চানক্য-পণ্ডিতের কৌটিল্য-তত্ত্ব ইতিহাসের টেরাকোটায়
লিখেছেন রণদীপম বসু
(০১)
‘মন খাঁটি হলে পবিত্র স্থানে গমন অর্থহীন।’
এই দুর্দান্ত উক্তিটির বয়স দু’হাজার বছরেরও বেশি, প্রায় আড়াই হাজার বছর।
এটা চানক্য-শ্লোক বা বাণী। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কথাটা কতোটা বিশ্বাসযোগ্য ?
যদি বলি এর বিশ্বাসযোগ্যতা শূন্য ? একযোগে হামলে পড়বেন অনেকেই।
বিশ্বাসযোগ্যই যদি না হবে তো আড়াই হাজার বছর পেরিয়ে এসেও কথাটা এমন টনটনে
থাকলো কী করে ! আসলেই তা-ই। কথাটায় একবিন্দুও ফাঁকি দেখি না। হয়তো আমরাই
মানি না বলে। অথবা অক্ষরে অক্ষরে এতোটাই মেনে চলি যে, জানান দেবার আর বাকি
থাকে না- আমাদের মনটাই ফাঁকি, ওখানে খাঁটি বলে কিছু নেই। আর এজন্যেই কি
পবিত্র স্থানে গমনের জন্য হুমড়ি খেয়ে আমাদের মধ্যে এমন হুড়োহুড়ি লেগে যায় ?
অসুস্থ হলে যেমন আমরা হন্যে হয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটি, এটাও সেরকম। খোশগল্প
করার নিয়ত না হলে সুস্থাবস্থায় কেউ কি ডাক্তারের কাছে যান !
চানক্যের আরো কিছু বাণী-
"বিষ থেকে সুধা, নোংরা স্থান থেকে সোনা, নিচ কারো থেকে ভালো এবং নিচু পরিবার থেকে শুভ-লক্ষণা স্ত্রী- এসব গ্রহণ করা সঙ্গত।”
"মনের বাসনাকে দূরীভূত করা উচিত নয়। এই বাসনাগুলোকে গানের গুঞ্জনের মতো কাজে লাগানো উচিত।”
"যারা পরিশ্রমী, তাদের জন্য কোনকিছু হাসিল করা অসাধ্য কিছু নয়। শিক্ষিত কোন
ব্যক্তির জন্য কোন দেশই বিদেশ নয়। মিষ্টভাষীদের কোন শত্রু নেই।”
"বিরাট পশুপালের মাঝেও শাবক তার মাকে খুঁজে পায়। অনুরূপ যে কাজ করে অর্থ সবসময় তাকেই অনুসরণ করে।”
বাণী চিরন্তনী জাতীয় কোন গ্রন্থ না হলেও (kautilya) কৌটিল্যের
‘অর্থশাস্ত্রে’ চানক্যের (chanakya) এরকম অমর বাণী নিশ্চয়ই অপর্যাপ্ত নয়।
তা হবার কথাও নয়। কেননা প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম
প্রবক্তা হিসেবে তিনি তাঁর কালজয়ী সংস্কৃত গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্রে’
(Arthashastra) কিভাবে একজন শাসককে আরো ভূখণ্ড ও মূল্যবান সম্পদ নিজ
সাম্রাজ্যভুক্ত করে তাঁর প্রজাদের নিরাপত্তা, কল্যাণ ও জীবনমান উন্নত করার
জন্য কাজ করতে হবে তা লিপিবদ্ধ করেন। নামে অর্থশাস্ত্র হলেও গ্রন্থটি মূলত
শাসকের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রশাসন ও কূটনীতি বিষয়ক কৌশলের পরামর্শ। কিন্তু
প্রশ্ন হলো, রাজ্য শাসনের এতোবড়ো গুরুদায়িত্ব পালনের ফাঁকে শাসক-সম্রাটরা
কি আদৌ তা পড়তেন বা পড়ার সময় পেতেন ? নিশ্চয়ই পড়তেন। সাম্রাজ্য-শাসক হিসেবে
অত্যন্ত পরাক্রমশালী হলেও তাঁদের হয়তো এই বোধটুকু অন্তত ছিলো যে জ্ঞান ও
পাণ্ডিত্যের ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান শাসকদের মতো এতো মহাপরাক্রমশালী তাঁরা
ছিলেন না। রাজদরবারগুলোতে তাই তৎকালীন জ্ঞানীগুণী ও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে
পারদর্শী পণ্ডিতদের আনাগোনা থাকতো বলেই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।
উদাহরণ হিসেবে আমরা জানি যে, গুপ্ত বংশের বিখ্যাত সম্রাট দ্বিতীয়
চন্দ্রগুপ্ত যিনি বিক্রমাদিত্য নামেই সমধিক পরিচিত, তাঁর নবরত্ন সভার নয়জন
রত্ন ছিলেন- (১) ধন্বন্তরি (২) ক্ষপণক (৩) অমরসিংহ (৪) শঙ্কু (৫) বেতালভট্ট
(৬) ঘটকর্পর (৭) কালিদাস (৮) বরাহমিহির (৯) বররুচি। আর এ তথ্য পাই আমরা
মহাকবি কালিদাসের (kalidasa) বিখ্যাত সংস্কৃত গ্রন্থ
