n বেদ- বৈদিক সাহিত্য ও হিন্দু - 12 August 2011 - হিন্দু ধর্ম ব্লগ - A Total Knowledge Of Hinduism, সনাতন ধর্ম Hinduism Site
Friday
19-04-2024
11:09 PM
Login form
Search
Calendar
Entries archive
Tag Board
300
Site friends
  • Create a free website
  • Online Desktop
  • Free Online Games
  • Video Tutorials
  • All HTML Tags
  • Browser Kits
  • Statistics

    Total online: 1
    Guests: 1
    Users: 0

    Hinduism Site

    হিন্দু ধর্ম ব্লগ

    Main » 2011 » August » 12 » বেদ- বৈদিক সাহিত্য ও হিন্দু Added by: শকুন্তলা-দেবী
    12:16 PM
    বেদ- বৈদিক সাহিত্য ও হিন্দু
    বিজ্ঞানঃ অনেকের ধারনা বৈদিক যুগের ঋষিগণ বৈজ্ঞানিক তথ্য সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ছিলেন। কিছু ঋগ্বেদের মধ্যে এমন কিছু সুক্তের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে যেগুলি থেকে ঋষিদের বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারনাও পরিচয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রথম মণ্ডলের চুরাশি সুক্তের পঞ্চদশ মন্ত্রের অনুবাদ এইঃ ‘এরূপে আদিত্য রশ্মি এ গমনশীল চন্দ্রমণ্ডলের অন্তর্গত ত্বষ্টৃতেজ পেয়েছিল।’ এখানে ত্বষ্টৃতেজ অর্থে সুর্যালোক। অর্থাৎ সুর্যের আলোক চন্দ্রে প্রতিফলিত হলে যে চন্দ্র আলোকিত হয় এ তথ্য ঋগ্বেদের ঋষিদের অজানা ছিল না।

    সৌর বছর ও চান্দ্র বছরের মধ্যে পার্থক্য সূচক এই ঋক্ টির (১।২৫।৮) অনুবাদ দেখুনঃ 'যিনি ধৃতব্রত হয়ে স্ব স্ব ফলোৎপাদী দ্বাদশ মাস জানেন এবং যে ত্রয়োদশ মাস উৎপন্ন হয় তাও জানেন।' সৌরবৎসর ৩৬৫ দিনে এবং চান্দ্রবৎসর ৩৫৫ দিনে হয় অর্থাৎ প্রতি বছরে চান্দ্র অপেক্ষা সৌর বছর ১০ দিন বেশী। সুতরাং প্রতি তিন বছরে চান্দ্র বছর ৩০ দিন বা ১ মাস বেশী হয়ে পড়ে অর্থাৎ ১২ মাসের বদলে ১৩ মাস হয়। এই ত্রয়োদশ মাসটিকে মলিম্লুচ বা মালমাস বলে। সুতরাং এ ঋক থেকে বোঝা যায়, বৈদিক যুগের ঋষিগণ সৌরবছর ও চান্দ্রবছরের পার্থক্য জানতেন, কেবল তাই নয় প্রতি তিন বছরে উৎপন্ন ত্রয়োদশ মাসটিকে মালমাস ধরে কেমন করে উভয় বছরের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করেতে হয় তাও তাঁরা জানতেন। জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে তাঁরা গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। ১।১৬৪।১২ ঋক্ থেকে সূর্যের সপ্তরশ্মি এবং উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ণের উল্লেখ পাই। ছয় ঋতু, দ্বাদশ মাস, এমন কি ভূলোকের দুই অর্ধের পরিচয়ও এ ঋকে সুন্দররূপে ধরা পড়েছে।

    আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁদের জ্ঞান বিশেষ রূপে লক্ষ্য করার মত। 'খেলের স্ত্রী বিশ্ পলার একটি পা, পক্ষীর একটি পাখার ন্যায় যুদ্ধে ছিন্ন হয়েছিল; হে অশ্বিদ্বয়! তোমার রাত্রি যোগে সদ্যই বিশ্ পলাকে গমনের জন্য এবং শ্ত্রু ন্যস্ত ধন লাভার্থে জঙ্ঘা পরিয়ে দিয়েছিলে' (১।১১৬।১৫)। এ ঋকে প্রাচীন হিন্দুগণের শল্য চিকিৎসায় পারদর্শিতার পরিচয় পাই। অঙ্গহীনকে অঙ্গযুক্ত করার পদ্ধতি তাঁরা জানতেন। সে যুগেও কর্তিত পায়ের স্থলে লৌহময় পদের সৃষ্টি ও সংযুক্তিকরণ সম্ভব হয়েছিল।

