আমরা প্রত্যেকেই সুখ অন্বেষণ করছি, কিন্তু প্রকৃত সুখ কি তা আমরা জানি না। আমরা সুখের সন্ধানে কত বিজ্ঞাপনই দেখি, কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে আসলে কোন লোককেই সুখী দেখা যায় না। এর কারণ প্রায় কেউই জানে না যে প্রকৃত সুখের স্তর অস্থায়ী বস্তুর অতীত। এই প্রকৃত সুখ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক অর্জুনের নিকট ভগবদ্গীতায় বর্ণিত হয়েছে।
সাধারণত সুখ অনুভব করা হয় আমাদের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে। উদাহরণ-স্বরূপ, একটি পাথরের কোন ইন্দ্রিয় নেই আর পাথর সুখ-দুঃখ অনুভব করতে পারে না। উন্নত চেতনা-শক্তি অনুন্নত চেতনাশক্তির চেয়ে অনেক বেশি সুখ ও দুঃখ অনুভব করতে পারে। গাছের চেতনা-শক্তি আছে, কিন্তু সেই চেতনা উন্নতমানের নয়। গাছ হয়তো সব রকম আবহাওয়ায় দীর্ঘকাল দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, কিন্তু তাদের দুঃখ অনুভবের কোন উপায় নেই। যদি একজন মানুষকে শুধু তিন দিন বা এমনকি তার চেয়েও কম সময় গাছের মত দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হয়, সে এসব সহ্য করতে পারবে না। সিদ্ধান্ত হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক জীব তার চিন্তা-শক্তির উন্নতির মাত্রা অনুযায়ী সুখ বা দুঃখ অনুভব করে।
ভৌতিক জগতে যে সুখ আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে তা প্রকৃত সুখ নয়। একজন যদি একটি গাছকে জিজ্ঞেস করে, ‘‘তুমি কি সুখী?’’ এবং গাছটি যদি উত্তর দিতে পারতো, তবে সে বলতো, ‘‘হ্যাঁ, সারা বছর এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আমি সুখী। আমি ঝড়, তুষারপাত এসব খুবই উপভোগ করছি, ইত্যাদি।’’ এসব গাছের নিকট উপভোগের বিষয় হতে পারে, কিন্তু মানুষের কাছে এ এক অতি নিæস্তরের সুখ। বিভিন্ন রকমের ও স্তরের জীব আছে, আর সুখ সম্বন্ধে তাদের ধারণা এবং অনুভূতিও সব বিভিন্ন রকমের ও স্তরের। যদিও একটি পশু দেখতে পায় যে আর একটি পশু জবাই হচ্ছে, তবু সে ঘাস খেতে থাকবে, কারণ তার এ জ্ঞান নেই যে সে পরবর্তী সময়ে জবাই হবে।
এইভাবে বিভিন্ন মাত্রা অনুসারে সুখ আছে। তথাপি সব সুখের মধ্যে সব চেয়ে শ্রেষ্ঠ সুখ কি? শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন (গীতা ৬/২১) Ñ সুখমাত্যন্তিকং যত্তদ্ বুদ্ধিগ্রাহ্যমতীন্দ্রিয়ম্। বেত্তি যত্র ন চৈবায়ং স্থিতশ্চলতি তত্ত¡তঃ\
“ঐ সমাধিস্থ অবস্থায় একজন অপ্রাকৃত ইন্দ্রিয় দ্বারা অফুরন্ত সুখ ও আনন্দ উপভোগ করে। এইভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সে সত্য থেকে বিচ্যুত হয় না।”
