প্রথম পর্বের পর
বোবার বিজ্ঞান
প্রচলিত গল্পে খনা ছিলেন
লঙ্কাদ্বীপের রাজকুমারী। মতান্তরে রাক্ষসকবলিত কোনো এক রাজ্যের
অনিন্দ্যসুন্দর রাজকুমারীর নাম ছিল লীলাবতী যিনি পরে খনা নামে পরিচিত হন। খনা অর্থ বোবা এবং জিহ্বা কর্তনের পর নামটি প্রতিষ্ঠা পায়। কথিত আছে, জ্যোতিষশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞানের ফলে খনা প্রায়ই রাজসভাতে আমন্ত্রিত হতেন। ফলে প্রতিহিংসাপরায়ণ শ্বশুর বরাহ মিহির ছেলে মিহিরকে লীলাবতীর জিহ্বা কাটার
নির্দেশ দেন। বাবার নির্দেশে মিহির খনার জিহ্বা কর্তন করেন। তবে গল্পমতে কথিত রাজকন্যা স্বামীর কাছে অনুরোধ করেন যে, জিহ্বা কর্তনের আগে কিছু বলতে চান। স্বামী
অনুমতি দেন। এ সময় খনা আবাদ, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, যাত্রা, গবাদি, শস্যাদি, ফলাদি, গ্রহ-নক্ষত্রাদি সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত বচন
দেন যা পরে খনার বচন নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়। খনার বচন সবচেয়ে বেশি প্রচলিত কৃষক সামজে; যাদের কোনো লিখিত ভাষা নেই। মুখে মুখে প্রচলিত এসব ভাষা যুগ যুগ ধরে তাদের কৃষিকাজ এবং জীবনাচারে প্রভাবিত
হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানীরা বিষয়টিকে সোজা চোখে না
দেখলেও খনার বচন তার অবশ্যম্ভাব্যতা থেকে কক্ষচ্যুত হয়নি। বরং গ্রামের কৃষকরা বিজ্ঞানের ভাষার চেয়ে প্রবাদ-প্রবচনে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ
করে। তবে অনেক বিজ্ঞজন খনার বচনকে আধুনিক বিজ্ঞান
হিসেবে অভিহিত করতে গিয়ে প্রবচনগুলো খনার বিজ্ঞান হিসেবে অভিজ্ঞান করেন। বচনগুলো অষ্টম অথবা নবম শতাব্দীতে রচিত। তবে আজো
তা নির্ভুল ও সূক্ষ্মদৃষ্টিসম্পন্ন নীতিবাক্য হিসেবেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত।
খনাকে বিশ্লেষণের আরো পথ আছে-
রণদীপম বসু বলেছেন
আমাদের সাহিত্যের লৌকিক বাংলায়
ছন্দের প্রথম দোলাটা প্রথম কাকে কখন কোথায় কীভাবে দিয়েছিলো তা জানার সুযোগ না হলেও
‘খনা’ নামের আড়ালে মূলত লোকায়ত জনভাষ্যগুলোই যে মৃত্তিকালগ্ন জীবনলগ্ন হয়ে বহুকাল
যাবৎ আমাদের জনরুচিকে চটুল নৃত্যে দুলিয়ে এসেছে তা সহজেই অনুমেয়। উঠতে বসতে বিবাহে যাপনে ফসলে বুননে হাসিতে আড্ডায় দুঃখে কষ্টে এক কথায় বাঙালি
জীবনের প্রতিটি স্পন্দনে শিক্ষণীয়, নিন্দনীয়, বিদ্রুপ কটাক্ষ বা নির্দোষ মজা করার যে
শ্লোকগুলো এখনো ভেসে বেড়ায় গ্রামবাংলার লৌকিক জনপদে মুখে মুখে, এগুলোর রচয়িতার নাম কেউ না জানলেও এতে ছন্দের চমৎকারিত্ব, বুদ্ধির ঝিলিক আর জীবনঘনিষ্ট শব্দের আশ্চর্য
শক্তিমত্তায় সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। ‘কলা রুয়ে না কেটো পাত/ তাতেই কাপড় তাতেই ভাত। অথবা ষোল চাষে মুলা/ তার অর্ধেক তুলা/ তার অর্ধেক ধান/ বিনা চাষে পান’ (খনার বচন)। আমাদেরই পূর্বপুরুষদের এই সৃষ্টিশীল
উজ্জ্বলতাগুলো নিজস্ব ক্ষমতাশৈলীর জোরেই স্বমহিমায় টিকে আছে এখনো। শাসন করছে লোকায়ত মনোভূমিকে। এগুলোই
বচন, শোলক বা ছড়া নামে সমধিক পরিচিত হয়ে আসছে।
খুবই লক্ষণীয় যে, প্রায় সব ছড়াতেই আমাদের লৌকিক কবিরা স্বরবৃত্তের হালকা চটুল ছন্দ ব্যবহার
করেছেন। স্বরের স্বতঃস্ফূর্ত গতিদোলার সাথে স্বাভাবিক
শ্বাসাঘাতের অনুরণনের মাধমে ছন্দশীল কথাগুলো প্রাকৃতিকভাবেই এগিয়ে যায় বলে কবিগুরু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ছন্দকে প্রাকৃতিক বা লৌকিক ছন্দ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। হালকা চালের এই ছড়াগুলোতে সমকালীন লোকজীবনের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক
সমস্যাগুলোকেও লোকায়ত জীবনধারার সাথে মিশিয়ে আশ্চর্য নিপুনতায় প্রকাশ করা হয়েছে। ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে/
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেবো কিসে?/ ধান ফুরুল, পান ফুরুল খাজনার উপায় কি?/
আর কটা দিন সবুর কর, রসুন বুনেছি।’
কিশোরকবিতা’র কোষ্ঠীবিচার করতে হলে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত লৌকিক কবিদের এই লোকায়ত
ধারাটিকে কিছুতেই ভুলে যাওয়া চলবে না আমাদের।
|