‘জ্যোতির্বিদ্যাভরণ’-এর একটি সংস্কৃত শ্লোকে-
"ধন্বন্তরি-ক্ষপণকামরসিংহ-শঙ্কু-বেতালভট্ট-ঘটকর্পর-কালিদাসাঃ খ্যাতোবরাহমিহিরোনৃপতেঃ সভায়ং রত্নানি বৈ বররুচির্ণব বিক্রমস্য।”
কিন্তু এযাবৎ যতজন পণ্ডিত-রত্নের কথা আমরা জানি, তাঁদের মধ্যে
চানক্য-পণ্ডিতকেই সবচাইতে প্রতিভাবান ও বাস্তববাদী বলে মনে হয়। তাঁর
অবস্থিতিকাল কালিদাস যুগেরও আগে। দার্শনিক প্রজ্ঞা আর কূটনৈতিক পরিকল্পনায়
সিদ্ধহস্ত এই অসাধারণ প্রতিভাধর পণ্ডিত চানক্যের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিলো
(vishnugupta) বিষ্ণুগুপ্ত (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০- খ্রিষ্টপূর্ব ২৮৩)। কিন্তু
জন্মগ্রাম ‘চানকা’ থেকে, মতান্তরে পিতার নাম 'চানক' থেকে, ‘চানক্য পণ্ডিত’
হিসেবেই তিনি ব্যাপক পরিচিত হয়ে ওঠেন সর্বত্র।
উপমহাদেশের উচ্চতর জ্ঞান আহরণের প্রাচীন ও শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপিঠ যেখানে,
খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে বর্তমান পাকিস্তানের সেই তক্ষশীলায় তাঁর
জন্ম এবং পরবর্তীতে তক্ষশীলা বিদ্যাপিঠেই একজন শিক্ষাগুরু হিসেবে ছিলেন বলে
জানা যায়। ফলে সেখানকার পরিবেশ তাঁর সহজাত প্রতিভাকে করে তুলেছে ক্ষুরধার
প্রজ্ঞায় উজ্জ্বল। ‘কূটিলা গোত্র’ থেকে উদ্ভুত ছিলেন বলে পরবর্তীতে গোত্র
নামটিকে টিকিয়ে রাখার সদিচ্ছা থেকে ‘কৌটিল্য’ ছদ্মনাম ধারণ করে লিপিবদ্ধ
করেন তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্র’। কিন্তু এই ‘অর্থশাস্ত্র’ তো আর
এমনি এমনি লিখিত হয়নি। এর পেছনের যে ইতিহাস, সেখানেই রয়ে গেছে একজন চানক্য
পণ্ডিত বিষ্ণুগুপ্তের কৌটিল্য হয়ে ওঠার ঘটনাবহুল পটভূমি।
কিংবদন্তী আছে, মগধ রাজ্যের পরাক্রমশালী নন্দ বংশের শেষ রাজা, যিনি তার
অন্যায় শাসনের জন্য প্রজাসাধারণের কাছে ভীষণ অপ্রিয় ছিলেন, একবার চানক্যকে
অপমান করেন। চানক্য এই অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। এদিকে নন্দ
রাজার পদস্থ ও উচ্চাভিলাষী তরুণ সামরিক কর্মকর্তা চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসন
দখলের ষড়যন্ত্র করেন। কিন্তু ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলে প্রাণ বাঁচাতে তাকে
বিন্ধালের জঙ্গলে পলাতক ও নির্বাসিত জীবন বেছে নিতে হয়। ঘটনাচক্রে চানক্যের
সাথে চন্দ্রগুপ্তের সাক্ষাৎ ঘটে। এই সাক্ষাতের ক্ষণলগ্নই যে একটা বিশাল
জাতিগোষ্ঠির ভাগ্যচাকার মোড় ঘুরিয়ে চিরকালের নতুন বাঁক তৈরি করে দেবে তা কে
জানতো। চন্দ্রগুপ্ত তাঁর জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম
হিসেবে চানক্যকে গুরু, উপদেষ্টা ও মন্ত্রণাদাতা হিসেবে মেনে নেন। অতঃপর
চানক্যের সক্রিয় সহযোগিতায় চন্দ্রগুপ্ত একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে
তোলেন এবং গুরুর সুনিপুণ পরিকল্পনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়ে শেষপর্যন্ত
নন্দরাজাকে সিংহাসনচ্যুত করতে সক্ষম হন। মগধের সিংহাসনে আরোহণ করে
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য়েরই দ্বিতীয়
পুরুষ হচ্ছেন বিন্দুসারা এবং তৃতীয় প্রজন্ম আরেক প্রতাপশালী শাসক সম্রাট
অশোক।
শক্তিশালী নন্দ বংশের শাসন উৎখাতের পেছনে চানক্যের দূরদর্শী পরিকল্পনা ও
কুশলী কর্মকাণ্ড অসাধারণ কৃতিত্ব হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছে। এবং তাঁর অবদানেই