‘বুদ্ধি’ মানে বোধশক্তি; যদি কেউ ভোগ করতে চায় তবে তাকে বুদ্ধিমান হতে হবে। পশুদের প্রকৃতপক্ষে উন্নত বুদ্ধি নেই আর তাই তারা একজন মানুষের মতো জীবন উপভোগ করতে পারে না। হাত, নাক, চোখ ও অন্যান্য ইন্দ্রিয় ও দেহের অন্য সব অংশ মৃতদেহে থাকা সত্তে¡ও কিন্তু সে উপভোগ করতে পারে না। কেন পারে না? উপভোগকারী শক্তি, চিৎকনা দেহ ত্যাগ করেছে, এবং সেই কারণে দেহ শক্তিহীন্ সামান্য বুদ্ধি দিয়ে একজন এ বিষয়ে আরও দৃষ্টিপাত করলে সে বুঝতে পারে যে, যে উপভোগ করছিল সে এই দেহ নয় আদৌ বরং অন্তঃস্থিত ক্ষুদ্র চিৎকণা। যদিও একজন ভাবতে পারে যে দৈহিক ইন্দ্রিয় দ্বারা সে উপভোগ করছে, কিন্তু প্রকৃত ভোক্তা বা উপভোগ-কারী হচ্ছে সেই চিৎকণা। সেই চিৎকণার সব সময় ভোগ করার শক্তি আছে, কিন্তু ভৌতিক দেহ দ্বারা আবৃত থাকায় তা সব সময় ব্যক্ত নয়। যদিও আমরা এর অস্তিত্ব অনুভব করিনি, এই চিৎকণার অস্তিত্ব ছাড়া দেহের পক্ষে ভোগ করা সম্ভব নয়। যদি একজন লোককে এক সুন্দরী স্ত্রী লোকের মৃতদেহ প্রদান করা হয়, সে কি তা গ্রহণ করবে? না, কারণ চিৎকণা দেহত্যাগ করেছে। দেহের ভেতর থেকে সে শুধু উপভোগই করছিল না, দেহের প্রতিপালনও করছিল। যখন সেই চিৎকণা দেহত্যাগ করে, তখন দেহটি সহজেই ক্ষয় প্রাপ্ত হয়।
এ থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে যদি চিৎকণা ভোগ করছে, তা হলে এর ইন্দ্রিয়ও আছে, তা না হলে এ ভোগ করে কিভাবে? বেদে দৃঢ়ভাবে জানান হয়েছে যে, জীবাত্মার আকার আণবিক হলেও, জীবাত্মাই প্রকৃত ভোক্তা। আত্মার পরিমাপ করা যায় না, কিন্তু তা বলে বলা যায় না যে আত্মা অপরিমেয়। আপাতদৃষ্টিতে কোন বস্তুকে বিন্দুর চেয়ে বড় না দেখাতে পারে আর এর দৈর্ঘ্য বা প্রস্থ নেই মনে হতে পারে, কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখলে, আমরা দেখি এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ উভয়ই আছে। সেই রকম আত্মার ও আয়তন আছে, কিন্তু আমরা তা অনুভব করতে পারি না। যখন আমরা কোন পোশাক কিনি, তা দেহের মাপ অনুযায়ী তৈরি হয়। চিৎকণার নিশ্চয়ই আকার আছে, তা না হলে কিভাবে জড় দেহ আত্মার বাসস্থান হয়। এ থেকে সিদ্ধান্ত করা যায় যে আত্মা নির্বিশেষ নয়। এ আসলে একজন ব্যক্তি। ভগবান প্রকৃত ব্যক্তি আর চিৎকণা তাঁর এক ভগ্নাংশ হওয়ায় সেও একজন ব্যক্তি। পিতা যদি একজন ব্যক্তি হয় ও তার আত্ম-স্বাতন্ত্র্য থাকে, পুত্রেরও তা আছে, আর যদি পুত্রের তা থাকে, আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, পিতারও তা আছে। সুতরাং ভগবানের সন্তান হয়ে এটি আমাদের পক্ষে কি করে সম্ভব যে আমাদের নিজেদের ব্যক্তিত্ব ও আত্ম-স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করব, অথচ সেই সঙ্গে আমাদের পরম পিতা পরমেশ্বর ভগবানের ব্যক্তিত্ব ও আত্ম-স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করব না?
