সর্বত্র ও সর্বদা কৃষ্ণ দর্শন কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ
আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য
আমাদের কর্ম জীবনে, কৃষ্ণ উপদেশ দিচ্ছেন কিভাবে আমরা কৃষ্ণভাবনা গ্রহণ করতে
পারি। এ নয় যে আমাদের কর্তব্য কর্ম বন্ধ করতে হবে বা কাজ-কর্ম থেকে বিরত
হতে হবে। বরং কৃষ্ণভাবনার মাধ্যমে কাজ-কর্ম সম্পন্ন করতে হবে। প্রত্যেকের
জীবনে একটি বৃত্তি বা পেশা আছে, কিন্তু কি মনোভাব নিয়ে সে তাতে প্রবেশ করে?
প্রত্যোকেই ভাবছে, ‘‘ও, আমার পরিবার প্রতিপালনের জন্য নিশ্চয় একটি পেশা
থাকা প্রয়োজন।’’ সমাজ, সরকার বা পরিবারকে সন্তুষ্ট রাখতে হবে, আর কেউই এই
ধরণের ভাবনা থেকে মুক্ত নয়। সুন্দরভাবে কোন কাজ সমাপনের জন্য উপযুক্ত
বিবেকসম্পন্ন হতে হবে। যার চেতনা চঞ্চল, সে উন্মত্ত, সে সঠিকভাবে কার্য
সম্পন্ন করতে পারে না। আমাদের কর্তব্য উপযুক্তভাবে স¤পন্ন করা উচিত, কিন্তু
কৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করা Ñ এই চিন্তা করে আমাদের তা করা উচিত। আর এ নয় যে
আমাদের কাজের পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে, কিন্তু বুঝতে হবে যে কার জন্য আমরা
কাজ করছি। আমাদের যা কাজ তা অবশ্যই সম্পন্ন করতে হবে, কিন্তু ‘কাম’ বা
বাসনা দ্বারা আমাদের চালিত হওয়া উচিত নয়। সংস্কৃত শব্দ ‘কাম’ Ñ কামনা বাসনা
বা ইন্দ্রিয় সুখ ভোগকে উদ্দেশ্য করে ব্যবহৃত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ উপদেশ
দিচ্ছেন যে ‘কাম’ অথবা আমাদের নিজেদের বাসনা পরিতৃপ্তির জন্য আমাদের কাজ
করা উচিত নয়। ভগবদ্গীতার পুরো শিক্ষাটি এই নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
অর্জুন নিজ আত্মীয়দের সাথে যুদ্ধে বিরত হয়ে তার নিজের ইন্দ্রিয় উপভোগ করতে
চেয়েছিলেন, কিন্তু কৃষ্ণ অর্জুনের দৃঢ় প্রত্যয় উৎপাদনের নিমিত্ত পরমেশ্বরের
সন্তোষ বিধানের জন্য তার কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করতে বললেন। তবে জড়
দৃষ্টিতে এ খুব পুণ্য কর্ম বলে মনে হতে পারে যে, সে তার রাজ্যের দাবি ত্যাগ
করছে এবং তার আত্মীয়দের হত্যা করতে অস্বীকার করছে, কিন্তু তা অনুমোদন
করলেন না কারণ অর্জুনের সিদ্ধান্তের নীতি ছিল তার নিজ ইন্দ্রিয় পরিতুষ্টি
বিধান করা। কারোর কারবার বা বৃত্তির পরিবর্তনের প্রয়োজন নেইÑ যেমন অর্জুনের
পরিবর্তন করতে হয় নিÑ কিন্তু একজনকে তার চেতনার পরিবর্তন করতে হবে। যা
হোক, এই চেতনার পরিবর্তনের জন্য জ্ঞানের প্রয়োজন। সেই জ্ঞান জানাচ্ছেÑ‘‘আমি
কৃষ্ণের অংশ, কৃষ্ণের উৎকৃষ্ট শক্তি।’’ সেটি হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞান। আপেক্ষিক
জ্ঞান (জবষধঃরাব কহড়ষিবফমব) হয়ত আমাদের শেখাতে পারে কিভাবে একটি যন্ত্র
মেরামত করতে হয়, কিন্তু প্রকৃত জ্ঞান হচ্ছে কৃষ্ণের সাথে আমাদের পূর্ণ
সম্পর্ক জ্ঞাত হওয়া। তাঁর অংশ হওয়ার ফলে, আমাদের আনন্দ যা আংশিক তা সমগ্রের
ওপর নির্ভরশীল। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আমার হাত সুখানুভব করতে পারে, যখন সেটি
আমাদের দেহের সাথে যুক্ত হয়ে তার সেবা করে। অন্যের দেহের সেবা করে এ হাত
সুখানুভব করতে পারে না। যেহেতু আমরা কৃষ্ণের অংশ, আমাদের আনন্দ তাঁর
সেবাতেই। ‘‘আপনাকে সেবা করে আমি সুখী হতে পারি না,’’ প্রত্যেকেই মনে করছে,
‘‘নিজের সেবা করেই শুধু সুখী হতে পারি।’’ কিন্তু কেউই জানে না এই আত্মাটি
(ঝবষভ) ) কে। আত্মাটি হচ্ছে কৃষ্ণ।
‘‘জীবলোকে জীবাত্মারা আমার শাশ্বত অতি ক্ষুদ্র অংশ। জীবন মায়াবদ্ধ হওযার
ফলে তারা ছয়টি ইন্দ্রিয় দ্বারা কঠোর সংগ্রাম করছে, যার মধ্যে মন একটি
ইন্দ্রিয়। (গীতা ১৫/৭)
জীবাত্মারা এখন ভৌতিক সংস্পর্শের জন্য পূর্ণ থেকে বিচ্ছিন্ন। তাই সুপ্ত
ভাবনার মাধ্যমে পুনরায় আমাদিগকে সংযুক্ত করার জন্য আমাদের প্রবল চেষ্টা করা
প্রয়োজন। কৃত্রিমভাবে আমরা কৃষ্ণকে ভুলে যেতে চেষ্টা করছি এবং স্বাধীনভাবে