সম্রাট অশোকের পিতামহ (chandragupta) চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে উপমহাদেশের
প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পঞ্চম শতাব্দিতে রচিত
প্রাচীন নাট্যকার বিশাখা দত্তের শতশত বছর জুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা রাজনৈতিক
নাটক ‘মুদ্রারাক্ষস’-এ নন্দবংশকে ক্ষমতাচ্যুত করে চন্দ্রগুপ্তের বিশাল
মৌর্যসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার চমৎকার বর্ণনা রয়েছে।
তবে এতৎবিষয়ক তথ্যসূত্রের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে যেটিকে বিবেচনা করা
হয়, তা হলো গ্রীক দূত মেগাস্থিনিসের ‘ইন্ডিকা’ (Indica)। খ্রিষ্টপূর্ব
চতুর্থ শতাব্দীতে মেগাস্থিনিস (Megasthenes) চন্দ্রগুপ্তের দরবারে অবস্থান
করে এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করেন বলে জানা যায়। এখান থেকেই জানা যায়
চন্দ্রগুপ্ত মগধের সিংহাসনে আরোহন করেই পাটালিপুত্রকে তার রাজ্যের
রাজধানীতে পরিণত করেন। বিহারের আধুনিক শহর পাটনার কাছেই ছিলো পাটালিপুত্রের
অবস্থান। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৮ সাল পর্যন্ত
চন্দ্রগুপ্তের শাসনকালে সমগ্র রাজ্য জুড়ে শান্তি বিরাজমান ছিলো। প্রজাদের
প্রতি ন্যায়পরায়ণ রাজা হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিলো এবং রাজ্য বিকশিত হয়েছিলো
সমৃদ্ধিতে। আর এগুলো সম্ভব হয়েছিলো চন্দ্রগুপ্তের জীবনে স্বর্গীয় দূতের মতো
অভিভাবক হয়ে আসা সত্যিকারের বন্ধু, দার্শনিক ও গুরু চানক্যের কারণে।
জানা যায়, এর আগে মহামতি আলেকজান্ডারের আকস্মিক মৃত্যুতে গ্রিক শাসনের
বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে যে বিদ্রোহের সূচনা হয়, গুরু চানক্যের পরামর্শে এ
পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে চন্দ্রগুপ্ত গ্রিক বাহিনীর উপর হামলা চালিয়ে
তাদেরকে পরাজিত করেন এবং পাঞ্জাবকে নিজ শাসনাধীনে আনেন। পরবর্তীতে পশ্চিম
ভারতের সকল রাজ্য একে একে জয় করে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন
চন্দ্রগুপ্ত। এই বিশাল সাম্রাজ্য দক্ষতার সাথে পরিচালনার জন্য তিনি একটি
মন্ত্রীপরিষদ গঠন করে চানক্যকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন।
চন্দ্রগুপ্তের অতি-নির্ভরযোগ্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ
প্রাসাদে বিলাসবহুল জীবন যাপনের অবারিত সুযোগ থাকার পরও, কথিত আছে যে,
চানক্য এক শ্মশানবর্তী খুব সাধারণ একটি কুঁড়েঘরে নির্মোহ সন্ন্যাস
জীবন-যাপন করতেন। ওখানে থেকেই বিশ্বস্ততার সাথে রাজপ্রদত্ত দায়িত্বপালনের
পাশাপাশি শিষ্যবর্গকে রাজ্যশাসন কৌশল শিক্ষাসহ নৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিষয়ে
জ্ঞান দান করতেন। এসব বিষয়ের কিছু কিছু তাঁর অন্যান্য বিবরণীতে সংগৃহিত
হয়েছে। এ ধরনের একটি সংকলন- ‘চানক্য নীতি দর্পণ’। দু’হাজারেরও অধিক বছরের
কাল পরিক্রমায় এসেও চানক্য নীতি শ্লোকগুলো এখনো যে গুরুত্বহীন হয়ে যায়নি,
এখানেই ধর্ম, দর্শন, নীতিশাস্ত্র, সামাজিক আচরণ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে
চানক্যের অভূতপূর্ব দার্শনিক প্রাজ্ঞতা প্রমাণীত। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে
অসাধারণ দক্ষ পরিকল্পনাবিদ হিসেবে চানক্যের খ্যাতি অপরিমেয়। সিদ্ধান্তে
অটলস্বভাবী তাঁর কাছে অর্থহীন আবেগের কোন মূল্য ছিলো না। নিজস্ব পরিকল্পনা