    একজন জ্ঞানী ব্যক্তি ইংরেজদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন এই বলে যে, তারা নাকি বেদ চুরি করে নিয়ে তার থেকেই উড়োজাহাজ, কামান, বন্দুক ইত্যাদি তৈরী করতে শিখেছে। কথাটা এক অর্থে সত্য। পাশ্চাত্য দেশসমূহে বেদের চর্চা যে পরিমাণ হয়েছে আমাদের দেশে তার এক-দশমাংশও হয়নি। সুতরাং বেদকে তারা সত্যই চুরি করেছে। ঋগ্বেদের পাঠ সমাপ্ত করে দেখতে পাচ্ছি কামান বন্দুকের উল্লেখ হয়তো নেই, কিন্তু 'মনের অপেক্ষাও বেগবান রথ' কি? ১।১১৭।২, ১।১৬৪।১২ ঋক ছাড়াও অন্ততঃ আরো চার জায়গায় 'মনের অপেক্ষাও বেগবান রথের' উল্লেখ আছে। আধুনিক রকেটের চিন্তা-ভাবনা কি এর থেকেই এসেছে?

    আয়ূঃ অনেকের ধারণা বৈদিক যুগের মানুষের পরমায়ূ ছিল সুদীর্ঘ; এমন কি সহস্র বছরের কল্পনাও তাঁরা করে থাকেন। কিন্তু ঋগ্বেদের বহু স্থলেই দেক্তে পাচ্ছি ঋষিদের পরমায়ূ কম-বেশী একশো বছরের মধ্যেই সিমাবদ্ধ ছিল। অগ্নিদেবকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছেঃ 'আমি তোমাকে শত হেমন্ত প্রজ্জ্বলিত করছি' (৬।৪৮।৮)। অর্থাৎ মানুষের আয়ূ একশ বছর। তৃতীয় মণ্ডলের ছত্রিশ সূক্তের দশম ঋকের আনুবাদটি লক্ষ্য করুনঃ 'হে মঘবন! হে ঋষীজী সোমবিশিষ্ঠ ইন্দ্র! তুমি সকলের বরনীয় প্রভূত ধন দান কর। আমাদের জীবনের জন্য শত বৎসর প্রদান কর।' ঋগ্বেদের বহুস্থলেই মানুষের জীবৎকাল এক শো বছর বলেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। পৌরাণিক কাহিনীতে আমরা ঋষিদের যে সহস্র বছরের উল্লেখ দেখি সেগুলির কোন বাস্তব সমর্থন নেই, এগুলি নিতান্তই গল্পকথা ও কল্পনা মাত্র।

    ধনবন্টনঃ আধুনিক সমাজবাদের প্রসিদ্ধ ধনবৈষম্য ও তার সমতাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। ঋগ্বেদের অন্ততঃ একটি ঋকে ধনবন্টনের সমতার প্রতি আকুতি লক্ষ্য করা গেছে। সে ঋকে ইন্দ্রের নিকট ঋষির প্রার্থনাঃ 'হে ইন্দ্র! আমাদের ধন বিভাগ করে দাও। কারণ তোমার অসংখ্য ধন, যাতে আমি তার একাংশ প্রাপ্ত হতে পারি' (১।৮১।৬)। একটি মাত্র ঋকের ঊদ্ধৃতি দিয়ে নিশ্চয়ই আমরা এ কথা বলতে চাইছি যে সে যুগে সমাজবাদ প্রতিষ্ঠিত ছিল, কিন্তু এই এক-একটি দূর্লভ ঋকে সে সংকল্পই উচ্চারিত হয়েছে।

