প্রথম পর্বের পর
২য় পর্বের পর
খনার বিজ্ঞান।
ভারতীয় উপমহাদেশে যুগে যুগে
নারী পণ্ডিতরা সম্মানিত হয়ে আসছেন। অপালা, বাক, গার্গী প্রমুখের ধারাবাহিকতায় আর একটি অমর নাম খনা। লোকজ জীবনের বিভিন্ন দিক, তথা কৃষি, রন্ধন, খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস, প্রাত্যাহিক, গৃহ-নির্মাণ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে খনার উপলব্ধি অসাধারণ। পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞান অথবা বুদ্ধিবৃত্তিক পাণ্ডিত্য যেভাবেই আমরা ব্যাখ্যা করি
না কেন খনা’র সমান মর্মদৃষ্টি একালেও অনেক পণ্ডিতের মধ্যে বিরল।
লেখকের মতে "অনেকের মতে, খনা কেবল ‘লোকবচন’ বা ‘লোকশাস্ত্র’। খনার
কাজকে বিজ্ঞানের চর্চা বলতে অনেকে নারাজ। আমরা
খনার কাজকে বিজ্ঞান বলতে চাই। খনা কেন
বিজ্ঞান? বিজ্ঞান বিষয়ে লম্বা তর্কে এখানে ঢোকার সুযোগ নেই। আমরা এখানে শুধু এটুকু বলতে চাই, খনা বিজ্ঞান এই জন্য যে তার চর্চার একটা
বিকাশশীল পদ্ধতি আছে। খনা বিজ্ঞান এই জন্য যে তা সামান্য ও বিশেষ
জ্ঞান উৎপাদন
করে। খনা বিজ্ঞান এই জন্য যে তা সামান্য ও বিশেষ
সত্য উৎপাদন
করে।”
খেয়াল করুন সমস্তই সাধারণের
জীবন ঘনিষ্ঠ। জলকাদা সম্ভূত। অসংখ্য খনার বচন আমাদের কৃষিজ জীবনের কথা বলে। যা থেকে আমাদের শিল্প-অর্থনীতি দৈনন্দিন জীবন বিচ্ছিন্ন। আর সবচেয়ে বড় কথা আমাদের সেই মানুষগুলো আর তাদের সাহিত্যরস হারিয়ে যাচ্ছে। এই লিখার মূল উদ্দেশ্য খনার রাজনৈতিক গুরুত্ব উপলব্ধি। আগামী পর্বে এই বিষয়ে আলোচনার আশা রাখি।
ডাক বচনও আছে। পরবর্তীতে তাও আলোচনার অংশ হবে।
ডাকের বচন
খনার বচন আমরা জানি। কিন্তু ডাকের বচনকে অতটা চিনিনা। অথচ
ডাকের বচন এককালে বাংলাদেশে প্রচলিত ছিল। কৃষক ও
বউঝিরা এই বচনগুলোকে কণ্ঠস্থ করে রাখতেন। তবে খনার
বচন বেশি প্রচলিত বলে তার ভাষা কালক্রমে সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু ডাকের বচন অতটা প্রখ্যাত হয় নি বলে তার ভাষার প্রাচীনতা অনেকাংশেই
রক্ষা পেয়েছে। ‘ডাক’ কোন ব্যক্তিবিশেষের নাম নাও হতে পারে। হয়ত
একাধিক ব্যক্তি কালক্রমে বিশেষ জ্ঞানের যে পদগুলো রচনা করেছেন তাকেই ডাকের বচন বলা
হয়। ডাক শব্দটি ডাকিনী শব্দের পুংলিঙ্গ হতে পারে। মধ্যযুগে বা প্রাচীন যুগে জ্ঞানী ব্যক্তিরা আধিভৌতিক শক্তির অধিকারী ছিলেন বলে
অনেকে মনে করেন। "চলিত কথা’ অর্থেও ডাকের বচন কথাটি প্রযুক্ত হতে পারে। দীনেশচন্দ্র সেন অবশ্য ডাক’কে বঙ্গের সক্রেতীস্ বলেছেন। (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, ১ম খণ্ড, ১৯৯৬, পৃ. ৯৪)
খনা কৃষক ও গ্রহনক্ষত্র বিষয়ে
পণ্ডিত ছিলেন। তার বচনগুলির বেশিরভাগ কৃষিকাজ ও ভাগ্যগণনা
সম্পর্কিত। কিন্তু ডাকের বচন কিছুটা ভিন্নরকম। এখানে মানব-চরিত্রের বিভিন্ন দিককে কখনও নির্মোহ কখনও বা সরাসরি ব্যাখ্যা করা
হয়েছে। মানবজীবনের সারাৎসার ডাকের বচনগুলির অন্যতম আলোচ্য বিষয়। ধারণা করা হয় এই ডাকের বচনগুলি ৮০০-১২০০ খৃস্টাব্দের মধ্যে রচিত হয়েছিল।