উদ্ভাবন ও তা বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন কঠোর।
কালজয়ী গ্রন্থ কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’ শাসকের প্রতি পরামর্শ হিসেবে
চানক্যের কিছু বাণীকে দু’হাজার বছরের এতো দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এসে এখনো অসম্ভব
সমকালীন মনে হয়-
"যে রাজা শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা করতে পারে না এবং শুধু অভিযোগ করে
যে তার পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, তাকে সিংহাসনচ্যুত করা উচিত।”
"সকল উদ্যোগ নির্ভর করে অর্থের ওপর। সেজন্যে সবচেয়ে অধিক মনোযোগ দেয়া উচিত
খাজাঞ্চিখানার দিকে। তহবিল তসরূপ বা অর্থ আত্মসাতের চব্বিশটি পদ্ধতি আছে।
জিহ্বার ডগায় বিষ রেখে যেমন মধুর আস্বাদন করা সম্ভব নয়, তেমনি কোন রাজ
কর্মচারির পক্ষে রাজার রাজস্বের সামান্য পরিমাণ না খেয়ে ফেলার ঘটনা অসম্ভব
ব্যাপার। জলের নিচে মাছের গতিবিধি যেমন জল পান করে বা পান না করেও বোঝা
সম্ভব নয়, অনুরূপ রাজ কর্মচারির তহবিল তসরূপও দেখা অসম্ভব। আকাশের অতি
উঁচুতেও পাখির উড্ডয়ন দেখা সম্ভব; কিন্তু রাজকর্মচারির গোপন কার্যকলাপ
সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সমভাবে অসম্ভব।”
যুগে যুগে প্রজাবৎসল শাসককূলের উত্তম শাসনকার্যের সবচাইতে প্রাচীন ও
অসাধারণ সহায়িকা হিসেবে রচিত
ধর্ম-দর্শন-ন্যায়পরায়ণতা-কূটনীতি-অর্থনীতি-রাষ্ট্রনীতির আকর-গ্রন্থ
কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-কে তৎকালীন প্রজাহিতৈষী মৌর্য শাসকরা যে হেলাফেলা
করেননি তা বুঝা যায় চানক্য-সহায়তায় মৌর্যশাসন প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত
মৌর্যের চব্বিশ বছরের শাসনকালের পরও দ্বিতীয় প্রজন্ম বিন্দুসারা'র
জনপ্রিয়তা যাচাই করলে। তারও পরে এই মৌর্য বংশের তৃতীয় শাসক সম্রাট অশোকের
শাসনকাল তো প্রতীকী স্থায়িত্ব পেয়ে আছে বর্তমান ভারতের রাষ্ট্রীয় মনোগ্রামে
প্রাচীন ও গভীর ঐতিহ্যবাহী অশোক-স্তম্ভের দৃশ্যমান অবস্থিতিতে। এমনকি আরো
বহু পরে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা বিক্রমাদিত্যের সমৃদ্ধিময় শাসনকালের
কিংবদন্তীয় উপকথাগুলোর জনপ্রিয় লোকভাষ্য থেকেও তা ধারণা করা যায় হয়তো।
(০২)
এই উপমহাদেশীয় প্রাচীন মাটির সন্তান আমাদেরই পূর্বপুরুষ চানক্য-পণ্ডিত
বিষ্ণুগুপ্তের দার্শনিক কৌটিল্য হয়ে ওঠা বা যুগান্তকারী গ্রন্থ
‘অর্থশাস্ত্র’ রচনার কিংবদন্তীয় কাহিনী বর্ণনা করা যতোটা ইন্দ্রীয়সুখের
ব্যাপার, একজন কৌটিল্যের উন্মেষের কার্য-কারণ সূত্র খোঁজাটা বোধ করি ততটাই
জটিলতার বিষয়। তৎকালীন প্রাচীন ভারতোপমহাদেশীয় আর্থ-সামাজিক পটভূমিতে
অনিবার্যভাবে একজন কৌটিল্যের উন্মেষ না ঘটলে সেসময়কার পরিবর্তন বা
অপরিবর্তনহেতু শাসক-মানসের জ্ঞান-বিজ্ঞান স্পৃহা কতোটা ফলবতী হতো বা
পরবর্তীকালের শাসকানুকুল্যে সমৃদ্ধ ভারতীয় সভ্যতা আদৌ কোন বাস্তবরূপ পেতো
কিনা এবং অন্যান্য উন্নত সভ্যতার সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিনিময় সম্ভাব্যতা
কেমন হতো সেসব হয়তো এখন কেবলি কুটতর্ক। তবে কৌটিল্যের কৌটিল্য হয়ে ওঠার
পেছনে তৎকালীন ইউরোপীয় বা সুনির্দিষ্টভাবে গ্রিক সভ্যতার সাথে ভারতীয়
জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিনিময় ব্যবস্থার যথেষ্ট অবদান থাকার সম্ভাবনাকে খাটো করে
দেখার উপায় নেই। কেননা যে সময়টাতে কৌটিল্য ‘অর্থশাস্ত্র’ লিপিবদ্ধ করেন, এর
