খনা এই নামটি নিয়ে আছে নানা কিংবদন্তি। খনা ছিলেন সিংহল রাজার কন্যা। এক শুভক্ষণে তার জন্ম বলে নাম দেওয়া হয় ক্ষণা। আর ‘ক্ষণা‘থেকেই ‘খনা‘নামের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। খ্রিস্টীয় ৫০০ অব্দে প্রাচীন ভারতবর্ষের অবন্তী রাজ্যের রাজা ছিলেন বিক্রমাদিত্য। তার রাজপ্রাসাদের প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিদ ছিলেন বরাহমিহির। বরাহের ঘরে পুত্রসন্তান জন্ম নিলে নাম রাখেন মিহির। শিশুটির কষ্ঠি বিচার করে তিনি দেখলেন, শিশুটির পরমায়ু মাত্র এক বছর। তাই বরাহ একটি পাত্রে মিহিরকে রেখে সমুদ্রজলে ভাসিয়ে দেন। পাত্রটি ভাসতে ভাসতে এসে উপস্থিত হয় সিংহল দ্বীপের উপকূলে। পরে রাজা তাকে তুলে নিয়ে লালন-পালন করেন এবং খনার সঙ্গে বিয়ে দেন। দু‘জনই জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শিতা লাভ করে। মিহির খনাকে নিয়ে নিজ জন্মভূমিতে ফিরে আসেন। পিতার মতো মিহিরও বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় প্রতিপত্তি লাভ করেন। একদিন রাজা আকাশে নক্ষত্রের সংখ্যা কত জানতে চাইলে পিতা-পুত্র তা নির্ধারণে অক্ষম হয়ে খনার সাহায্যে কৃতকার্য হন। এতে সম্মানহানির ভয়ে মিহির খনার জিহ্বা কেটে ফেলেন। এর কিছুদিন পরই খনার মৃত্যু হয়।
কিন্তু এই কিংবদন্তি কাহিনী সত্য কি-না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, বিক্রমাদিত্যের শাসনামলে বরাহমিহির একজনই ছিলেন। তবে খনার বচনগুলোর অধিকাংশ লিখিত হয়েছে বাংলায়। বচনগুলোর ভাষা বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলছেন, এগুলোর রচনাকাল ৪০০ বছর আগের নয়। কিন্তু
বরাহমিহিরের আবির্ভাবকাল প্রায় দেড় হাজার বছর আগে! বরাহমিহিরের জাতক
প্রভৃতি জ্যোতিষ গ্রন্থের সঙ্গে খনার বচনের কতগুলো অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়। কৃষিসংক্রান্ত নানা বিষয় সম্পর্কে খনার বচনগুলো অমূল্য সম্পদ এবং কৃষিজীবীদের কাছে খুবই আদরণীয়।
খনার কিংবদন্তি
১. তাকে নিয়ে প্রচলিত নানা কাহিনী।এদের সাধারণ সুতোটি হচ্ছে, উপমহাদেশের প্রাচীনরাজ্য অবন্তী (Avanti)তথা উজ্জয়নের (Ujjain)রাজা হর্ষ-বিক্রমাদিত্যের (Harsha Vikramaditya)রাজপ্রাসাদে প্রধান জ্যোতির্বিদ ছিলেন বিখ্যাত পন্ডিত বরাহমিহির(Varahamihira),আনুমানিক ৫০০ খ্রীষ্টাব্দের কথা।বরাহমিহিরের পুত্র জন্মগ্রহণ করলেতিনি পুত্রের কোষ্ঠি (horoscope)বিচার করে প্রচন্ড ভয় পেয়ে যান।হিসেব করে দেখেনমাত্র এক বছরের মধ্যেই মারা যাবে তার প্রিয় শিশুপুত্র।পিতা হয়ে পুত্রের মৃত্যুঅসহায়ের মত অবলোকন করতে হবে আর ভয়ংকর দিনগুলি গণনা করে যেতে হবে, এই চিন্তা সহ্যকরতে না পরে তিনি ভাসিয়ে দেন পুত্রকে, পাত্রে ভরে নদীর স্রোতে।