জীবন যাপন করছি, কিন্তু তা সম্ভব নয়। যখন আমরা কৃষ্ণ থেকে স্বতন্ত্রভাবে
জীবন যাপন করতে উদ্যোগী হই, তখন আমরা প্রকৃতির নিয়মের অধীন হয়ে পড়ি। কেউ
যদি নিজেকে কৃষ্ণ থেকে স্বতন্ত্র মনে করে, সে তখন কৃষ্ণের মায়িক শক্তির
অধীন হয়ে পড়ে, ঠিক যেমন কেউ যদি মনে করে যে সে সরকার ও তার আইন থেকে
স্বতন্ত্র, সে তখন পুলিশ বাহিনীর অধীন হয়ে পড়ে। প্রত্যেকেই স্বাধীন হওয়ার
চেষ্টা করছে, আর একেই বলে মায়া (রষষঁংরড়হ)। ব্যক্তি, স¤প্রদায়, সমাজ, জাতি
বা বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীন হওয়া সম্ভব নয়। যখন আমরা উপলব্ধি করি যে
আমরা অধীন, তখন আমরা জ্ঞান লাভ করব। আজকাল কত লোক বিশ্ব শান্তির জন্য প্রবল
চেষ্টা করছে, কিন্তু তারা জানে না কিভাবে ঐ শান্তি সূত্র কাজে লাগান যায়।
রাষ্ট্রপুঞ্জ বহু বছর ধরে শান্তির জন্য চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু তবু যুদ্ধ
চলছে।
‘‘তা ছাড়া, ও অর্জুন, সমগ্র সৃষ্টির আমিই বীজদাতা পিতা। চর বা অচর এমন কোন জীব নেই Ñ যা আমাকে ছাড়া জীবিত থাকতে পারে।’’ (গীতা ১০/৩৯)
এভাবে কৃষ্ণ হচ্ছেন সব কিছুর মালিক, পরম কল্যাণকামী ও সব কিছুর ফল
গ্রহণকারী। আমরা আমাদিগকে আমাদের শ্রমজাত ফলের মালিক মনে করতে পারি, কিন্তু
এটি একটি ভুল ধারণা। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে কৃষ্ণ আমাদের সমগ্র
কর্মজাত ফলের মালিক। কোন কর্মস্থলে শত শত লোক কাজ করতে পারে, কিন্তু তারা
বুঝতে পারে যে, ব্যবসায়ে যা লাভ হবে তা মালিকের। যে-মাত্র ব্যাঙ্কের
খাজাঞ্চী মনে করে, যেইভাবে ‘ও, আমার কত টাকা আছে। আমি হচ্ছি মালিক।
টাকাগুলি আমার সাথে বাড়িতে নিয়ে যাই,’’ তার কষ্ট তখন শুরু হয়। আমরা যদি
ভাবি যে আমাদের নিজেদের ইন্দ্রিয় তর্পণের জন্য আমাদের সঞ্চিত যত সম্পদ আছে
তা আমরা ব্যবহার করতে পারি, তাহলে বুঝতে হবে আমরা তা কামের তাড়নায় করছি।
কিন্তু আমরা যদি উপলব্ধি করি যে আমাদের সব কিছুর মালিক কৃষ্ণ, তখন আমরা
মুক্ত। আমাদের কাছে হয়ত একই টাকা আছে, কিন্তু যে মাত্র আমরা ভাবি যে আমরা
মালিক, তখন আমরা মায়ার অধীন হয়ে পড়ি। যে এই ভাবনায় অবস্থিত যে, সব কিছুর
মালিক কৃষ্ণ, সেই যথার্থ পণ্ডিত ব্যক্তি।
‘‘সচেতন অথবা অচেতনÑ বিশ্বের সমস্ত কিছু ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণাধীন ও ঈশ্বরই
সমস্ত কিছুর মালিক। তাই বরাদ্দকৃত তার নিজের যতটুকু প্রয়োজন সেটুকু গ্রহণ
করা উচিত এবং কে যথার্থ মালিক তা ভালভাবে জেনে, অপরের জিনিস কিছুতেই গ্রহণ
করা উচিত নয়।’’ (শ্রীঈশোপনিষদ)
‘ঈশাবাস্য’ - এর এই মনোভাব Ñ সমস্ত কিছুর মালিক কৃষ্ণÑঅবশ্যই এই চেতনায়
জাগ্রত করতে হবে, তা শুধু এককভাবে নয়, জাতীয়-জীবনে ও বিশ্বজনীন ভাবেও। তখনই
শান্তি সম্ভব। লোকহিতৈষী ও পরোপকারী হবার প্রতি আমাদের প্রায় সকলেরই ঝোঁক
আছে এবং আমরা আমাদের দেশবাসীর, আমাদের পরিবার ও জগতের সকলের সাথে বন্ধু
ভাবাপন্ন হবার চেষ্টা করি Ñ কিন্তু এটি ভুল ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃত
বন্ধু হচ্ছে কৃষ্ণ, আর যদি আমরা আমাদের পরিবারের জাতির বা গ্রহলোকের উপকার
সাধন করতে চাই, তাহলে আমাদের তাঁর সেবা করতে হবে। যদি আমরা আমাদের পরিবারের
মঙ্গল চাই তবে পরিবারের সকলকে কৃষ্ণভাবনায় পরিণত করতে আমাদের সচেষ্ট হতে
হবে। কত লোক তাদের পরিবারের উপকার করতে চেষ্টা করছে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত
তারা সাফল্য লাভ করেনি। তারা জানে না প্রকৃত সমস্যা কি। যেমন ভাগবতে বর্ণনা
আছে, কারোর একজন পিতা, মাতা বা শিক্ষক হবার চেষ্টা করা উচিত নয়, যদি তিনি
তার সন্তানদের মৃত্যু থেকে, জড়া-প্রকৃতির কবল থেকে রক্ষা করতে অসমর্থ হন।
পিতার কৃষ্ণ সম্বন্ধে জ্ঞান থাকা উচিত, আর তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া উচিত
যে তার ওপর দায়িত্ব অর্পিত নিরপরাধ শিশুদের যেন জন্ম-মৃত্যুর আবর্তে আবার