খুব কাছাকাছি সময় পূর্বেই প্লেটোর আলোড়িত গ্রিক রাষ্ট্রদর্শনের জন্ম হয়েছে
কেবল। এবং কৌটিল্যের সময়কালে এই দর্শনের বাণী বা প্রভাব গ্রিসের বাইরে
ছড়াতে শুরু করেছে এমন ধারণাও করতে পারি আমরা।
গ্রিক দার্শনিক (Plato) প্লেটো (খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৭-খিষ্টপূর্ব ৩৪৭) আশি বছর
বয়সে যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন চানক্যের (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০-খ্রিষ্টপূর্ব ২৮৩)
বয়স তথ্যানুযায়ী তিন বছর। তাছাড়া চানক্যের সময়কালে পাঞ্জাব যে গ্রিক
আধিপত্যে ছিলো এবং গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের আকস্মিক মৃত্যুতে পাঞ্জাবে
গ্রিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হলে গ্রিকদের জন্য সেই অস্থির সময়ে
চানক্য মৌর্য শাসক চন্দ্রগুপ্তকে পাঞ্জাবে গ্রিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণে
উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হন। এছাড়াও খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রিক দূত
মেগাস্থিনিস চন্দ্রগুপ্তের দরবারে অবস্থান করে তাঁর ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থের
মাল-মশলা সংগ্রহের ঘটনা চানক্যের সময়কালেই হয়েছিলো বলে ধারণা। ফলে গ্রিক
সংস্কৃতির এতোটা স্পর্শে এসেও চানক্যের মতো অসাধারণ প্রতিভাবান
পণ্ডিত-দার্শনিক যে গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে একটুও প্রভাবিত হননি সে কথা
বলাটা বোধ করি খুবই অযৌক্তিক হবে। তবে এটাও আমাদের ধারণায় রাখতে হবে যে,
জ্ঞান হচ্ছে বাতাসের মতো; চিন্তা-চেতনাকে স্বচ্ছ করতে সহায়তা দেয় শুধু,
চিন্তার শরীর পুষ্ট হতে প্রয়োজন অন্যকিছু।
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস নিরক্ষর ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। কেননা
তিনি নিজে কখনোই কিছু লিখে যাননি। তাঁর দার্শনিক শিষ্য প্লেটোর মাধ্যমেই
আমরা রূপায়িত সক্রেটিসকে চিনি এবং জানি। ইউরোপীয় রাষ্ট্রদর্শনের উৎস বলে
চিহ্ণিত প্লেটোর দর্শন ও রাষ্ট্রচিন্তা বিষয়ক জগৎবিখ্যাত গ্রন্থ (Republic)
‘রিপাবলিক’-এ প্রধান চরিত্র সক্রেটিসের অদ্ভুত ও চমৎকার যুক্তিবিস্তারের
মধ্য দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ের দর্শনসূত্র এবং একটি আদর্শ রাষ্ট্রের কাল্পনিক
রূপরেখা তৈরির যে চমৎকারিত্ব দেখানো হয়েছে তা অভূতপূর্ব। তবে গোটা দর্শনের
মূল লক্ষ্যটাই ছিলো সত্য ও ন্যায়ের সন্ধান এবং এর মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র
পরিচালনার মৌলসূত্র ও ন্যায়পরায়ণ শাসকের স্বরূপ কী হবে তা উপস্থাপন।
সৈয়দ মকসুদ আলী অনুদিত বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত নভেম্বর ১৯৭৩-এ
প্রকাশিত ‘প্লেটোর রিপাবলিক’ গ্রন্থটির ‘প্লেটোর রাষ্ট্রদর্শন’ আলোচনায়
অনুবাদকের বক্তব্যটি এরকম-
‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে প্রধানত ন্যায়ধর্ম (justice) বিষয়ে আলোচনা স্থান
পেয়েছে। গ্রন্থের মূল চরিত্র সক্রেটিস যে সত্যটি তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন
তা হলো : অবিচার, অনাচার ও দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে আমাদের রক্ষা করতে
পারে দু’টি শক্তি, একটি সত্যাশ্রয়ী জ্ঞানী মানুষ এবং অপরটি ন্যায়ধর্ম। সত্য