    ধাঁধা বা লোক-সাহিত্যঃ একটি ধাঁধা আছেঃ 'আকাশ গুম গুম পাথর ঘাটা। সাতশো দালে দুটি পাতা।' এর অর্থ 'আকাশ যেন একটি গাছ, তার অনেক ডালপালা; কিন্তু পাতা মাত্র দুটি - চাঁদ আর সুর্য'। বেদের বহু ঋকে অল্প কথায় এ ধরনের গূঢ়ার্থ ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন এ ঋকটি লক্ষ্য করুনঃ 'আমরা শূর ইন্দ্রের সুন্দর অশ্বসমূহের কথা বলছি। তারা ছটি অথবা পাঁচটি করে যোজিত হয়ে তাঁকে বহন করে' (৩।৫৫।১৭)। এখানে ইন্দ্র যেন মহাকাল, ছটি করে অশ্ব যেন ছয় ঋতু। ছটি ঋতুর আবর্তনে মহাকাল এগিয়ে চলেছে। কিন্তু আমাদের দেশে ছটি ঋতুর পার্থক্য খুব স্পষ্ট নয়। হেমন্ত এবং শীত ঋতুকে একত্রে ধরলে ঋতুর সংখ্যা দাঁড়ায় পাচঁ তখন ইন্দ্ররূপ মহাকালকে পাচঁটি অশ্ব (পাচঁ ঋতু) বহন করে নিয়ে চলে। ১।১৬৪।২০ ঋক্ টিও এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়ঃ 'দুটি পক্ষী বন্ধুভাবে এক বৃক্ষে বাস করে তাদের মধ্যে একটি স্বাদু পিপ্পল ভক্ষণ করে, অন্যটি ভক্ষণ করে না - কেবলমাত্র অবলোকন করে।' এখানে জীবাত্মা এবং পরমাত্মাকে দুই পাখী বলা হয়েছে। জীবাত্মা তার কর্মফল ভগ করে, পরমাত্মা করে বা - কেবলমাত্র অবলোকন করে। আর একটি ঋকের অনুবাদ দেখুনঃ 'ইন্দ্র, পূষা এবং অভীষ্টবর্ষী কল্যাণপাণি মিত্রাবরুণ প্রীত হয়ে সম্প্রতি অন্তরিক্ষশায়ী মেঘকে অন্তরিক্ষ হতেই দহন করছেন' (৩।৫৭।২)। বেদের বহুস্থলেই এ ধরণের গূঢ়ার্থবাহী ইঙ্গিতময় ভাষা লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীকালে সাহিত্য যে লৌকিক গাথা ও ধাঁধার ঊদ্ভব হয়েছে - আমার মনে হয়, বেদের এই ধরনের শ্লোকগুলিই তার সূ্তিকাগার।

    সামাজিক পরিবেশঃ ঋগ্বেদের অসংখ্য ঋকে তৎকালীন সমাজের সুন্দর চিত্র ফুটে উঠেছে। সমাজের ক্রমবিবর্তন ও ধারাবাহিকতার রূপটি, সবিষ্ময়ে লক্ষ্য করার মত। তৎকালীন সামাজিক পরিবেশ, আচার-অনুষ্ঠান প্রভৃতির যে চিত্র ঋগ্বেদে পাই তা দুর্লভ ঐতিহাসিক দলিলের সামিল। আমরা এখানে তার সামান্য কিছু উপলব্ধি করছি।

    জাতিভেদ প্রথাঃ যে ঘৃণ্য জাতিভেদ প্রথার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে আজ ভারতবর্ষ আকুল, ঋগ্বেদের আমলে কিন্তু সে জাতিভেদ প্রথার সৃষ্টি হয়নি। তখন জাতি বলতে মাত্র দুটি শ্রেণী বুঝাত - আর্য ও অনার্য (বা দস্যু)। পরবর্তীকালের শূদ্রদের মত অনার্য জাতির লোকেরা সর্বত্র অসহায় অথবা ঘৃণার্হ ছিল না বরং অনেক ক্ষেত্রে আর্য জাতির লোকেরা তাদের ভয় করে চলত। ইন্দ্রের নিকট আর্যবর্ণের করুণ প্রার্থনা ছিলঃ 'হে মঘবন! নীচ বংশীয়দের ধন আমাদের প্রদান কর' (৩।৫৩।১৪)। এ ঋকের কাতরতা থেকে বুঝা যায় আর্যবর্ণের লোকেরা অনার্য বা দস্যুদের যথেষ্ট সমীহ করে চলত। এ প্রসঙ্গে ৩।৩৪।৯, ৩।৫৩।২১-২২ প্রভৃতি ঋকগুলি পাঠ করা যেতে পারে। ঋগ্বেদের কোথাও 'ক্ষত্রিয়' শব্দটি বলবান অর্থে ব্যবহৃত।