না ভ্রমণ করতে হয়। সে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়ে তার শিশুদের এমনভাবে শিক্ষা দেবে
যে তারা যেন আর যন্ত্রণাময় জন্ম-মৃত্যুর চক্রের অধীন না হয়। কিন্তু এসব
করার আগে, তাকে স্বয়ং অভিজ্ঞ হতে হবে। সে কৃষ্ণভাবনায় অভিজ্ঞ হলে, শুধু তার
সন্তানকেই নয়, তাছাড়া তার সমাজ ও জাতিকেও সাহায্য করতে পারে।
কিন্তু সে নিজেই যদি অবিদ্যার পাশে আবদ্ধ থাকে, তাহলে যারা সেভাবে আবদ্ধ
তাদেরই বা সে কিভাবে একত্রিত করবে? অন্যদের মুক্ত করার আগে, নিজেকে অবশ্যই
মুক্ত হতে হবে। প্রকৃতপক্ষে কেউ মুক্ত পুরুষ নয়, কারণ প্রত্যেকে
জড়াপ্রকৃতির অধীন, কিন্তু যে কৃষ্ণের চরণাশ্রিত তাকে মায়া স্পর্শ করতে পারে
না। সকল মানুষের মধ্যে সে মুক্ত। যে সূর্যালোকে আছে, তার কাছে অন্ধকারের
প্রশ্নই নেই। কিন্তু যে কৃত্রিম আলোর নিচে আছে, সেই আলো কেঁপে কেঁপে জ্বলতে
থাকে এবং এক সময় নিভে যায়। কৃষ্ণ ঠিক যেন সূর্যালোক। যেখানে তিনি উপস্থিত
আছেন, সেখানে অন্ধকার ও অবিদ্যার প্রশ্ন নেই। জ্ঞানী ব্যক্তি ও মহাত্মারা
এসব উপলব্ধি করেন।
‘‘আমি সমগ্র চিন্ময় ও জড় জগতের উৎস। সব কিছুই আমার থেকে উৎপন্ন হয়। যারা
জ্ঞানী ব্যক্তি তারা তা ঠিকভাবে জানে, তারা আমার ভক্তিযুক্ত সেবায়
সম্পূর্ণরূপে নিয়োজিত হয় ও সর্বান্তঃকরণে আমাকে পূজা করে।’’ (গীতা ১০/৮)
এই শ্লোকে ‘বুধা’ শব্দটি প্রয়োগ হয়েছে, যার দ্বারা একজন জ্ঞানী বা বিজ্ঞ
ব্যক্তিকে নির্দেশ করা হয়েছে। তার লক্ষণ কি? তিনি জানেন যে কৃষ্ণই সব
কিছুর, সকল উৎপত্তির পরম উৎস। তিনি জানেন যে যা কিছু তিনি দেখছেন, তা সবই
কৃষ্ণের থেকে প্রকাশিত। এই প্রাকৃত জগতে যৌন জীবনের প্রাধান্য সর্বাধিক।
যৌন আকর্ষণ সব প্রজাতির জীবের মধ্যে দেখা যায়, আর একজন জিজ্ঞেস করতে পারে
এসব কোত্থেকে আসছে। জ্ঞানী ব্যক্তি বুঝতে পারেন যে, এই প্রবণতা কৃষ্ণের
মধ্যে আছে আর বৃন্দাবনে গোপীদের সাথে তাঁর সম্বন্ধের মধ্যেই তা প্রকাশিত
হয়েছে। যা কিছু এই প্রাকৃত জগতে দেখতে পাওয়া যায়, কৃষ্ণের মধ্যেও তা
সম্পূর্ণভাবে দেখতে পাওয়া যাবে। পার্থক্য এই যে, প্রাকৃত জগতে প্রত্যেক
জিনিসই বিকৃতভাবে প্রকাশিত। কৃষ্ণের মধ্যে এই সব প্রবণতা আর এই সব
অভিব্যক্তি চিন্ময় ও শুদ্ধ চেতনার স্তরে। পরিপূর্ণ জ্ঞানের মাধ্যমে, যে
এসব জানে, সে একজন শুদ্ধ কৃষ্ণভক্ত হয়।
‘‘হে, পার্থ, যারা ভ্রান্তপথে চালিত হয় না, সেই মহাত্মারা আমার দৈবী
প্রকৃতির আশ্রয়ের অধীনে। তারা ভগবদ্ভক্তিতে সম্পূর্ণরূপে নিয়োজিত কারণ তারা
আমাকে আদি, অব্যয় এবংপরম পুরুষ ভগবানরূপে জানে। অত্যন্ত দৃঢ়ব্রত
হয়ে,সর্বদা আমার গুণকীর্তন করে এবং আমার সম্পুখে প্রণত হয়ে এই মহাত্মারা
ভক্তি সহকারে নিত্যকাল আমাকে উপাসনা করে।’’ (গীতা ৯/১৩-১৪)
‘মহাত্মা কে? তিনিই হচ্ছেন মহাত্মা যিনি পরা-শক্তির প্রভাবাধীন। বর্তমানে
আমরা কৃষ্ণের অপরা-শক্তির প্রভাবাধীন। জীবাত্মারূপে আমাদের অবস্থান হচ্ছে
‘তটস্থা’Ñ আমরা এই দুটি শক্তির যে কোন একটিতে আমাদেরকে স্থানান্তরিত করতে
পারি। কৃষ্ণ সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন, আর যেহেতু আমরা কৃষ্ণের অংশ, তাই এই
স্বাতন্ত্র্য-গুণ আমাদের মধ্যেও আছে। সুতরাং এটি আমাদের অভিরুচি যে কোন
শক্তির অধীনে আমরা কাজ করব। যেহেতু পরা-প্রকৃতি সম্বন্ধে আমাদের কোন জ্ঞান
নেই, তাই এই অপরা-প্রকৃতিতে অবস্থান করা ছাড়া আমাদের কোন বিকল্প নেই।
কোন কোন দর্শন উপস্থাপন করে যে আমরা অধুনা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যে প্রকৃতিকে
অনুভব করছি তাছাড়া অন্য কোন প্রকৃতি নেই, আর এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে এর
বিলোপ সাধন করে শূন্যে পরিণত হওয়া। কিন্তু আমরা শূন্যে বিলুপ্ত হতে পারি
না, আমরা শূন্যে মিশতে পারি না, কারণ আমরা জীবাত্মা। এর অর্থ এই নয় যে আমরা
বিনাশ প্রাপ্ত হয়েছি, যেহেতু আমরা দেহ পরিবর্তন করি। জড়া-প্রকৃতির
প্রভাবমুক্ত হয়ে বাইরে আসার আগে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে আমাদের স্থান