ও ন্যায়ের সন্ধান লাভ করতে হলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে-সে পথ শিক্ষার, যার
মাধ্যমে আত্মোৎকর্ষ লাভ করা যায়।
মজার বিষয় হচ্ছে, চানক্য-পণ্ডিত কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রের’ মূল সংস্কৃত
গ্রন্থটির নামের অর্থও নাকি দাঁড়ায় ‘পৃথিবীতে সাধারণ কল্যাণ বিষয়ক বিবরণী’।
আর কল্যাণের সাথে খুব স্বাভাবিকভাবে ন্যায়পরায়ণতার বিষয়টিই জড়িত থাকে।
যেহেতু শাসকদের উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রশাসন ও কূটনীতি কৌশলের পরামর্শ হিসেবে
গ্রন্থটি লিপিবদ্ধ হয়েছে, অতএব শাসকের ন্যায়পরায়ণতার বিষয়টিই বিবেচনায়
প্রাধান্য পেয়েছে। ‘অর্থশাস্ত্রে’র উপস্থাপনভঙ্গি যদিও ‘রিপাবলিকে’র মতো
নয়, তবু প্লেটো ও কৌটিল্য উভয়েই ভিন্ন ভিন্নভাবে তাঁদের নিজেদের মতো করে
মানব-চরিত্রের প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণে ব্রতী হয়েছেন। এবং এটাই স্বাভাবিক।
রাষ্ট্রচিন্তায় আসলে মানুষই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী অনুঘটক। তবে
দেশ কাল রাষ্ট্র পরিবেশ বিচারে মানুষের প্রকৃতি যেহেতু ভিন্ন ও
বৈচিত্র্যময়, তাই তাঁদের বিশ্লেষণধর্মিতাও ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক।
এক্ষেত্রে পূর্বোক্ত ‘প্লেটোর রিপাবলিক’ গ্রন্থের অনুবাদকের বক্তব্য
প্রণিধানযোগ্য-
‘গ্রিক দার্শনিকগণ, বিশেষত প্লেটো, মানবচরিত্রের বৈচিত্র্য তাঁর রিপাবলিক-এ
যেরূপ সূক্ষ্মভাবে উন্মোচিত করেন তার তুলনা বিরল। প্রাচীন ভারতবর্ষে এ
কাজটি আংশিকভাবে করেছেন ‘অর্থশাস্ত্রের’ রচয়িতা কৌটিল্য, এবং মহাচীনে
কনফুসিয়াস, মেনসিয়াস।’
আরেকটা বিষয় বেশ কৌতুহলের দাবি রাখে। প্লেটোর ‘রিপাবলিকে’ একটি আদর্শ
রাষ্ট্রের অধিকর্তা হিসেবে কেন দার্শনিকগণকেই মনোনীত করা উচিত, এর সপক্ষে
যুক্তি বিস্তার করতে গিয়ে এক জায়গায় সক্রেটিস বলছেন-
‘আমার মতে দার্শনিকগণই রাষ্ট্রের অধিপতি হবার যোগ্য। কেবল তাই নয়, আমরা
যাদের রাজা বা শাসক বলি তাদেরও প্রজ্ঞাশক্তিতে যথেষ্টভাবে উদ্বুদ্ধ হতে
হবে। বস্তুত রাজনৈতিক ক্ষমতা ও দর্শনের মধ্যে সমন্বয় না ঘটলে এবং যেসব
সাধারণ স্বভাববিশিষ্ট লোকসমষ্টি যথেচ্ছাচারে লিপ্ত থাকে তাদের কঠোরভাবে
সংযত করা না হলে রাষ্ট্র ত দূরের কথা, গোটা মানবজাতিও বিপদ-মুক্ত হতে পারবে
না। এমন কি প্রিয় গ্লাউকন, আমরা যে আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা দিয়েছি তাও
এরূপ অস্বাভাবিক অবস্থায় অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে। অনেকের কাছেই কথাটা হয়ত
কূটাভাসের মতো শোনাবে; কেননা, আমি জানতাম তোমাদের মধ্যে অনেকেই আমার
রাষ্ট্রকল্পনায় বিশ্বাসী নও এবং এজন্যেই হয়ত বিশ্বাস করতে পারছ না যে,
রাষ্ট্রের বা ব্যক্তির কল্যাণ কেবল আমার প্রস্তাবিত পথেই আসতে পারে।’
বিষয়টা কাকতালিয় কিনা জানি না, চানক্যের উপরোল্লিখিত কিংবদন্তীয় জীবনেতিহাস
থেকে আমরা জানতে পারি যে, উপমহাদেশের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত
মৌর্য তার বিশাল সাম্রাজ্য দক্ষভাবে পরিচালনার জন্য একটি মন্ত্রী পরিষদ গঠন
করে গুরু চানক্যকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। আমরা এও জানতে পারি, এই
সাম্রাজ্য পরিচালনায় গুরু চানক্যের পরামর্শ ও অবদানই মূখ্য ছিলো। আর অতি
বিশ্বস্ততা ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে এতো বড়ো ক্ষমতা পরিচালনা করেও