    গো-ধনঃ বৈদিক যুগে মানুষের কাছে 'গো-ধন' ছিল সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ধন-সম্পদ। দুগ্ধবতি গাভী ছিল তখন সকলের প্রার্থিতঃ হে 'পূষা! আমাদের গোধন যেন নষ্ট না হয়।' সেকালে চারণ-ভূমিতে ব্যাঘ্রে্র উৎপাত ছিল - সুতরাং দেবতার কাছে ঋষির আরো প্রার্থনাঃ 'এ (গোধন) যেন বাঘ্রাদি দ্বারা নিহত না হয়। কুপপাত দ্বারা যেন বিনষ্ট না হয়' (৬।৫৪।৭) বৈদিক যুগে বনভূমির প্রাচুর্য ছিল - সুতরাং বাঘ্রাদিসহ অন্যান্য হিংস্র জন্তুর আক্রমণ ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। এদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য মানুষকে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হত। কেবল বাঘ্রাদি দ্বারা নিহত হওয়াই নয়, গৃহ অথবা চারণভূমি হতে গাভী বা তার বৎস হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাও মানুষের মনে যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনার উদ্রেক করত। নিবিড় বন-জঙ্গলের মধ্যে গাভীসকল পথ ভুল করে বিপথে গিয়ে পড়ত। সুতরাং দেবতাদের কাছে ঋষিগণ প্রার্থনায় ঊদ্বেলিত হয়ে ওঠেনঃ 'আমাদের গৃহ হতে দুগ্ধবতী গাভীসমূহ যেন বৎস হতে পৃথক হয়ে কোন অগম্য স্থানে না যায়' (১।১২০।৮)। পূষা অর্থে সূর্য। গোরক্ষকগণ সুর্যকে যে প্রকৃতিতে অবলোকন করতেন, সে প্রকৃতির সূর্যই পূষা। এ পূষাই গোধন রক্ষা করেন, হারিয়ে যাওয়া পশুকে ফিরিয়ে দেন, নষ্ট পশু উদ্ধার করেনঃ 'পূষা যেন নিজে দক্ষিণ হস্তদ্বারা আমাদের গোধনকে বিপথ গমন হতে নিবারণ করেন। তিনি যেন আমাদের নষ্ট গোধনকে পূনরায় ফিরিয়ে দেন' (৬।৫৪।১০)। সুতরাং এই শক্তিমান পূষাকে কেবল বাঘ্রাদির হাত থেকে পশুকে রক্ষার নিমিত্ত নয়, নষ্ট পশু পুনরুদ্ধারের জন্যও নয় - এ দেবতাকে একান্ত আপন করে পাওয়ার জন্য ঋষির আকুতিঃ 'অতএব তুমি অহিংসিত সেই ধেনুগণের সাথে সায়ংকালে (আমাদের গৃহে) আগমন কর' (৬।৫৪।৭)। গরু-মহিষ ইত্যাদির পরই আর যে চতুষ্পদ জন্তুটি সমাজে সকলের শ্রদ্ধার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল সেটি হল অশ্ব। বাহনরূপে, যুদ্ধক্ষেত্রে, এমন কি কৃষিকার্যেও অশ্বের ব্যবহার ছিল উল্লেখযোগ্য। তাই গোধনের সঙ্গে অশ্বধন রক্ষার নিমিত্ত ঋষি দেবতাদের কাছে অনুনয় করেছেনঃ 'তিনি যেন আমাদের অশ্বগনকে রক্ষা করেন' (৬।৫৪।৫)। ঋগ্বেদের প্রায় অতি মন্ডলেই বিভিন্ন সূক্তের অসংখ্য মন্ত্রের বার বার দুগ্ধবতী গাভী এবং বলবান অশ্বের জন্য সোমাভিষেকের সাথে আন্তরিক প্রাথর্না উচ্চারিত হয়েছে।