প্রকৃতপক্ষে কোথায়, আর কোথায় আমাদের যেতে হবে। যদি আমরা কোথায় যাব তা না
জানি, তাহলে আমরা শুধু বলব, ‘‘ও, আমরা জানি না ক্ন্োিট উৎকৃষ্ট আর কোন্টি
নিকৃষ্ট। আমরা সকলে যা জানি তা এই, তাই এখানেই অবস্থান করি আর পচতে থাকি।’’
যা হোক ভগবদ্গীতা আমাদিগকে উৎকৃষ্ট শক্তি ও পরা প্রকৃতি সম্বন্ধে তথ্য
প্রদান করে।
কৃষ্ণ কি বলেন, তিনি শাশ্বত কালের কথা বলেন; এর পরিবর্তন নেই। আমাদের
বর্তমান পেশা অথবা অর্জুনের পেশা কি তাতে কিছু যায় আসে নাÑ শুধু আমাদের
চেতনার পরিবর্তন করতে হবে। অধুনা আমার নিজের স্বার্থের মনোভাব দ্বারা চালিত
হই, কিন্তু আমরা জানি না আমাদের যথার্থ নিজেদের স্বার্থ কি। প্রকৃতপক্ষে
ইন্দ্রিয়তৃপ্তির স্বার্থ ছাড়া আমাদের নিজেদের প্রকৃত স্বার্থ নেই। যা-ই
আমরা করছি, তা আমরা ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির জন্যই করছি। ইহার পরিবর্তে আমাদের
প্রকৃত আত্ম-স্বার্থÑ কৃষ্ণভাবনার বীজ অবশ্যই রোপণ করতে হবে।
কিভাবে এ করা যায়? আমাদের জীবনের প্রতি পদে কিভাবে কৃষ্ণ ভাবনাময় হওয়া সম্ভব? প্রকৃতপক্ষে কৃষ্ণ আমাদের জন্য এ খুব সহজ করে দিয়েছেন।
‘‘হে কুন্তীপুত্র (অর্জুন), আমি জলের স্বাদ, আমি চন্দ্র ও সূর্যের আলো, আমি
সমগ্র বৈদিক মন্ত্রের ‘ওঁ’ শব্দ; আমি আকাশের শব্দ ও মানুষের বল।’’ (গীতা
৭/৮)
এই শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বর্ণনা করছেন কিভাবে সম্পূর্ণরূপে, জীবনের সর্বস্তরে
আমরা কৃষ্ণভাবনাময় হতে পারি। সমগ্র জীবসমূহকে অবশ্য জল পান করতে হয়। জলের
স্বাদ এত চমৎকার যে যখন আমরা তৃষ্ণায় কাতর হই, তখন একমাত্র জল ছাড়া অন্য
কিছু মনে উদয় হয় না। কোন কারখানার মালিকই জলের শুদ্ধ স্বাদ তৈরি করতে পারে
না। তাই যখন জল পান করি, তখন আমরা কৃষ্ণ বা ভগবানকে এভাবে স্মরণ করতে
পারি। কেউ তার জীবনের প্রতিটি দিন জল পান করা পরিহার করতে পারে না; তাই
ঈশ্বর-ভাবনাও সেখানে দেখা যায়Ñআমরা কিরূপে তা ভুলে থাকতে পারি?
সেই রকম, আমরা যখন কিছু আলো দেখি, সেটিও কৃষ্ণ। পরব্যোমের আদি অত্যুজ্জ্বল
আলো, ব্রহ্ম-জ্যোতি কৃষ্ণের দেহ থেকে উৎপন্ন। এই ভৌতিক আকাশ আবৃত জড়
ব্রহ্মাণ্ডের স্বাভাবিক অবস্থা হচ্ছে অন্ধকার যা আমরা রাত্রে অনুভব করি। তা
সূর্যের আলো, চন্দ্রের প্রতিফলিত আলো ও বিদ্যুতের আলোর দ্বারা কৃত্রিমভাবে
আলোকিত হয়। কোত্থেকে এই আলো আসছে? ব্রহ্মজ্যোতি বা চিন্ময় জগতের উজ্জ্বল
আলোর দ্বারা সূর্য আলোকিত হয়। চিজ্জগতে চন্দ্র বা সূর্য বা বিদ্যুতের দরকার
নেই, কারণ সেখানকার সব কিছুই ব্রহ্মজ্যোতির দ্বারা আলোকিত হয়। যা হোক এই
পৃথিবীতে যখন সূর্যালোক দেখি, তখনই আমরা কৃষ্ণকে স্মরণ করতে পারি।
‘ওঁ’ শব্দ দিয়ে আরম্ভ বৈদিক মন্ত্র যখন আমরা উচ্চারণ করি, তখন আমরা কৃষ্ণকে
স্মরণ করতে পারি। হরেকৃষ্ণের মত ‘ওঁ’-ও ভগবানের প্রতি একটি সম্বোধন, ‘ওঁ’
হচ্ছে কৃষ্ণ। ‘শব্দে’র অর্থ আওয়াজ, আর যখন কোন শব্দ আমরা শুনি, আমাদের জানা
উচিত যে এ হচ্ছে ওঁ বা হরেকৃষ্ণ শুদ্ধ চিন্ময় শব্দ বা আদি শব্দের স্পন্দন।
প্রাকৃত জগতে যে শব্দই আমরা শুনি তা ঐ আদি চিন্ময় শব্দ ‘ওঁ’-এর প্রতিসরণ
মাত্র। এভাবে আমরা যখন শব্দ শনি, আমরা যখন জল পান করি, আমরা যখন কোন
উজ্জ্বল আলো দেখি, তখন আমরা ভগবানকে স্মরণ করতে পারি। আমরা যদি তা করতে
পারি, তা হলে কোন্ সময় আমরা ভগবানকে স্মরণ করতে পারব না? এইটি হচ্ছে
কৃষ্ণভাবনার পন্থা। এভাবে দিনের চব্বিশ ঘন্টা আমরা কৃষ্ণকে স্মরণ করতে
পারি, আর এভাবে কৃষ্ণ আমাদের সাথে আছেন। নিঃসন্দেহে কৃষ্ণ সব সময় আমাদের
সাথে আছেন, কিন্তু যখনই এসব আমরা স্মরণ করি, তখনই তাঁর উপস্থিতি সত্য হয় ও
অনুভূত হয়।
ভগবানের সঙ্গে মিলিত হবার ন’রকমের বিভিন্ন উপায় আছে, আর ভগবৎ-সঙ্গ লাভের
প্রথম উপায় হল শ্রবণম Ñ শোনা। ভগবদ্গীতা পাঠ করে আমরা কৃষ্ণের বা ভগবানের
সঙ্গ লাভ করছি। (আমাদের সব সময় মনে রাখা উচিত যে, আমরা যখন কৃষ্ণের কথা
