‘বাবার ইচ্ছা ছিল আমাকে লেখাপড়া শিখিয়ে চাকরি করাবে। কিন্তু তাঁর ইচ্ছা আমি পূরণ করতে পারি নাই। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর আমার জীবনের সব আশা শেষ হয়ে গেছে। সরকার আমাকে থাকার জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পে একটি ঘর দিয়েছে। কিন্তু আমি কি সেখানে হাঁস-মুরগির মতো শুধু মাথাগুঁজে থাকতে পারব? কে আমার নিরাপত্তা দেবে।’ ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ধর্ষণের শিকার সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার পূর্বদেলুয়া গ্রামের সেই মেয়েটি গত মঙ্গলবার এভাবেই আক্ষেপ করে বলছিলেন কথাগুলো। তাঁর চোখ আর কণ্ঠ দুটিতেই ঝরে পড়ছিল হতাশা আর অনিশ্চয়তার শঙ্কা। এই মেয়েটির মতো সেই দুঃসহ সময়ের স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন আরও অনেক সংখ্যালঘু নারী। ওই নির্বাচন-উত্তর সহিংসতা বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের সোমবার প্রকাশিত প্রতিবেদনকে তাঁদের মতো ভুক্তভোগীরা স্বাগত জানালেও এতেই সন্তুষ্ট নন। তাঁরা এখন চান বিচার। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পর নরক নেমে এসেছিল দেশের অনেক সংখ্যালঘু পরিবারের নারীর জীবনে। কেবল নারীদের ওপর শারীরিক নির্যাতন নয়, বিজয়গর্ব আর প্রতিশোধপরায়ণতায় মত্তরা নির্বাচনের পর দেশজুড়ে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের শত শত ঘটনা ঘটিয়েছিল। সংখ্যালঘুদের জন্য সৃষ্টি হয়েছিল বিভীষিকাময় এক পরিস্থিতি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ২০০১ সালের ১ থেকে ২৭ অক্টোবর সময় পর্যন্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৭ জন খুন হন। ধর্ষিত হন ৬১ জন। যৌন নিপীড়নের শিকার হন ৬৪ জন। হামলায় আহত হন সাড়ে ৬০০। অপহূতের সংখ্যা ১৩। এ ছাড়া হিন্দুদের অসংখ্য দোকানপাট ও বাড়িঘরে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করা হয়। কিছু স্থানে আদিবাসী ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের লোকজনও হামলার শিকার হন। প্রায় সব ঘটনাতেই নির্বাচনে জয়ী বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ। বেশির ভাগ স্থানেই থানা মামলা নেয়নি। আবার মামলা হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। ২০০২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩ মাসজুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। এর কারণ উদ্ঘাটন ও জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ হাইকোর্টে একটি রিট করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে ২০১০ সালে গঠিত হয় তদন্ত কমিশন। এ কমিশনের প্রতিবেদনের প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার সিরাজগঞ্জ, বরিশাল, ভোলা ও ফরিদপুরের নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা। নিরাপত্তা চান লর্ড হার্ডিঞ্জের সংখ্যালঘুরা ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পরদিন ভোলার লালমোহন উপজেলার লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের চর অন্নদাপ্রসাদ, পিয়ারীমোহন ও ফাতেমাবাদ গ্রামের সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বিচারে হামলা চলে। হামলা থেকে বাঁচতে ভেণ্ডরবাড়ী গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন হিন্দু নারীরা। বিএনপির সমর্থকেরা সেখানেও হানা দিয়ে রাত ১০টা থেকে ভোর পর্যন্ত নিপীড়ন ও লুটপাট চালায়। চর অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের আট বছরের যে মেয়েটি ধর্ষিত হয়েছিল সে এখন আর বাড়িতে থাকে না। বাড়িতে ছিলেন ৮০ বছরের বৃদ্ধা ঠাকুরমা অবলা রানী বালা। প্রথম আলোর প্রতিবেদককে বললেন তিনি, ওই ‘কালিমার কতা’ ভুলতে পারবেন না তারা কোনো দিন। লর্ড হার্ডিঞ্জের সব নির্যাতিত সংখ্যালঘু পরিবারের মনোভাবই এ রকম। তাঁরা একটি নিরাপদ, আশঙ্কামুক্ত জীবন দাবি করেছেন সরকারের কাছে। অনেকেই এলাকাছাড়া। এলাকাবাসীর বক্তব্য অনুযায়ী কেউ দেশ ছেড়েছেন, কেউ পাড়ি জমিয়েছেন অন্য জেলায়। অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের মেন্টর বাড়ির বিনোদ চন্দ্র দাস (৬০) প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সব সময় আতঙ্কে থাকি আবার যদি ২০০১ আসে। আবার যদি...।’ কান্নায় গলা বুজে আসায় কথা শেষ করতে পারেননি বৃদ্ধ। একটু সামলে নিয়ে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় এই এলাকার অনেক হিন্দুকে জীবন দিতে হয়েছে। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ দাঙ্গার সময়েও হামলা হয়েছে। ২০০১ সালে গেছে নারীর সম্ভ্রম।’ বিনোদ চন্দ্র দাস আক্ষেপ করে বলেন, লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নে ৪০ বছর হিন্দু চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন সেই ইউনিয়নে একজন হিন্দু ইউপি সদস্য হিসেবেও নির্বাচনে দাঁড়াতে ভরসা পান না, কারণ সংখ্যালঘু ভোটারই নেই। অনেকেই পৈতৃক ভিটা পরিচিত মুসলমানের হেফাজতে রেখে চলে গেছেন। গতকাল সোমবার ইউনিয়নের অন্নদাপ্রসাদ, ফাতেমাবাদ ও পেরীমোহন গ্রামে ঘুরে জানা যায়, ২০০১ সালের ২ অক্টোবর রাতে একটি হিন্দু পরিবারও নির্যাতনের হাত থেকে বাদ যায়নি। অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা বকুল রানী দাস বলেন, ‘আমরা নেতা-নেত্রীগো কইয়্যা দিছি, বাবা! আইজ বাদে কাইল মইর্যা জামু । নিজের দ্যাশোত্ মরতাম চাই। আমরা কাউরে ভোট দিমু না। আমনারা য্যারে খুশি আমাগো ভোট দিয়া লইয়েন। তবুও আমরা নৌকায় ভোট দেই কইয়্যা আমাগোরে মাইরেন না।’ লর্ড হার্ডিঞ্জের পরে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছেন দৌলতখান উপজেলার চরপাতা ইউনিয়নের হিন্দুরা। এখানকার সরকারবাড়ি ও তার আশপাশে ২ অক্টোবর রাত নয়টায় দুর্বৃত্তরা আক্রমণ করে। এ ছাড়া ভোলা সদরের উত্তর দিঘলদীর জয়গোপী, আলীনগরের ঠাকুরবাড়িসহ একাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হয়। বরিশাল: নির্বাচনের পরদিন থেকেই বরিশালের গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে হামলা চলে। অনেকেই ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যায়। দুই থানার ২০টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ আশ্রয় নেয় গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার রামশীল গ্রামে। গৌরনদী উপজেলার বিল গ্রামের ধর্ষণের শিকার ৩০ বছরের এক নারী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তিনি গৌরনদী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি কালীয়াদমন গুহর রাইস মিলে কাজ করতেন। নির্বাচনের পরে সরকারি দলের সন্ত্রাসীরা চাঁদার দাবিতে মিলটি বন্ধ করে দেয়। কর্তৃপক্ষ মিল চালু করতে গেলে যুবদলের সন্ত্রাসীরা হামলা চালায় এবং তাঁকে ধর্ষণ করে। তাঁকে পরে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। নির্যাতিত এ নারী বলেন, পুলিশ তখন তাঁর জবানবন্দি রেকর্ডসহ ধর্ষণের আলামত উদ্ধার করলেও ১০ বছরেও এর বিচার হয়নি। আগৈলঝাড়া উপজেলার সুতারবাড়ি গ্রামের পঙ্গু সঞ্জীব জানান, ওই নির্বাচনের পর তাঁর বাড়িতে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট চালায়। তাঁকে ও পরিবারের নারী ও শিশুদের গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে আহত করে। সঞ্জীব অভিযোগ করেন তিনি এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা ১২০ শতাংশ দীঘির প্রায় ১০ লাখ টাকার মাছ লুট করে। চাঁদশী গ্রামের নির্যাতিত কৃষ্ণ কান্ত দে অভিযোগ করেন, ৩ অক্টোবর জোট সরকারের সমর্থক ক্যাডাররা সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রামটিতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তারা হামলা চালিয়ে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নারীদের ধর্ষণ করে। হুমকির মুখে বা লোকলজ্জায় কেউ মামলা করেনি। কৃষ্ণকান্ত বলেন, হামলার পরের দিন তিনি ছোট ভাইকে নিয়ে বোরকা পরে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে পাশের রামশীলে আশ্রয় নেন। ইল্লা গ্রামের নির্যাতিত প্রণবরঞ্জন ওরফে বাবু দত্ত জানান, ক্যাডাররা তাঁকে না পেয়ে বৃদ্ধ বাবা-মাকে কুপিয়ে জখম করে ও বাড়িতে লুটপাট চালায়। পরের দিন