ব্যক্তিগতভাবে চানক্য ছিলেন জাগতিক সমস্ত বিয়য়ের প্রতি একেবারেই নির্মোহ ও
সন্ন্যাস জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। এমনকি সবসময় কৌপিন-বস্ত্র পরিধান ও
শ্মশানবর্তী এক সাধারণ কুড়েঘরে অবস্থান করে শিষ্যদেরকে ন্যায় ও
দর্শনশাস্ত্রে জ্ঞানশিক্ষা দান করতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন তিনি। প্লেটোর
‘রিপাবলিকে’ সক্রেটিস কথিত রাজনৈতিক ক্ষমতা ও দর্শনের মধ্যে এমন অদ্ভুত
সমন্বয়ক ভূমিকার উদাহরণ চানক্য ছাড়া আর রয়েছে কিনা জানা নেই।
বক্তব্যের স্পষ্টতার জন্য বলে রাখা জরুরি যে বক্ষ্যমান আলোচনার অর্থ এই নয়
যে, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’কে গ্রিক রাষ্ট্রদর্শন বা ‘রিপাবলিক’ এর
অনুসৃতি হিসেবে ইঙ্গিত করা হচ্ছে। এ দুটোতে বরং ভিন্নতাই বেশি পরিলতি হয়।
সামাজিক ও ভৌগোলিক পরিবেশ পরিস্থিতি ও জনরুচি সাপেক্ষে এই ভিন্নতাটাই
অধিকতর যৌক্তিক। ‘রিপাবলিকে’ মূলত একটি কাল্পনিক নগররাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার
ধারণা তৈরি যতটুকু প্রাধান্য পেয়েছে, অন্যদিকে ‘অর্থশাস্ত্রে’ প্রাধান্য
পেয়েছে শাসকের কূটনীতি ও রাজ্যশাসন কৌশলের উৎকর্ষ অর্জন। তবে উভয়ক্ষেত্রে
সাযুজ্য হলো শেষবিচারে একজন শাসকের ন্যায়পরায়ণ হয়ে ওঠা বা সর্বক্ষেত্রে
ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করা। আর এখানেই বুঝি সেই কথাটাই প্রযোজ্য হয়ে ওঠে যা এ
লেখায় বলার চেষ্টা করা হয়েছে- ‘গ্রেট ম্যান থিংক এলাইক’।
(০৩)
প্রায় সমসাময়িক রাষ্ট্রচিন্তক বা দার্শনিক হিসেবে প্লেটো ও চানক্য তথা
কৌটিল্য, দু’জনের মেধা-মননে গুণগত মিল থাকলেও তাঁদের নিজ নিজ যাপিত জীবন
অনুযায়ী অবস্থানগত অমিলটাই লক্ষ্য করা যায় বেশি।
প্লেটো রাষ্ট্রীয় মতাবলয়ের বাইরে ও দূরবর্তী নিরীহ অবস্থানে থেকে
রাষ্ট্রচিন্তায় ভাবিত একজন দার্শনিক। ধারণা, কল্পনা ও যুক্তিই হচ্ছে তাঁর
দর্শন-সূত্র তৈরির মূল হাতিয়ার। অন্যদিকে ক্ষমতাবলয়ের প্রায় কেন্দ্রে
অবস্থান ছিলো বলে চানক্য একেবারে নির্মোহ ও ঋষিস্বভাবী পণ্ডিত হলেও
শাসক-মানসকেও নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও প্রভাবিত করার সুযোগ পেয়েছেন। ফলে একজন
বাস্তববাদী রাষ্ট্রচিন্তক ও দক্ষ পরিকল্পনাবিদ হিসেবে চিন্তাকে বাস্তবায়নের
সুযোগই তার শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার ছিলো।
আবার সক্রেটিসের জবানিতে প্লেটো বিশ্বাস করতেন- ‘দেহের সৌন্দর্যের চাইতে
চিন্তার সৌন্দর্য অধিকতর মোহময় ও এর প্রভাব যাদুতুল্য।’ অর্থাৎ কল্পনার
বিমূর্ত চেহারায় তুষ্ট তিনি। অন্যদিকে সিদ্ধান্তে অটলস্বভাবী অসাধারণ দক্ষ
পরিকল্পনাবিদ চানক্যের কাছে অর্থহীন আবেগের কোন মূল্য ছিলো না। নিজস্ব
পরিকল্পনা উদ্ভাবন ও তা বাস্তবায়নে ছিলেন কঠোর। অর্থাৎ প্রয়োগযোগ্যতা ও
মূর্ততাই তাঁর আরাধ্য।
তবে ভিন্ন প্রেক্ষিত থেকে যে ভিন্নতাটা সবচাইতে পীড়াদায়ক হয়ে দেখা দেয়
আমাদের কাছে, তা হলো- প্রায় আড়াই হাজার বছরের ব্যবধানে এসেও বাস্তবতার মাটি
না পাওয়া প্লেটোর ইউরোপকেন্দ্রিক একটা কাল্পনিক দর্শনকে খুব ভালোভাবে মনে
রেখে এর অসম্ভব পরিচর্যা করে যেতে আমরা সক্ষম হলেও নিজস্ব রাষ্ট্রচিন্তা ও
অসাধারণ পরিকল্পনাকে বাস্তবতায় রূপদানকারী আমাদের অত্যন্ত আপন একজন চানক্য
পণ্ডিত কৌটিল্যকে ‘অর্থশাস্ত্রের’ দুষ্প্রাপ্রাপ্যতার মতোই আমরা ভুলতে
বসেছি প্রায়। আর এখানেই বুঝি কৌটিল্য পুনঃবিশ্লেষণের দাবি রাখে।