‘অতীন্দ্রিয়ম্’-এর অর্থ এই যে যথার্থ সুখ অনুভব করার আগে আমাদের জড় ইন্দ্রিয়ের অতীত হতে হবে। রমন্তে যোগিনোহনন্তে সত্যানন্দ চিদাত্মনিÑঅধ্যাত্ম জীবন লাভে সচেষ্ট যোগীরাও অন্তর্যামী পরমাত্মাকে একাগ্র মনে ধ্যান করে সুখ উপভোগ করছে। সুখানুভব না হলে, আনন্দ অনুভব না হলে, ইন্দ্রিয় সংযমের জন্য এত কষ্ট করার দরকার কি? যদি যোগীরা এতই কষ্ট স্বীকার করে তা হলে কি ধরনের সুখ তারা অনুভব করছে? সে সুখ অনন্তÑতার শেষ নেই। কি রকম করে? আত্মা সনাতন, আর পরম প্রভুও সনাতন। যথার্থ বুদ্ধিমান ব্যক্তি ভৌতিক দেহের চপল ইন্দ্রিয় সুখ থেকে বিরত হয়ে অধ্যাত্ম জীবন সুখে মনোনিবেশ করবে। পরম প্রভুর সাথে অধ্যাত্ম জীবনে তার অংশ গ্রহণকে ‘রাসলীলা’ বলে।
আমরা প্রায়ই বৃন্দাবনের গোপীদের সাথে কৃষ্ণের রাসলীলার কথা শুনি। সেই রাসলীলা ভৌতিক দেহের মধ্যে অনুষ্ঠিত সাধারণ আদান-প্রদানের মত নয়। বরং তা চিন্ময় দেহের মাধ্যমে ভাবের এক আদান প্রদান। এ বুঝতে হলে একজনকে কিছুটা বুদ্ধিমান হতে হবে, একজন মূর্খ ব্যক্তি প্রকৃত সুখ যে কি তা উপলব্ধি করেনি, সে এই ভৌতিক জগতে সুখের অন্বেষণ করে। ভারতবর্ষে একজন লোক সম্বন্ধে এক গল্প আছে, সে জানতো না আখ কি আর তাকে বলা হয়েছিল এ চিবাতে খুব মিষ্টি। ‘‘ও, এ দেখতে কেমন? সে জিজ্ঞেস করেছিল। ‘‘এ দেখতে ঠিক একটি বাঁশের লাঠির মতো,’’ একজন বলেছিল। তাই মূর্খ লোকটি সব রকম বাঁশের লাঠি চুষতে শুরু করেছিল। সে আখের মিষ্টতা কি করে আস্বাদন করবে? সেই রকম আমরা আনন্দ ও সুখ লাভের চেষ্টা করছি, কিন্তু তা লাভের চেষ্টা করছি এই ভৌতিক দেহটা চুষে; তাই কোন আনন্দ নেই আর কোন সুখ নেই। কিছুক্ষণের জন্য হয়তো কিছু সুখানুভব করতে পারে, কিন্তু তা প্রকৃত সুখ নয়, কারণ তা অস্থায়ী। এই সুখ বিদ্যুতালোকের মতো যা আমরা আকাশে আলোকিত হতে দেখি যা ক্ষণিকের জন্য বিদ্যুতের মতো মনে হয়, কিন্তু প্রকৃত বিদ্যুৎ তা অনেক দূরে। কারণ যে মানুষ প্রকৃতপক্ষে সুখ কি তা জানে না, সে প্রকৃত সুখের পথ থেকে বিপথে চলে যায়।
এই কৃষ্ণভাবনামৃতের পদ্ধতিই হচ্ছে প্রকৃত সুখ লাভের উপায়। কৃষ্ণানুশীলন দ্বারা ক্রমশ আমাদের প্রকৃত সুখ লাভের উপায়। কৃষ্ণানুশীলন দ্বারা ক্রমশ আমাদের প্রকৃত বুদ্ধির বিকাশ করতে পারি এবং পারমার্থিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে আমরা চিন্ময় সুখ আস্বাদন করে, উপভোগ করতে পারি। যে মাত্র আমরা চিন্ময় সুখ আস্বাদন আরম্ভ করি, সঙ্গে সঙ্গে আমরা সম পরিমাণে পার্থিব সুখ ত্যাগ করবো। যখন আমরা পরম-তত্ত¡ উপলব্ধির পথে অগ্রসর হবো, স্বাভাবিকভাবে মিথ্যা সুখের প্রতি আমাদের বৈরাগ্য আসবে। যে কোন উপায়েই হোক কেউ যদি একবার কৃষ্ণভক্তির স্তরে উন্নতি লাভ করে, তার ফল কি হবে? যং লব্ধা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ । যস্মিন্ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে\ (গীতা ৬/২২)