বলি, তখন ভগবানকে উল্লেখ করি।) এই কারণে আমরা ভগবানের সঙ্গ লাভ করি এবং যতই
আমরা কৃষ্ণ ও তাঁর নাম শ্রবণ করতে থাকি, জড়া-প্রকৃতির কলুষতা ততই হ্রাস
প্রাপ্ত হয়। কৃষ্ণই শব্দ, আলো, জল আর অন্যান্য কত কিছু Ñএই উপলব্ধি হলে,
কৃষ্ণ থেকে দূরে থাকা অসম্ভব। এইভাবে যদি আমরা কৃষ্ণকে মনে রাখতে পারি, তা
হলে আমাদের কৃষ্ণের সহিত সঙ্গ লাভ চিরস্থায়ী হয়।
কৃষ্ণের সঙ্গ লাভ সূর্যালোকের সঙ্গ লাভ করার মত। যেখানে সূর্যালোক সেখানে
কলুষতা নেই। যতক্ষণ একজন সূর্যের অতিবেগুনী আলোর বাইরে থাকে, সে
রোগাক্রান্ত হবে না। পাশ্চাত্য দেশের ওষুধে, সব রকম রোগের জন্য সূর্যালোককে
অনুমোদন করা হয়, আর বেদ অনুসারে আরোগ্য লাভের জন্য একজন রুগ্ন ব্যক্তির
সূর্যদেবের উপাসনা করা উচিত। সেই রকম কৃষ্ণভাবনার মাধ্যমে আমরা কৃষ্ণের
সঙ্গ লাভ করলে, আমাদের রোগের উপশম হবে। ‘হরেকৃষ্ণ’ কীর্তন করে আমরা কৃষ্ণের
সঙ্গ করতে পারি, আর আমরা কৃষ্ণরূপে জলকে দেখতে পারি, সূর্য ও চন্দ্রকে
কৃষ্ণরূপে দেখতে পারি, আর শব্দের মাধ্যমে আমরা কৃষ্ণকে শুনতে পারি এবং জলের
মাধ্যমে তাঁকে আস্বাদন করতে পারি। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের বর্তমান অবস্থায়
আমরা কৃষ্ণকে ভুলে গেছি। কিন্তু এখন তাঁকে স্মরণ করে আমাদের পারমার্থিক
জীবনকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে।
এই ‘শ্রবণম্ কীর্তনম্’ এর পন্থা Ñ শোনা ও কীর্তন করা Ñ ভগবান শ্রীচৈতন্য
মহাপ্রভুর দ্বারা অনুমোদিত। যখন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর বন্ধু ও পরম-ভক্ত
রামানন্দ রায়ের সাথে কথা বলছিলেন, তখন তিনি তাকে আত্মোপলব্ধির পন্থা
সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। রামানন্দ রায় বর্ণাশ্রম-ধর্ম, সন্ন্যাস,
নিস্কাম কর্ম ও অন্যান্য অনেক পন্থার সুপারিশ করেন, কিন্তু শ্রীচৈতন্য
মহাপ্রভু বলেছিলেন, ‘‘না, এসব পথ তত মঙ্গলকর নয়।’’ প্রতিবার রামানন্দ রায়
কোন পন্থার সুপারিশ করেন, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তা বাতিল করেন এবং
পারমার্থিক প্রগতির নিমিত্ত আরো উৎকৃষ্ট পথের জন্য অনুরোধ করতে থাকেন।
অবশেষে রামানন্দ রায় এক বৈদিক সূত্র উল্লেখ করেন যাতে সুপারিশ করা আছে যে,
ঈশ্বর উপলব্ধির জন্য মানসিক যুক্তিতর্কের অযথা সব প্রয়াস ত্যাগ করতে হবে,
কারণ তর্কবিচার দিয়ে পরম সত্যের নিকট পৌঁছান যায় না। যেমন বিজ্ঞানীরা দূরের
নক্ষত্র ও গ্রহের বিষয়ে অনেক তর্কবিচার করতে পারে, কিন্তু অভিজ্ঞতা ছাড়া
তারা কখন কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। একজন তার সারা জীবনভর যুক্তিতর্ক
করেও কখন কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে না।
বিশেষত ভগবানের বিষয়ে তর্কবিচার করা অর্থহীন। তাই শ্রীমদ্ভাগবত নির্দেশ
প্রদান করছে যে সব রকম যুক্তিতর্ক ত্যাগ করা উচিত। সেই শুধু এক তুচ্ছ জীব
নয় এমন কি এই পৃথিবীর বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে শুধু একটি ছোট্ট বিন্দু
মাত্র তা উপলব্ধি করে, শ্রীমদ্ভাগবতে বরং নম্র হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
নিউইয়র্ক শহরকে দেখতে খুব বড় মনে হয়, কিন্তু যখন একজন উপলব্ধি করে যে এই
পৃথিবী একটি কত ছোট জায়গা, আর এই পৃথিবীর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেন
অন্য একটি ছোট্ট জায়াগা ছাড়া আর কি, এবং নিউইয়র্ক শহরে এক ব্যক্তি লক্ষ
লক্ষের মধ্যে একজন তত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নয়। বিশ্বেও কাছে এবং ভগবানের
কাছে আমাদের নগন্যতা উপলব্ধি করে, আমাদের মিথ্যা গর্বে স্ফীত হওয়া উচিত নয়,
বরং নম্র হওয়া উচিত। আমাদের খুব সতর্ক হওয়া উচিত যাতে আমরা ব্যাঙের
দর্শনের খপ্পরে না পড়ি। এক সময় এক কুয়োয় এক ব্যাঙ বাস করত। এক বন্ধু দ্বারা
অতলান্তিক মহাসাগরের অস্তিত্বের কথা জানতে পেরে, সে বন্ধুকে জিজ্ঞেস করল,
‘‘আচ্ছা, এই অতলান্তিক মহাসাগরটি কি?’’