(০৪)
দর্শনের ক্ষেত্রে যেকোনো তত্ত্বের প্রকৃত ভিত্তি হচ্ছে এর প্রয়োগযোগ্যতা ও
জনমানুষের চিন্তাবিশ্বের ধারাবাহিক বিবর্তনকে প্রভাবিত করার সক্ষমতা। এ
নিরিখে প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ কেবল একটি আদর্শ রাষ্ট্রের কাল্পনিক স্বরূপ
অন্বেষণই ছিলো না, তারচে’ও বহু বহু গুণে বেশি ছিলো মানবজাতির চিন্তাজগতে
যুক্তির শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দর্শনসূত্র খোঁজার এক যুগান্তকারী
পদ্ধতির উদ্ভাবন। এ প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমী’র প্রাক্তন মহাপরিচালক মযহারুল
ইসলামের বক্তব্যকে প্রতিধ্বনিত করে বলা যায়-
‘বলা হয়ে থাকে যে সমস্ত ইউরোপের আধুনিক দর্শন প্লেটোর ফুটনোট মাত্র।
কথাটিতে হয়তো কিছু অতিরঞ্জন দোষ আছে; কিন্তু প্লেটোকে বাদ দিয়ে আধুনিক
সভ্যতার মর্মার্থ, বিশেষভাবে ইউরোপীয় দার্শনিক চিন্তাধারাকে যথাযথভাবে
অনুধাবন করা যায় না। প্লেটোর পটভূমিকাতেই পরবর্তী দর্শন ও দর্শনসংশ্লিষ্ট
মানবজ্ঞান প্রসার লাভ করেছে। প্লেটোর সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ রিপাবলিক।…
প্লেটো তাঁর রিপাবলিকের এক জায়গায় মন্তব্য করেছেন, আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের
স্থান হতে পারে না। কারণ, কবিরা কল্পনাবিলাসী। কিন্তু প্লেটোর নিজের লেখাও
কাব্যধর্মী। কাব্যধর্মী বলেই তার আবেদন হৃদয় স্পর্শ করে। রিপাবলিক শুধু
দার্শনিক জ্ঞানের বিচিত্র চর্চায় সমৃদ্ধ নয়- এর উপস্থাপনরীতি উৎকৃষ্ট
সাহিত্যের সূর্যালোকে সঞ্জীবিত।
দর্শন ও সাহিত্য, উভয়দিক থেকেই প্লেটোর অবদান বিস্ময়কর এবং অবিনশ্বর। প্লেটো সর্বকালের এক মহান প্রতিভা।’
অন্যদিকে কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ একধরনের সাহিত্যগুণসম্পন্ন দর্শন হলেও
তাকে মূলত সাধারণজনস্পর্শ-বিচ্ছিন্ন প্রাচীন ভারতীয় রাজন্যবর্গের ন্যায়ানুগ
রাজ্যশাসনের নিমিত্তে লিপিবদ্ধ অসাধারণ নীতিশাস্ত্র বা গাইডলাইন বলা চলে।
সভ্যতার অনিবার্য গতিময়তায় সেই প্রতাপ বিকিরণকারী রাজন্যপ্রথার
গতি-সঙ্কোচনের ফলে এটিকে হয়তো একটি জনবিচ্ছিন্ন সম্ভ্রান্ত রাজ-দর্শন
হিসেবেই ইতিহাসের টেরাকোটায় অতিমহার্ঘ উপকরণের পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। এতে
করে সমকালীন রাষ্ট্র ও কূটনীতি দর্শনে দক্ষ পরিকল্পনাবিদ কৌটিল্যের অসাধারণ
পাণ্ডিত্য, মেধা, ন্যায়পরায়ণতা ও ব্যতিক্রমী প্রতিভার স্বীকৃতি হয়তো
এতটুকু ক্ষুণ্ন হয় নি বা হবে না, কিন্তু ইউরোপীয় চিন্তাদর্শনে নির্মিত
আমাদের সর্বব্যাপী রাষ্ট্র-ভাবনা ও দর্শনে কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ যদি
শেষপর্যন্ত ‘চানক্য-পণ্ডিতের কৌটিল্য-পুরাণ’ হিসেবেই এনটিক-মর্যাদায় স্থির
হয়ে যায়, তাতেও বোধ করি আশ্চর্যের কিছু থাকবে না।
তবুও কৌটিল্য এবং ‘অর্থশাস্ত্র‘ একান্ত আমাদেরই এক ঐতিহ্য-সম্পদ।
…
কৃতজ্ঞতা ও তথ্যঋণ-সূত্র:
১) প্লেটোর রিপাবলিক/ অনুবাদ: সৈয়দ মকসুদ আলী/ বাংলা একাডেমী, ঢাকা, নভেম্বর ১৯৭৩।
২) রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য (ramkrishnabh.blogspot)
তথ্য উৎস: রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য কর্তৃক উল্লেখিত-
[Philosophy of Chanakya• Kautilya's Arthashastra (full 1915 Shamasastry
text, divided into 15 books)• Kautilya: the Arthshastra - Chanakya's
revered work• Philosophy and Biography]