‘‘এই স্তর লাভ করে সে মনে করে, এর চেয়ে শ্রেয় লাভ কিছুই নেই। এই স্তরে অবস্থিত হয়ে কেউ কখন, এমন কি ঘোরতম বিপদেও বিচলিত হন না।’’
যখন এই স্তর লাভ হয়, তখন অন্যান্য প্রাপ্তি সকল নিতান্ত তুচ্ছ মনে হয়। এই ভৌতিক জগতে কত রকমের বস্তুই আমরা অর্জনের চেষ্টা করছিÑ অর্থ, নারী, যশ, সৌন্দর্য, জ্ঞান ইত্যাদিÑ কিন্তু যে মাত্র আমরা কৃষ্ণভাবনায় অধিষ্ঠিত হই, তখন আমরা ভাবি, ‘‘ওঃ, এ অপেক্ষা আর কোন প্রাপ্তি শ্রেয় নয়।’’ কৃষ্ণভাবনামৃত এতই শক্তিশালী যে এর সামান্যতম আস্বাদন করে একজন ঘোরতম বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারে। কেউ কৃষ্ণভক্তি রস আস্বাদন করতে শুরু করলে তখন অন্যান্য তথাকথিত উপভোগ ও প্রাপ্তি তার কাছে নীরস ও অরুচিকর বলে মনে হতে শুরু করে। আর কেউ যদি দৃঢ়ভাবে কৃষ্ণভাবনাময় স্থিতি লাভ করে, তখন ঘোরতম বিপদও তাকে বিচলিত করতে পারে না। জীবন কত বিপদ-সঙ্কুল কারণ ভৌতিক জগৎটাই একটা বিপদজনক স্থান। এ বিষয়ে আমরা উপেক্ষা করার চেষ্টা করি, কিন্তু যেহেতু আমরা মূর্খ তাই এই বিপদের সাথে সামঞ্জস্য করে থাকার চেষ্টা করি। আমাদের জীবনে অনেক বিপদাপন্ন মুহূর্ত থাকতে পারে, কিন্তু আমরা যদি কৃষ্ণভাবনায় শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে ভগবৎ-দর্শন লাভ করে ভগবদ্ধামে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হই, তবে আমরা সে-সব গ্রাহ্য করব না। তখন আমাদের মনোভাব হবেÑ ‘‘বিপদ আসে আর চলে যায় যখনÑ তা ঘটুক না।’’ যতক্ষণ পর্যন্ত একজন জড়বাদী স্তরে অবস্থিত হয়ে নিজেকে নশ্বর উপাদানে গঠিত স্থূল দেহ বলে পরিচয় দেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এই রকমের সামঞ্জস্য বিধান করা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু যতই একজন কৃষ্ণভাবনায় উন্নতি লাভ করে, ততই সে দৈহিক উপাধি ও এই ভৌতিক বন্ধন থেকে নির্মুক্ত হয়।
শ্রীমদ্ভাগবতে ভৌতিক জগৎকে এক মহাসাগরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এই ভৌতিক ব্রহ্মাণ্ডে কোটি কোটি গ্রহ মহাশূণ্যে ভাসছে, এবং আমরা কল্পনা করতে পারি এই সকল ব্রহ্মাণ্ডে তা হলে কত কত অতলান্তিক মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর আছে। বস্তুত সমগ্র ভৌতিক ব্রহ্মাণ্ডকে দুঃখের এক মহাসাগর, জন্ম-মৃত্যুও এক মহাসাগরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এই অবিদ্যার মহাসিন্ধু পার হতে হলে এক মজবুত নৌকার দরকার, আর সেই মজবুত নৌকা হল কৃষ্ণের চরণকমল। আমাদের এক্ষুণি ঐ নৌকায় চড়া উচিত। কৃষ্ণের চরণ খুব ছোট ভেবে আমাদের দ্বিধা করা উচিত নয়। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড শুধু তাঁর চরণে আশ্রয় নিয়েছে। কারণ বলা হয়েছে যে, যে তাঁর চরণে আশ্রয় নেয়, জড় ব্রহ্মাণ্ড তার কাছে গরুও বাছুরের ক্ষুরের ছাপে সৃষ্টি করা ছোট্ট জলাশয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না। নিশ্চয়ই সেই রকম এক ছোট্ট জলাশয় পার হতে কোন অসুবিধা নেই।