তার বন্ধু বলল, ‘‘এটি এক বিশাল জলাশয়।’’ ‘‘কত বড়? এটি কি এই কুয়োর দু’গুণ
বড়? ‘‘না, না, অনেক অনেক বড়’’, তার বন্ধু বলল। ‘‘তুলনায় কত বড়? এর দশগুণ
বড়? এভাবে ব্যাঙ হিসাব করছিল। কিন্তু তার পক্ষে মহাসাগরের পরিসীমা ও গভীরতা
আদৌ উপলব্ধি করার সম্ভাবনা কোথায়? আমাদের ক্ষমতা, অভিজ্ঞতা ও যু্িক্তবিচার
শক্তি সব সময় সীমাবদ্ধ। আমরা শুধু ব্যাঙের মত দর্শন উত্থাপন করতে পারি।
তাই শ্রীমদ্ভাগবতে নির্দেশ আছে যে, পরব্রহ্মের উপলব্ধির চেষ্টায়
যুক্তিতর্কের পথকে শুধু সময় নষ্ট মনে করে, ত্যাগ করা উচিত।
যুক্তিতর্কের পথ ছেড়ে দিলে, পরে আমরা কি করব? ভাগবতে নির্দেশ আছে যে আমাদের
নম্র হতে হবে আর বিনম্্রভাবে ভগবানের কথা শুনতে হবে। এই ভগবানের কথা
ভগবদ্গীতাতেও পাওয়া যাবে এবং অন্যান্য বৈদিক সাহিত্যে, বাইবেলে বা কোরান Ñ
যে কোন প্রামাণ্য ধর্মশাস্ত্রে অথবা ভগবানের কথা কোন তত্ত¡দর্শীর কাছে শোনা
যেতে পারে। প্রধান বিষয় এই যে, কারোর যুক্তিতর্ক করা উচিত নয় বরং শুধু
ভগবানের কথা শোনা উচিত। আর ঐ রকম শোনার ফল কি হবে? সে যাাই হোক না Ñ সে
গরীব হোক বা ধনীই হোক, আমেরিকান হোক, ইউরোপিয়ান হোক অথবা ভারতীয়ই হোক,
ব্রাহ্মণ, শূদ্র বা যাই হোক Ñ যদি কেউ শুধু ভগবানের কথামৃত শোনে, ভগবান,
যিনি কোন ক্ষমতা বা শক্তির দ্বারা বশীভূত হন না, তিনি ভালবাসার দ্বারা
বশীভূত হন। অর্জুন ছিল কৃষ্ণের এক বন্ধু, কিন্তু কৃষ্ণ সর্বশক্তিমান ভগবান
হওয়া সত্তে¡ও, অর্জুনের একজন অধীনস্থ ভৃত্যরূপে রথচালক হয়েছিলেন। অর্জুন
কৃষ্ণকে ভালবাসত আর কৃষ্ণ এভাবে তার ভালবাসার প্রতিদান দিয়েছিলেন। সেই রকম,
কৃষ্ণ যখন এক ছোট্ট শিশু, তিনি খেলাচ্ছলে তাঁর পিতা নন্দমহারাজের জুতো
নিয়ে তাঁর মাথায় রেখেছিলেন। লোকে ভগবানের সাথে মিশে এক হয়ে যাওয়ার জন্য খুব
কঠিন চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা তাও অতিক্রম করতে পারিÑ
আমরা ভগবানেরও পিতা হতে পারি। অবশ্য ভগবানই সব জীবের পিতা, এবং তাঁর নিজের
কোন পিতা নেই। কিন্তু তিনি তাঁর ভক্তকে, তাঁর প্রিয়জনকে পিতারূপে গ্রহণ
করেন। কৃষ্ণ তাঁর ভক্তের ভালবাসার দ্বারা বিজিত হতে সম্মত হন। প্রত্যেককে
যা করতে হবে তা হচ্ছে খুব যতেœর সঙ্গে ভগবানের কথা শোনা।
ভগবদ্গীতায় সপ্তম অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ অতিরিক্ত পন্থার কথা বলেছেন যাতে জীবের প্রতি পদক্ষেপে তাঁকে অনুভব করা যায় ঃ
‘‘আমি পৃথিবীর আদি গন্ধঃ, এবং আগুনের উত্তাপ। আমি সকল জীবের জীবন, এবং আমি তপস্বীদের তপস্যা।’’ (গীতা ৭/৯)
‘পুণ্যো গন্ধঃ’ শব্দে সুগন্ধকে উল্লেখ করছে। একমাত্র কৃষ্ণ স্বাদ ও সুগন্ধ
সৃষ্টি করতে পারেন। আমরা রাসায়নিক প্রণালীতে সংমিশ্রণের দ্বারা কিছু সুগন্ধ
সৃষ্টি করতে পারি, কিন্তু তা প্রকৃতিজাত মৌলিক গন্ধের মত তত ভাল নয়। যখন
আমরা এক প্রকৃতিজাত সুগন্ধের ঘ্রাণ নিই, আমরা মনে করতে পারি, ‘‘ও, এই ত
ভগবান। এই তা কৃষ্ণ।’’ অথবা যখন আমরা কোন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখি তখন আমরা
ভাবতে পারি, ‘‘ও, এই ত কৃষ্ণ।’’ অথবা যখন আমরা অসাধারণ ক্ষমতাশালী বা
আশ্চর্যজনক কিছু দেখি তখন আমরা ভাবতে পারি, ‘‘এই ত কৃষ্ণ।’’ অথবা যখন আমরা
জীবনের যে কোন রূপই দেখি না তা একটি বড় গাছ, একটি চারা গাছ, বা একটি পশু
অথবা একটি মানুষের মধ্যেই হোক, আমাদের বোঝা উচিত যে এই জীবন কৃষ্ণের অংশ,
কারণ যেই মুহূর্তে কৃষ্ণের অংশ চিৎকণা দেহ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়, তখন দেহ
নানা অংশে বিভক্ত হয়।
‘‘হে পৃথার পুত্র ! জেনে রাখ যে আমি সমগ্র জীবের আদি বীজ, বুদ্ধিমানের বুদ্ধিমত্তা এবং শক্তিমান পুরুষের শক্তি।’’ (গীতা ৭/১০)