অনেক দূরের এক রাজ্যে, নদী থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে রাক্ষস সম্প্রদায়।কিন্তুমারা যায় না শিশু, বড় হতে থাকে রাক্ষসদের মধ্যে।ষোল বছর বয়সে শাণিত বুদ্ধির একরাক্ষস মেয়ের প্রেমে পড়ে যায় সে, বিয়ে করে তাকে।মেয়েটি তার জ্যোতির্জ্ঞান প্রয়োগকরে জানতে পারে তার স্বামী মিহির উজ্জয়নের বিখ্যাত পন্ডিত বরাহমিহিরের পুত্র।একদিনদুজন মিলে রওয়ানা দেয় উজ্জয়নের পথে।
পুত্র-পুত্রবধুর পরিচয় পেয়ে রাজপ্রাসাদে তাদের গ্রহণ করেন বরাহ।কৃষিকাজেমেয়েটির ছিল অগাধ জ্ঞান আর গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বিচার করে আবহাওয়ার চমৎকারপূর্বাভাস দিতে পারত সে।উজ্জয়নের কৃষকরা ব্যাপক উপকার লাভ করে তার কাছ থেকে, আর তাদেখে রাজা বিক্রমাদিত্য মেয়েটিকে তার রাজ্যের দশম রত্ন (tenth jewel)হিসেবে আখ্যদেন।মেয়েটির জ্ঞানে সারা রাজ্য রাজপ্রাসাদ মুগ্ধ হয়ে রইল, পন্ডিত বরাহের খোঁজ আর কেউনেয় না।এমনকি বরাহ নিজেও জনসমক্ষে এক বিতর্কে পুত্রবধুর হাতে পরাস্ত হন।ঈর্ষাপরায়ণ বরাহ তাই এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পুত্রকে আদেশ দেন মেয়েটির জিহ্বা কেটেফেলতে যাতে চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায় তার কন্ঠ।আর ঘটেও যায় এই মর্মন্তুদ ঘটনা!
উড়িষ্যার উপাখ্যানটিতে বর্ণিত আছে, রক্তক্ষয়ী এই ঘটনার পর মেয়েটির নাম হয় খনা, উড়িয়া ভাষায় যার মানে বোবা।
বাংলার এক কিংবদন্তীতে আছে, জন্মের পর মেয়েটির পিতা তার নাম রাখেন খনা কারণ তারজন্ম হয়েছিল এক শুভক্ষণে।কিন্তু বাংলার এই মেয়েটি বেড়ে উঠে লঙ্কা নামের রাক্ষসদ্বীপে (বর্তমানের Sri Lanka)।মধ্যযুগীয় কিছু বর্ণনায়, যেমন কালহানেররত্নরঙ্গিনীতে, বাংলার গৌড় (Gauda)কেই অবশ্য রাক্ষস রাজ্য (Kingdom of Demons) হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে।
বরাহমিহির প্রাচীন ভারতের (আনুমানিক ৫০৫ - ৫৮৭)
একজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং কবি। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান ছাড়াও
গণিতশাস্ত্র, পূর্তবিদ্যা, আবহবিদ্যা, এবং স্থাপত্যবিদ্যায় পণ্ডিত ছিলেন। এই মনীষীর জন্ম ভারতের অবন্তিনগরে। রাজা
বিক্রমাদিত্যের সভার নবরত্নের অন্যতম হিসেবে তিনি স্বীকৃত। ভারতীয়
পঞ্জিকার অন্যতম সংস্কারক ছিলেন তিনি। তিনিই বছর গণনার সময় বেশাখকে প্রথম
মাস হিসেবে ধরার প্রচলন করেন। আগে চৈত্র এবং বৈশাখকে বসন্ত ঋতুর অন্তর্গত