ডাকের বচনের একটি উদাহরণ
ক) ঘরে আখা বাইরে রাঁধে।
অল্প কেশ ফুলাইয়া বাঁধে।।
ঘন ঘন চায় উলটি ঘাড়।
ডাক বলে এ নারী ঘর উজার।।
খ) ষোল চাষে মুলা। তার অর্ধেক তুলা।
তার অর্ধেক ধান। বিনা চাষে পান।।
অর্থাৎ খনার বচন অনুসারে ধান বুনতে চার চাষের প্রয়োজন। কৃষি-বিজ্ঞানীদের মতেও তাই। জরিপে
দেখা যায় ৭২% কৃষকই পাঁচ চাষের পক্ষে অভিমত দিয়েছেন। চার চাষের পক্ষে গড়ে ১৩% কৃষক রায় দিয়েছেন। এর কারণ আছে, সাধারণত আমাদের দেশের যে সমস্ত কৃষকরা হাল বলদের অভাবে ভোগে তারা পাঁচ চাষেই
আস্থা পান। যাদের শক্ত সামর্থ্য গরু এবং হাল আছে তাদের
পক্ষে চার চাষই যথেষ্ঠ। ফলে খনার এই বচন অবস্থাসম্পন্ন কৃষকদের জন্যেই
যা আমাদের অতীত সমৃদ্ধির নজির। খনার
আমলে মানুষের চাইতে কৃষি জমির সংখ্যা ছিল বেশি। শুধু রাজস্ব মিটিয়ে ইচ্ছামত জমিতে চাষ করা যেত। প্রাচীন কালের কৃষকরাও ছিলেন সবল। ফলে চার
চাষই যথেষ্ট ছিল। এই সম্পর্কিত খনার আরেকটি চন আছে- সবল গরু
গভরি চাষ। তাতে পুরে মনের আশ।। এই সংক্রান্ত আরো কিছু বচন আছে যা আমাদের কৃষিজ সংস্কৃতি, প্রাণী এবং মানুষের সম্পর্ক প্রভৃতি বিষয়কে তুলে আনে।
#গাই দিয়ে বায় হাল। দুঃখ তার চিরকাল।।
#গরুর মুখে ঘাস পানি। হাল গৃহস্থি পরে জানি।
#বাপ বেটায় চাষ চাই। তদ অভাবে সোদর ভাই।।
#কার্তিকের ঊনজলে। খনা বলে দুনো ফলে।।
-কার্তিক মাসে ধান ক্ষেতে কম
পানি থাকলে ও কম বৃষ্টি লে দ্বিগুন ফসল ফলে। কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও দিনাজপুরের কৃষকেরা ৯৯%, ৯৭% ও ৯৮% রায় দিয়েছেন এই বচনের পক্ষে।
#চাঁদের সভার মধ্যে তারা। বর্ষে
পানি মুষল ধারা।
-চাঁদের সভা বিষয়টি আমি বুঝিনি
কেউ বুঝে থাকলে জানাবেন। তবে আমাদের কৃষকদের প্রকৃতি সম্পর্কিত জ্ঞানের
বিষয়টিই এখানে উঠে আসে। এখনকার ৪৫% কৃষক মনে করেন এই অবস্থায় বৃষ্টি
হয়। সম্ভবত চন্দ্র সভা কদাচিৎ দেখা যায় যে কারণে এই সম্পর্কে কেউ জানেন না। প্রসঙ্গত, ১৩৮৫ সালে জৈষ্ঠ্য মাসের এক সন্ধ্যায় ক্ষুদ্রাকৃতির এক চন্দ্রসভা দেখা যায় এবং
পরদিন অনেক বৃষ্টি হয়।
#মাঠে গিয়ে আগে দিক নিরূপণ। পূর্ব
দিক হতে কর হাল চালন।।
-এই বিষয়ে রায় দিয়েছেন ৭৯% কৃষক
যারা দক্ষিণ হতে পূর্বে হাল শুরুর পক্ষে। যে কোন
দিকের পক্ষেও মত আছে। তবে বিষয় হচ্ছে এই জরিপের লোকেরা কৃষি ঘনিষ্ট
নন। আরো একটি বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ, ইসলাম ধর্মের আগমনের পরে খনার বচনের নানা
দিকের মধ্যে এই বচনটিও পাল্টে গেছে। ময়মনসিংহের
একজন মাওলানা পশ্চিম দিক থেকে হাল চালনা শুরুর কথা বলেছেন তিনি মনে করেন কাবার দিক
হতেই হাল চলনা করা উচিত। যাইহোক, খনার পূর্ব দিক দক্ষিণ-পূর্ব দিকও হতে পারে। পূর্ব দিক হতে হাল শুরু করে ক্রমশ পশ্চিমে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। বংশানুক্রমিক বিবর্তনে তা হয়তো পাল্টে গেছে। পরবর্তী পর্বে সমাপ্য
|