এখানে আবার স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কৃষ্ণ সকল জীবের জীবন। এভাবে প্রতি
পদক্ষেপে আমরা ঈশ্বরকে দেখতে পারি। লোকে জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘‘আপনি আমাকে
ভগবান দেখাতে পারেন?’’ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। ভগবানকে কতভাবে দেখা যেতে পারে।
কিন্তু যদি কেউ তার চোখ বুজে বলে, ‘‘আমি ভগবানকে দেখব না, ’’ তাহলে কি করে
তাকে ভগবান দেখান যাবে?
ওপরের শ্লোকে ‘বীজম্’ শব্দের অর্থ বীজ, আর সেই বীজকে নিত্য (সনাতন) বলে
প্রচার করা হয়। কেউ এক বিশাল গাছকে দেখতে পারে, কিন্তু গাছের মূল কি? মূল
হচ্ছে বীজ, আর এই বীজ হচ্ছে সনাতন। সৃষ্টির বীজ প্রত্যেক জীবের মধ্যেই
বর্তমান। দেহের অনেক পরিবর্তন হয়Ñ মায়ের গর্ভে এর বৃদ্ধি হয়, এক ছোট্ট
বাচ্ছা হয়ে মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসে এবং সে শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের মধ্যে
দিয়ে বড় হয়Ñকিন্তু দেহের মধ্যে স্থিত বীজ চিরস্থায়ী। তাইতো এ হচ্ছে সনাতন।
অনুভব করতে না পারলেও, আমরা প্রতি মুহূর্তে, প্রতি সেকেণ্ডে আমাদের দেহের
পরিবর্তন করছি। কিন্তু ‘বীজম্’Ñ অর্থাৎ বীজ বা চিৎ কণা পরিবর্তন করে না।
কৃষ্ণ সকল জীবের মধ্যে নিজেকে সনাতন বীজ বলে ঘোষণা করেন। তিনি একজন
বুদ্ধিমান ব্যক্তির বুদ্ধিও। কৃষ্ণ দ্বারা অনুগ্রহ লাভ না হলে, একজন
অসাধারণ বুদ্ধিমান হতে পারে না। প্রত্যেকেই অন্যের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান হতে
চেষ্টা করছে, কিন্তু কৃষ্ণের অনুগ্রহ ছাড়া তা সম্ভব নয়। তাই যখনই আমরা
অসাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন কারও সাক্ষাৎ করি, আমাদেও মনে করা উচিত, ‘‘ঐ
বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে ‘কৃষ্ণ’।’’ সেই রকম অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রভাবও
কৃষ্ণ।
‘হে ভরতশ্রেষ্ঠ (অর্জুন), আমি হচ্ছি কাম-রাগ বর্জিত বলাবানের বল। আমি হচ্ছি
ধর্মের বিরোধহীন যৌনজীবন।’’ (গীতা ৭/১১) হাতি ও গরিলা খুব বলশালী পশু, এবং
আমাদের বোঝা উচিত যে তারা তাদের শক্তি পেয়েছে কৃষ্ণের কাছে। মানুষ তার
নিজের চেষ্টায় ঐ রকম শক্তি অর্জন করতে পারে না, কিন্তু যদি কৃষ্ণ ঐ রকম
অনুগ্রহ করে, একজন লোক হাতির চেয়েও হাজার গুণ বেশি শক্তি পেতে পারে।
কুরুক্ষেত্রের রণক্ষেত্রে যিনি যুদ্ধ করেছিলেন, সেই মহাবীর ভীমকে একটি
হাতির দশ-হাজার গুণ শক্তিশালী বলা হত। সেই রকম বাসনা বা কাম, যা ধর্মের
বিরোধী নয় তাকেও কৃষ্ণ রূপে দেখা উচিত। এই কাম কি? কাম অর্থে সাধারণত
যৌনজীবন, কিন্তু এখানে ‘কাম’ যৌনজীবনকে উল্লেখ করেছে, যা ধর্মের বিরোধী নয়,
অর্থাৎ সুসন্তান লাভের জন্য যদি কেউ কৃষ্ণভাবনাময় সন্তান জন্মদান করতে
পারে, সে হাজার বার সহবাস করতে পারে, কিন্তু সে যদি কুকুর বেড়ালের মত
সন্তান জন্মদান করে, তাহলে তার যৌনজীবন ধর্মবিরোধী অবৈধ বলে বিবেচিত হবে।
ধর্মীয় এবং সভ্য সমাজে, বিবাহের দ্বারা উদ্দেশ্য নিরূপিত হয় যে, বিবাহিত
দম্পতি উত্তম সন্তান জন্মদানের জন্য যৌন সহবাসে মিলিত হতে পারে। তাই
বিবাহিত যৌনজীবন ধর্মসঙ্গত হিসাবে বিবেচিত, এবং অবিবাহিত যৌনজীবন
ধর্মবিরোধী বলে বিবেচিত। প্রকৃতপক্ষে সন্ন্যাসী ও গৃহস্থের মধ্যে কোন
পার্থক্য নেইÑএই শর্তে যে গৃহস্থের মৈথুন-ক্রিয়া ধর্মনীতি ভিত্তিক।
‘‘সাত্তি¡ক, রাজসিক বা তামসিকÑ সব রকমের জীবÑ আমার শক্তি-দ্বারা প্রকাশিত।
এক অর্থে, আমিই সব কিছুÑ কিন্তু আমি স্বাধীন। আমি এই জড়া-প্রকৃতির গুণের
অধীন নই। (গীতা ৭/১২)
একজন কৃষ্ণকে এভাবে প্রশ্ন করতে পারে ঃ ‘‘আপনি বলেন, আপনি শব্দ, জল, আলো,
সুগন্ধ, সব কিছুর বীজ, শক্তি ও কামÑতার অর্থ কি এই যে আপনি সাত্তি¡ক গুণে
অবস্থিত?’’