ধরা হতো। পৃথিবীর আকার এবং আকৃতি সম্বন্ধে তার সঠিক ধারণা ছিল। তার জন্ম
৫৮৭ ধরা হলেও কারও কারও মতে তা ৫৭৮। তার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে:
•পঞ্চসিদ্ধান্তিকা; ৫৫০ খ্রিস্টাব্দে রচিত
হয়। পাঁচটা খন্ড নিয়ে গঠিত এই বইটিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং
জ্যোতিষশাস্ত্রের সংক্ষিপ্তসার বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। পাঁচটি খন্ড
হচ্ছ: সূর্যসিদ্ধান্ত, রোমকসিদ্ধান্ত, পৌলিশসিদ্ধান্ত, পৈতামহসিদ্ধান্ত এবং
বাশিষ্ঠসিদ্ধান্ত। আরব দার্শনিক আল খোয়ারিজমি সূর্যসিদ্ধান্ত দ্বারা
অনুপ্রাণিত হয়ে আল জিবর ব আল মুকাবলা রচনা করেন বলে মনে করা হয়। •বৃহৎসংহিতা; একটি প্রসিদ্ধ জ্যোতিষ
গ্রন্থ যা পদ্য আকারে লিখা। এতে তিনি জ্যোতিষী দৃষ্টিকোণ থেকে বহু পাথরের
বিবরণ এবং পাক-ভারতের ভৌগলিক তথ্য সন্নিবেশিত করেন। এছাড়াও এতে সূর্য ও
চন্দ্রের গতি ও প্রভাব, আবহবিদ্যা, স্থাপত্য এবং পূর্তবিদ্যার নানা বিষয়
প্রসঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার কথা আলোচিত হয়েছে। এই বইয়েই
তিনি ব্রজলেপ নামে একটি বস্তুর প্রস্তুতপ্রণালী ব্যাখ্যা করেছেন যা
আধুনিককালের সিমেন্টের সমগোত্রীয় ছিল। সে সময় ভারতে বরাহমিহির উদ্ভাবিত
এই ব্রজলেপ দিয়েই বড় বড় দালান কোঠার ইটের গাঁথুনি তৈরীতে ব্যবহৃত হতো।
রহস্যময় এক ভগ্নাবশেষ
কোলকাতা শহরের ৪০ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে বারাসাত নগরীর কাছে বীরচম্পা(Berachampa) নামক জায়গায় গেলে দেখা যাবে প্রাচীন এক ভগ্নাবশেষ (ruins), মহাসড়কেরউভয়পাশে বিস্তৃত।দক্ষিণ পাশে পরিলক্ষ্যিত হয় প্রাচীন দুর্গ (fort) ওপ্রতিরক্ষাবেষ্টনি বা গড় (rampart) এর নিদর্শন।ধারণা করা হয়, এখানেই ছিল রাজাচন্দ্রকেতুর (Chandraketu) সাম্রাজ্য।কৃষিকাজ বা অন্যান্য খননকাজে মাটির নীচ থেকেপ্রায়ই বেরিয়ে আসে নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন (artefacts): মুদ্রা, পুঁতি(bead), প্রস্তর ও পোড়ামাটির ভাস্কর্য (stone & terracotta sculpture), গজদন্ত(ivory), উন্মোচন করে টুকরো টুকরো কত না ইতিহাস।নিদর্শনগুলির শুধু মাত্র সংখ্যারপ্রাচুর্যই মুগ্ধ করে রাখার মত যথেষ্ঠ।