    ব্যবসাঃ প্রথম মন্ডলের বিয়াল্লিশ সূক্তের ঋকগুলি পাঠ করলে বোঝা যায় সেকালে আর্য হিন্দুদের মধ্যে কেউ কেউ গো ও মেষপালক ব্যবসায়ে নিযুক্ত ছিল। এরা অনেক নময় সুন্দর সবুজ প্রাচুর্যময় তৃণভূমির সন্ধানে বনান্তরে গমন করত : 'শোভনীয় তৃণযুক্ত দেশে আমাদের নিয়ে যাও, পথে যেন নতুন সন্তাপ না হয়' (১।৪২।৮)। এই ভ্রমণ ছিল বিপদসঙ্কুল। পথে নানান বাধা, দস্যু-তস্করের লাঞ্ছনাঃ 'হে পূষা! আঘাতকারী, অপহরণকারী ও দুষ্টাচারী যে কেউ আমাদের (বিপরীত পথ) দেখিয়ে দেয়, তাকে পথ হতে দূর করে দাও' (১।৪২।২)। এ ঋক থেকে বোঝা যাচ্ছে সেকালে সমাজে দস্যু-তস্করের যথেষ্ট প্রাদুর্ভাব ছিল। অনেক সময় দস্যুরা ভদ্রবেশে পথিককে বিপথের অগম্য স্থানে নিয়ে গিয়ে সর্বস্ব লুন্ঠন করত। তাই পূষার কাছে ঋষির আত্মরক্ষার্থে প্রার্থনাঃ 'সেই মার্গ প্রতিবন্ধক, তস্কর কুটিলচারীকে পথ হতে দূরে তাড়িয়ে দাও' (১।৪২।২)। 'বিঘ্নকারী শত্রুদের অতিক্রম করে আমাদের নিয়ে যাও, সুখগম্য শোভনীয় পথদ্বারা আমাদের নিয়ে যাও' (১।৪২।৭)। এ সকল সূক্ত হতে দেশ-ভ্রমণে যে কত রকম বাধা-বিঘ্ন ছিল তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি এবং এ সঙ্গে এও অনুভব করতে পারি ঋষিদের তপোবন একেবারে নিরবচ্ছিন্ন শান্তির আলয় ছিল না।

    সমুদ্র-যাত্রাঃ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সমুদ্র যাত্রার কথাও ঋগ্বেদে উচ্চকন্ঠে ঘোষিত হয়েছে। নীচের অনুবাদ গুলির প্রতি লক্ষ্য করুনঃ 'যখন আমি ও বরুণ উভয়ে নৌকায় আরোহণ করেছিলাম, সমুদ্রের মধ্যে নৌকা সুন্দররূপে প্রেরণ করেছিলাম' (৭।৮৮।৩) এবং 'যেমন ধনলাভেচ্ছু ব্যক্তিরা সমুদ্র মধ্যে গমনের জন্য সমুদ্রকে স্তুতি করে' (৪।৫৫।৬)। সমুদ্রের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রচলন না থাকলেও কয়েক হাজার বছর আগেও যে এ প্রথার কিছু প্রমাণ পাচ্ছি এতা কম কথা নয়।

    কৃষিকাজঃ কৃষিকার্য্যে নিযুক্ত হয়ে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করতেন এ প্রমাণ ঋগ্বেদে অনেক স্থলেই ছড়িয়ে আছে এবং সে কৃষিকার্য্য পদ্ধতি যথেষ্ট উন্নতমানের ছিল। চতুর্থ মন্ডলের সাতান্ন সূক্তের আটটি মন্ত্রই কৃষিকার্য্যকে উপলক্ষ করে রচিত। বলদ দিয়ে যে লাঙ্গল তানা হত তার প্রমাণ পাই চতুর্থ ঋকেঃ 'বলীবর্দসমূহ সুখে বহন করুক, মনুষ্যগণ সুখে কার্য করুক, লাঙ্গল সুখে কর্ষণ করুক।' 'লাঙ্গলের আগায় ফাল লাগানোর পদ্ধতিও তখন অজানা ছিল না। অষ্টক ঋকের অনুবাদটি লক্ষ্য করুনঃ 'ফাল সকিল সুখে ভূমি কর্ষণ করুক, রক্ষকগণ সুখে বলীবর্দের সাথে গমন করুক।' সুতরাং সে যুকের ঋষিগণ বনের ফলমূল খেয়ে উদরপূর্তি করতেন - আমাদের অনেকের মধ্যে যে এরূপ কাল্পনিক ধারণা আছে তা অনেকাংশে ভ্রান্ত। সে যুগের ফসলোৎপাদন পদ্ধতি যে যথেষ্ট উন্নতমানের ছিল তা এ সকল ঋক থেকে অভ্রান্তভাবে প্রমাণিত হয়।