প্রাকৃত জগতে সাত্তি¡ক, রাজসিক ও তামসিক গুণ আছে। এই পর্যন্ত, যা কিছু ভালো
(যেমন ধর্মীয় নীতি অনুসারে বিবাহে স্ত্রীসঙ্গ করা) কৃষ্ণ নিজেকে তা বলে
বর্ণনা করছেন। কিন্তু অন্যান্য গুণের বিষয় কি? কৃষ্ণ কি তাতে নেই? উত্তরে,
কৃষ্ণ বলছেন যে প্রাকৃত জগতে যা কিছু দেখা যায় তা জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণের
পারস্পরিক ক্রিয়ার জন্য। যা কিছুই নজরে দেখা যায়, সবই সত্ত¡, রজো ও
তমোগুণের সমন্বয়, এবং সবক্ষেত্রেই এই তিনটে অবস্থা Ñ‘‘আমার দ্বারা
সৃষ্টি।’’ যেহেতু তারা কৃষ্ণের সৃষ্টি, তাই তাদের অবস্থান কৃষ্ণের মধ্যে,
কিন্তু কৃষ্ণ তাদের মধ্যে নন, কারণ কৃষ্ণ নিজে হচ্ছেন ত্রিগুণাতীত। এভাবে,
আর এক অর্থে, তমোগুণজাত খারাপ ও মন্দ জিনিস যখন তা কৃষ্ণ দ্বারা নিয়োজিত,
তাও কৃষ্ণ। কিভাবে এ সম্ভব? দৃষ্টান্তস্বরূপ, একজন বৈদ্যুতিক কারিগর,
বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপন্ন করছে। আমাদের বাড়িতে আমরা এই বৈদ্যুতিক শক্তি
রেফ্রিজারেটর-এ ঠাণ্ডাভাবে বা বৈদ্যুতিক স্টোভে গরমভাবে অনুভব করছি, কিন্তু
বৈদ্যুতিক উৎপাদন কারখানায় বৈদ্যুতিক শক্তি ঠাণ্ডাও নয়, গরমও নয়। জীবের
কাছে এই শক্তির পার্থক্য হতে পারে, কিন্তু কৃষ্ণের কাছে তার পার্থক্য নেই।
তাই কৃষ্ণের কাজ কখন কখন তামসিক বা রাজসিক মনে হতে পারে, কিন্তু কৃষ্ণের
কাছে তা কৃষ্ণ ছাড়া কিছুই নয়, ঠিক যেমন বৈদ্যুতিক কারিগরের কাছে বৈদ্যুতিক
শক্তি শুধুই বিদ্যুৎ আর কিছুই নয়। তার কাছে কোন পার্থক্য নেই যে, এ হচ্ছে
‘ঠাণ্ডা বিদ্যুৎ’ অথবা ও হচ্ছে ‘গরম বিদ্যুৎ।’
সব জিনিষই কৃষ্ণের সৃষ্টি। বাস্তবিক, বেদান্ত-সূত্র দৃঢ়ভাবে সমর্থন
করেÑঅথাতো ব্রহ্ম-জিজ্ঞাসা, জন্মাদ্যস্য যতঃ Ñ সব কিছুই পরম তত্ত¡ থেকে
প্রবাহিত হচ্ছে। জীবাত্মার বিবেচনায় ভালো বা মন্দ যা কিছু, তা শুধু
জীবাত্মার কাছে, কারণ সে বদ্ধজীব। কিন্তু যেহেতু কৃষ্ণ বদ্ধ জীব নয়, তাঁর
কাছে ভাল-মন্দের প্রশ্ন নেই। যেহেতু আমরা মায়াবদ্ধ, তাই আমরা দ্ব›দ্ব-ভোগ
করি, কিন্তু কৃষ্ণের কাছে সবই পরিপূর্ণ।
অসাধারণ এক উপদেশ বাণী দিয়েছেন, অনেকেই একটা কথা বলে যে অর্জন যুদ্ধ করতে না চাওয়াতে শ্রীকৃষ্ণ জোর করে তাকে যুদ্ধে পাঠিয়েছে, কিন্তু এটা যে কি যুদ্দ এবং কেন এই যুদ্ধ করা হয়েছে এখানে যে কতবড় দার্শনিকতা আছে তা যদি তারা বুঝত!!!!, গীতার বানী গুলো শুনতে ভালা লাগে কিন্তু সম্পূর্ণ ভাবে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা বেশ কষ্টকর। তবে চেষ্টায় কী না সফল হয়??????????????????/