২৪ পরগনা জেলায় অবস্থিত এই এলাকাটিতে ১৯৫০ এর দশকে কিছু খননকার্য হয়েছিল।রোমানও ভূমধ্যসাগরীয় মুদ্রা পর্যবেক্ষণ করে ঐতিহাসিকদের অভিমত, এখানকার স্থাপনাসমূহখ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের।পুরাতত্ত্ববিদগন (archeologist) এখানে মৌর্য্য (Maurya) ও গুপ্ত (Gupta) শাসনামলের নিদর্শনও আবিষ্কার করেছেন।কিন্তু তৈজসপত্রের টুকরা(pot-sherds) এবং গোলাকার সিলমোহরের (seal) উপর খোদাইকরা অভিলিখন (inscription) এরমর্মোদ্ধার করা এখনও হয়ে উঠেনি, ফলে রাজা চন্দ্রকেতুর সঠিক পরিচয় এবং সেই এলাকারইতিহাস এখনও আলো-আধাঁরিতে খেলা করে।
আর এখানেই, মহাসড়কের উত্তর পাশে শায়িত সমাধিফলকের মত এক ইঁটের স্থাপনা।বহুভুজাকৃতির উঁচু এই স্থাপনাটি কৌতূহল জাগানোর মত উত্তর-দক্ষিণে সুবিন্যস্ত, পাশেআরো কিছু স্থাপনা।এটিই খনা-মিহিরের মূড়া (Mound of Khona-Mihir) নামে পরিচিত।কিছুকিছু ঐতিহাসিক মূড়াটিকে গুপ্ত যুগের মন্দির হিসেবে অনুমান করলেও মন্দিরের পক্ষেজোড়ালো কোন নিদর্শন পাওয়া যায়নি এখানে।
এক বাঙ্গালী নারীর গৌরব যাত্রা
কিন্তু প্রাচীন এই ধ্বংসস্তুপের সাথে খনার নাম কেন জড়িত?খনা তো বেঁচে আছে শুধুতার ছন্দোময় জ্ঞানকথায়: আবহাওয়া, কৃষিকাজ, জ্যোতিষী শাস্ত্রে, আর কিছু ছন্দে যাতুলে ধরে তার শ্বশুর বরাহমিহিরের বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা।আসলে কে সে?
অনেক কথাই হয়তো বলা যায়।কিন্তু আমার ভাবতে খুব ভালো লাগে সেই কবে, পুরাকালে, বাঙ্গালী এক নারীর গৌরব-যাত্রা, বাংলার গৌড় থেকে বীরচম্পা হয়ে ভারতের অবন্তীতে, চারপাশে রেখে যাওয়া চোখ ধাঁধানো বাস্তবজ্ঞান আর মন মাতানো ছন্দ।
তারপর, সে এক বিষাদ গাঁথা, জ্ঞানের ছটা সহ্য করতে না পেরে তাকে বোবা-স্তব্ধ করেদিতে ঈর্ষাপরায়ণ কুচক্রীদের হীন বীভৎস ষড়যন্ত্র! কিন্তু কে কবে পেরেছে তা?কুচক্রীরদল মারা গেছে সেই কবে, বেঁচে আছে খনা, বেঁচে আছে তার কন্ঠ:
কলা-রুয়ে কেটো না পাত,
তাতে কাপড় তাতেই ভাত।
খনার উপাখ্যানে রাক্ষস সম্প্রদায়ের কথা শুনে একে নিছক পুরাকালের পরমকথা বলে হেসেউড়িয়ে দেবার উপায় নেই।গঙ্গার তীরে বাংলার দুর্ধর্ষ গঙ্গারিধি জাতি বহুবার থামিয়েদিয়েছিল বহিরাগত শত্রুর বিজয় অভিযান, পরাক্রমশালী আলেকজান্ডার সাহসই করেননি এইএলাকায় অভিযানের, আর্যরাও ঢুকতে পারেনি বহুকাল, আর তাই বহি:শত্রুরা ব্যর্থ মনোরথহয়ে অপমান-ক্ষোভে প্রায়ই বাংলার মানুষকে তাদের সাহিত্যে আখ্যা দিয়েছে রাক্ষস, দানব, বানর হিসেবে।
খনা কে নিয়ে আছে এক এক জনের এক এক মত । একে বলা হয়
খনা-মিহিরের মূড়া (Mound of Khona-Mihir)। এটা নিয়ে ও ঐতিহাসিক দের মাঝে আছে বিতর্ক
অসাধারণ একটা লেখা লিখেছেন দাদা। অনেক ভালো লাগলো পড়ে। তবে বর্তমানে খনার কাহিনী বলথে মানুষ z bangla এর খনা সিরিয়াল দেখে সব জেনে গেছে মনে করে। তবে চ্যানেলটিকে ধন্যবাদ।কারন এত সুন্দর একটি ঐতিহাসিক চরিত্রকে তারা আবার তুলে ধরেছে।