রান্না করে খাবার মতো কোনো হাঁড়ি-পাতিলও ঘরে রেখে যায়নি সন্ত্রাসীরা। তারা বাড়ির মন্দিরেও আগুন দেয়। গৌরনদীর উত্তর চাঁদশী গ্রামের রিপন বাড়ৈ, গৌরাঙ্গ দাস, হরিপদ বিশ্বাস, মন্জু রানী এবং আগৈলঝাড়া উপজেলার পতিহার গ্রামের নিতাই রঞ্জন, বাকাল গ্রামের সুধীর বালা, নলচিড়া গ্রামের অভিজিৎ, রাজিহার গ্রামের কমলা রানীসহ নির্যাতিত আরও অনেকেই জানান, তাঁরা বিচারের অপেক্ষায় রয়েছেন। ফরিদপুর: ফরিদপুরের বিভিন্ন উপজেলার হিন্দু সমপ্রদায়ের ওপর নেমে এসেছিল অমানিশার অন্ধকার। বাড়িতে হামলা, লুটতরাজ, নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো মামলা হয়নি। নগরকান্দা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ফুলসুতী ইউনিয়নের বাউতিপাড়া গ্রামের সবিতা মণ্ডল, কাননবালা মণ্ডল, আনন্দ মণ্ডল, শেফালী মণ্ডল ও অসীম মণ্ডল জানান, সে সময় গ্রামের ৮৫টি হিন্দু পরিবার প্রায় এক মাস সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে বাড়িতে থাকতে পারেনি। সন্ত্রাসীরা দলবদ্ধভাবে ওই গ্রামে হামলা চালিয়েছে। এ ছাড়া তালমা ইউনিয়নের মানিকদি, চর যশোরদি ইউনিয়নের চাঁদেরহাট বাজার, পুরা পাড়া ইউনিয়নের মজলিসপুর, মাজারদিয়া ইউনিয়নের আইনপুর বাজার ও মাজারদিয়া গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘুদের ওপর সে সময় এ তাণ্ডব বয়ে গেছে। সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র সুব্রত মণ্ডলের বাড়ি বাউতিপাড়া গ্রামে। তিনি জানান, ২০০১-এর তাণ্ডবের পর অনিল মণ্ডল, দিলীপ বাড়ৈ, বাসুদেব বাড়ৈ, রসো মণ্ডল, সুনীল মণ্ডল, সুশীল বাড়ৈ ও লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাসের পরিবার দেশ ছেড়ে চলে গেছে। একই গ্রামের শেফালী রায় জানান, তাঁর বাবা মুকুন্দ রায় এ ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং দুই মাসের মধ্যে মারা যান। মাঝারদিয়া ইউনিয়নের আইনপুর বাজারে তপন দাসের দোকানের সব মিষ্টি নির্বাচনের তিন দিন পর লুট করে নিয়ে যায় এলাকার সন্ত্রাসীরা। একই এলাকার মাধব চন্দ্র বিশ্বাস নির্বাচনের দুদিন পর ১৫ মণ পেঁয়াজ হাটে নিয়ে যাওয়ার পথে সন্ত্রাসীরা তা লুট করে। মাধব বলেন, ‘আমি ভয়ে মামলা করতে সাহস পাই নাই।’ তালমা ইউনিয়নের মানিকদি গ্রামের বাসিন্দা সঞ্জিত মণ্ডল বলেন, ৭ অক্টোবর সকালে পাশের শাকপালদিয়া ও মানিকদি গ্রামের ৩০০-৪০০ লোক রহমান খাঁ, ইউনুস মোল্লা, চান মোল্লা, দবিরউদ্দীন মোল্লা ও শামসু খলিফার নেতৃত্বে সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর ওপর হামলা চালায়। সঞ্জিত বলেন, এ ব্যাপারে তিনি বাদী হয়ে মামলা করলেও ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ তা খারিজ হয়ে যায়। সিরাজগঞ্জ: সিরাজগঞ্জের সদর, শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়ায় সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের ঘটনা ঘটে। নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় নির্যাতিত সিরাজগঞ্জের সেই মেয়েটি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যেখানে থাকি সেখানে প্রায়ই আসামিদের আত্মীয়স্বজনকে ঘোরাফেরা করতে দেখি। সে কারণে আমি বেশির ভাগ সময় বোরকা পরে চলাফেরা করি। কারণ, আমাকে কে নিরাপত্তা দেবে’? মেয়েটি জানান, দীর্ঘ ১০ বছর পর আগামীকাল বৃহস্পতিবার তাঁর ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের করা মামলার রায় ঘোষণা হবে। মেয়েটি বলেন, ‘আমার মতো আর কোনো বোন যেন এ রকম নির্যাতন ও ভোগান্তির শিকার না হয়। কাউকে যেন বিচার পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে না হয়।’
বিএনপি এর কথা হল এটা রাজনৈতিক ঘটনা। তাহলে কেন ২০০১ সালের ৫ অক্টোবোর দীনদয়াল আশ্রম পোড়ানো হল? কেন ভোলাতে মন্দির ভাঙ্গা হল? বিএনপি এর জবাব দিতে পাড়বে?
আমরা নির্যাতিত, আমাদের মুখ উচু করে কথা বলতে নেই, আমাদের বিচার চাইতে নেই, আমাদের শুধু সহ্র্য করতে হবে। আর নীরবে চোখের জল ফেলে উপরওয়ালার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। ওরা আমাদের উপর নির্যাতন করবে এটা আমাদের আশীর্বাদ মনে করতে হবে।