাহায্য করা যাতে তারা জীবনে শান্তি এবং সত্যিকারের সুখ লাভ করতে পারে। নিগমানন্দ পৃথিবীর মঙ্গলার্থে এই সম্মিলনী সম্পর্কে কিছু স্পষ্ট নিয়ম-নীতি রেখে গেছেন।
তিনি এই সম্মিলনীকে দুটি অংশে বিভক্ত করেন: একটি হচ্ছে সার্বভৌম (দেশব্যাপী) ভক্ত সম্মিলনী এবং অন্যটি হচ্ছে প্রাদেশিক (রাজ্যব্যাপী) ভক্ত সম্মিলনী।
- সার্বভৌম ভক্ত সম্মিলনী
স্বামী নিগমানন্দ ১৯১৫ সালে আসামের জোড়হাটের কোকিলামুখে প্রথম সার্বভৌম ভক্ত সম্মিলনী চালু করেন।
১৯৩৪ সালের সার্বভৌম ভক্ত সম্মিলনীতে স্বামী নিগমানন্দ প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর সকল শিষ্যদের আমন্ত্রণ জানান এবং পুরীতে পরবর্তী সার্বভৌম ভক্ত সম্মিলনীর ডাক দেন।
- প্রাদেশিক ভক্ত সম্মিলনী
প্রথম প্রাদেশিক সম্মিলনী ১৯৪৭ সালে "নীলাচল সারস্বত সঙ্ঘ, পুরী" কর্তৃক
ওড়িয়ার গঞ্জাম জেলার আঙ্কোলিতে মঘার পূর্ণিমাতে অনুষ্ঠিত হয় যেখানে
প্রায় ৬০ জন ভক্ত সমাবেশ করেন।
সম্মিলনীতে ভক্তদের জমায়েত থেকে উপচে পড়া স্বর্গসুখের অনন্ত প্রস্রবণ
থেকে স্বর্গীয় সুখ উপভোগ করতে স্বামী নিগমানন্দ তাঁর সন্তানদের (শিষ্যদের
এবং ভক্তদের) প্রত্যেককে তাঁর উষ্ণ ও আন্তরিক আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
সম্মিলনীতে আনন্দের প্লাবন উপচে পড়ে এবং অংশগ্রহণকারীরা এর অংশী হন।
বার্ষিক সম্মিলনী তাঁর হৃদয়ের খুর প্রিয় ছিল এবং ভক্তদের সকলেই এখানে
শিষ্যদের সাথে মিলিত হওয়াতে তাঁর আনন্দ উপলব্ধি করতেন।
তিনি বলেন:
" |
আমার ভক্তরা সম্পূর্ণভাবে অবহিত যে বছরে একবার খ্রীষ্টমাসে
এই সম্মিলনীতে তাদের জড় হতে দেখে আমি আনন্দিত। এই ধরণের সমাবেশ মঠসমূহকে
বিখ্যাত করবে এবং পৃথিবীর জন্য সাধারণভাবে মঙ্গল বয়ে আনবে। - স্বামী নিগমানন্দ |
” |
স্বামী নিগমানন্দ বার্ষিক সম্মিলনীতে মহিলা শিষ্যদের জন্য একটি ভিন্ন
উপাসনা দিবসের সূচনা করেছিলেন যেখানে তারা নিজেরাই অংশগ্রহণ এবং তাদের
দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময় করতে পারত।
|