তং বিদ্যাদ্দুঃখসংযোগবিয়োগং যোগসংজ্ঞিতম্ \
‘‘বাস্তবিক ভৌতিক সংস্পর্শজাত সব দুঃখ থেকে এইটিই হচ্ছে যথার্থ মুক্তি।’’ (গীতা ৬/২৩)
অসংযত ইন্দ্রিয়ের তাড়নায় আমরা এই ভৌতিক জগতের বন্ধনে জড়িত। যোগ অভ্যাস পন্থার উদ্দেশ্য হচ্ছে ইন্দ্রিয়গুলিকে দমন করা। যদি কোন উপায়ে আমরা ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করতে সমর্থ হই, তা হলে আমরা যথার্থ চিন্ময় সুখ লাভের আশা করতে পারি ও আমাদের জীবন সার্থক করতে পারি। স নিশ্চয়েন যোক্তব্যো যোগোহনির্বিণœচেতসা সংকল্পপ্রভবান্ কামাংস্ত্যাক্তা সর্বানশেষতঃ। মনসৈবেন্দ্রিয়গ্রামং বিনিয়ম্য সমন্ততঃ\ শনৈঃ শনৈঃরুপরমেদ্ বুদ্ধ্যা দৃতিগৃহীতয়া। আত্মসংস্থং মনঃ কৃত্বা ন কিঞ্চিদপি চিন্তয়েৎ\ যতো যতো নিশ্চলতি মনশ্চঞ্চলমস্থিরম্। ততস্ততো নিয়ম্যৈতদাত্মন্যেব বশং নয়েৎ\ ‘‘অনন্যচিত্ত ও বিশ্বাস যুক্ত হয়ে যোগ সাধনায় ব্রতী হওয়া উচিত। তা ছাড়াও মিথ্যা অহঙ্কার-জাত সকল পার্থিব কামনা ত্যাগ করে সকল দিক থেকে সকল ইন্দ্রিয়কে মনের সাহায্যে সংযত করা উচিত। ক্রমশ পূর্ণ বিশ্বাসে বুদ্ধি দ্বারা ধাপে ধাপে সমাধিস্থ হওয়া উচিত, আর এইভাবে মন শুধু আত্মাতেই নিবিষ্ট হবে ও অন্য কিছুই চিন্তুা করবে না। চঞ্চল ও অস্থির স্বভাবের জন্য মন যেখানেই যাক ও যাই চিন্তা করুক না তৎক্ষণাৎ মনকে সংযত করে আত্মার অধীনে আনতে হবে।’’ (গীতা ৬/২৪-২৬)
মন সব সময়ই চঞ্চল। এই মন এক সময় যায় এক পথে আর এক সময যায় অন্য পথে। যোগ সাধনা দ্বারা সোজাসুজিভাবে আমরা মনকে কৃষ্ণভাবনায় আকর্ষণ করি। মন কৃষ্ণভাবনা থেকে বিপথগামী হয়ে অন্য কত বাহ্যবস্তুতে ঘুরে বেড়ায়, কারণ স্মরণাতীত কাল থেকে জন্ম-জন্মান্তর ধরে এই আমাদের অভ্যাস। এই জন্য কৃষ্ণচেতনায় মনকে দৃঢ়বদ্ধ করার জন্য প্রথমে অত্যন্ত অসুবিধা হতে পারে, কিন্তু অচিরেই সেই অসুবিধা দূর হয়ে যাবে।
যেহেতু মন চঞ্চল ও কৃষ্ণে অর্পিত নয়, তাই এইমন এক ভাবনা থেকে অন্য ভাবনায় ঘুরে বেড়ায়। যেমন আমরা যখন কাজে ব্যস্ত থাকি, আপাত দৃষ্টিতে কোন কারণ ছাড়াই দশ, বিশ, তিরিশ বা চল্লিশ বছরের ঘটনার স্মৃতি আমাদের মনে এসে পড়ে। এই চিন্তা আমাদের অবচেতন মন থেকে আসে, আর যেহেতু তা সব সময় উদিত হয়, মন তাই সব সময়ই উত্তেজিত। যদি আমরা কোন পুকুরে বা সরোবরে তরঙ্গ সৃষ্টি করি, তলদেশ থেকে সমস্ত কাদা ওপরে উঠে আসে। সেই রকম যখন মন উত্তেজিত হয়, বছরের পর বছর সঞ্চিত কত চিন্তা অবচেতন মন থেকে জেগে ওঠে। আমরা যদি একটি পুকুরে তরঙ্গ সৃষ্টি না করি, তবে কাদা তলায় পড়ে থাকে। এই যোগ সাধনার উদ্দেশ্য মনকে শান্ত করা ও সমগ্র চিন্তাভাবনাকে একাগ্রীভূত করা। এই জন্য মনকে উত্তেজনার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বহু নিয়মকানুন পালন করতে হয়। যদি আমরা নিয়কানুন পালন করি, ক্রমশ মন বশীভূত হবে। কত নিষেধ আছে ও কত পালনীয় আছে। আর যে আন্তরিকভাবে মনকে শিক্ষিত করতে চায়, তাকে ঐ নিয়মগুলো পালন করতে হবে। যদি সে খেয়াল-খুশি অনুযায়ী কাজ করে, তা হলে মনকে বশীভূত করার সম্ভাবনা কোথায়? অবশেষে মনকে যখন এমনভাবে শিক্ষিত করা হবে যে তা শুধু কৃষ্ণ কথাই ভাববে অন্য কিছু চিন্তা করবে না, তখন মন শান্তি লাভ করবে ও অতিশয় প্রশান্ত হবে। প্রশান্তমনসং হ্যেনং যোগিনং সুখমুত্তমম্। উপৈতি শান্তরজসং ব্রহ্মভূতমকল্মষম্ \
‘‘মদ্গত চিত্ত যোগী যথার্থই সর্বোচ্চ সুখ লাভ করে। ব্রহ্মভূত হয়ে সে মুক্তি লাভ করে। তার মন শান্ত, তার কামনা স্থিও, আর সে সকল পাপ থেকে মুক্ত।’’ (গীতা ৬/২৭)
মন সব সময় সুখের বিষয় কল্পনা করছে। আমি সব সময় ভাবছি, ‘‘এ আমাকে সুখী করবে,’’ অথবা ‘‘ও আমাকে সুখী করবে। সুখ এখানে। সুখ ওখানে।’’ এইভাবে মন আমাদের যেখানে-সেখানে ও সব জায়াগাতে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা যেন এক লাগামহীন ঘোড়ার পেছনে রথে চড়ে যাচ্ছি। আমরা কোথায় যাচ্ছি তার ওপর আমাদের কোন ক্ষমতা নেই, কিন্তু ভয়ে কেবল বসে থেকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকতে পারি। কিন্তু যেই আমাদের মন কৃষ্ণভাবনার পথে নিয়োজিত হয়ÑবিশেষতঃÑ
কীর্তন দ্বারা, তখন উন্মত্ত ঘোড়ার মত আমাদের মন ধীরে ধীরে বশীভূত হয়। এই অস্থায়ী ভৌতিক জগতে বৃথা সুখের অন্বেষণে চঞ্চল ও অবাধ্য মনকে এক বস্তু থেকে অপর এক বস্তুতে আমাদের আকর্ষণ করা থেকে রক্ষা করার জন্য আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে অবশ্যই কৃষ্ণভাবনায় নিয়োজিত করতে হবে। যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী বিগতকল্মষঃ। সুখেন ব্রহ্মসংস্পর্শমত্যন্তং সুখমশ্মুতে \
‘‘সর্বদা আত্মতত্ত¡ চিন্তায় নিমগ্ন কলূষ মুক্ত যোগী পরম চেতনার সংস্পর্শে চরম সুখ লাভ করে।’’ (গীতা ৬/২৮)
যে কৃষ্ণগত প্রাণ কৃষ্ণ প্রতিপালক হিসেবে তার সেবা করেন। যখন কেউ অসুবিধায় পড়ে তার প্রতিপালক তখন তাকে রক্ষা করে। যেমন ভগবদ্গীতায় বর্ণনা আছে, কৃষ্ণ প্রত্যেক জীবের যথার্থ বন্ধু। এই বন্ধুত্ব পুনর্জাগরণের উপায় হচ্ছে কৃষ্ণভাবনার পথ। কৃষ্ণভাবনা অনুশীলন দ্বারা জড় কামনাময় আকাংখার সমাপ্তি হবে। এই কামময় আকাংখা আমাদের কৃষ্ণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। কৃষ্ণ আমাদের ভেতর আছেন আর তাঁর দিকে ফেরার জন্য তিনি অপেক্ষা করছেন, কিন্তু আমরা কামুকের মতো জড় বাসনা-বৃক্ষের ফল ভোগের জন্য অতিশয় ব্যস্ত। ফলভোগের জন্য এই কামবেগ বন্ধ করতে হবে, আর অবশ্য আমাদের প্রকৃত পরিচয়Ñব্রহ্ম বা শুদ্ধ চেতনায় আমাদেরকে অধিষ্ঠিত হতে হবে।
অসাধারণ সব জ্ঞানের কথা, আমি সবাইকে অনুরোধ করবো এই লিখাটি সম্পূর্ন অংশ ভালভাবে পড়ুন, যদি একবারে সম্পূর্ন না পড়তে পারেন তাহলে দুই বারে পড়ুন কিন্তু ভালভাবে মনযোগ সহকারে পড়ুন। এবং এই বাণীকে নিজ জীবনে প্রয়োগ করুন। এত সুন্দর একটা লিখা এখানে সবার সাথে শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ দিদি।