    পাশা খেলাঃ পাশা খেলা তখনকার দিনে সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। এই নেশায় উন্মত্ত হয়ে অনেকে তাদের ধনসম্পদ, ঘরবাড়ী হারিয়েছে; এমন কি সাধ্বী স্ত্রীদেরও পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। যে পাশা খেলে কেউ তাকে কোন কিছু ঋণ দেয় না, পিতা-মাতা, শ্বশুর-শ্বাশুড়ী সকলের তাকে ঘৃণা করে, এমন কি তার পক্ষে নিজ গৃহে রাত্রিযাপনও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। দশম মন্ডলের সমগ্র চৌত্রিশ সূক্তটি পাশা খেলা ও তার ভয়াবহ ফলশ্রুতির বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। এখানে তার প্রয়োজনীয় অংশ তুলে দেওয়া হলঃ 'আমার এ রূপবতী পত্নী কখনো আমার প্রতি বিরাগ প্রদর্শন করেনি ... কিন্তু কেবলমাত্র পাশার অনুরোধে আমি সে পরম অনুরাগিনী ভার্যাকে ত্যাগ করলাম' (১০।৩৪।১)। যে ব্যক্তি পাশা ক্রীড়া করে তার শ্বশ্রু তার উপর বিরক্ত, স্ত্রী তাকে ত্যাগ করে, যদি কারো কাছে কিছু যাঙ্ঞা করে, দেবার লোক কেউ নেই। যেরূপ বৃদ্ধ ঘোটককে কেউ মূল্য দিয়ে ক্রয় করে না, সেরূপ দ্যুতকার কারও নিকট সমাদর পায় না' (১০।৩৪।৩)। 'পাশার আকর্ষণ বিষম কঠিন, যদি কারও ধনের প্রতি পাশার লোভদৃষ্টি পতিত হয়, তাহলে তার পত্নীকে স্পর্শ করে। তার পিতামাতা, ভ্রাতাগণ তাকে দেখে বলে আমরা একে চিনি না, একে বেঁধে নিয়ে যাও' (১০।৩৪।৪)। পাশার এই ভয়াবহ পরিণতির কথা জেনে ও স্বচক্ষে দেখেও মানুষ পাশার লোভ সংবরণ করতে পারে না। প্রথম প্রথম সে পাশার সঙ্গীদের পাশ কাটিয়ে চলার চেষ্টা করে কিন্তু ছকের ওপর পাশার পিঙ্গল গুটিগুলিকে বসে থাকতে দেখে তার সব সংকল্প ভেসে যায়। ফলে 'ভ্রষ্টা নারী যেরূপ উপপতির নিকট গমন করে, আমিও তদ্রুপ খেলার সঙ্গীদের ভবনে গমন করি' (১০।৩৪।৫)। সুতরাং তার 'স্ত্রী দীনহীন বেশে পরিতাপ করে, পুত্র কোথায় বেড়াচ্ছে ভেবে তার মা ব্যাকুল। যে তাকে ধার দেয়, সে আপন ধন ফিরে পাবে কি না এ ভেবে সশঙ্কিত। দ্যুতকারকে পরের বাড়ীতে রাত্রিযাপন করতে হয়' (১০।৩৪।১০)। কেবল তাই নয় 'আপন স্ত্রীর দশা দেখে দ্যুতকারের হৃদয় বিদীর্ণ হয়, অন্যান্য ব্যক্তির স্ত্রী সৌভাগ্য ও সুন্দর অট্টালিকা দেখে তার পরিতাপ হয়। সে হয়তো প্রাতে শ্রীঘোটক যোজনাপূর্বক গতিবিধি করেছে, কিন্তু সন্ধ্যার সময় নীচলোকের ন্যায় তাকে শীত নিবারণের জন্য অগ্নি সেবা করতে হয়' (১০।৩৪।১১)। অর্থাৎ 'সকালবেলা আমীর রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা।' তাই কবষ ঋষি সকল পাশা খেলোয়াড়দের প্রতি উপদেশ দিচ্ছেনঃ কখনও পাশা খেল না, বরং কৃষিকাজ কর। তাতে যা লাভ হয় সে লাভে সন্তুষ্ট হও ও আপনাকে কৃতার্থবোধ কর। তাতে অনেক গাভী পাবে, পত্নী পাবে (১০।৩৪।১৩)।

    সেকালের সমাজ-ব্যবস্থার আরো কিছু কিছু দিকের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। তৃতীয় মন্ডলের একত্রিশ সূক্তের প্রথম দুটি ঋকের অনুবাদ এইঃ পুত্রহীন পিতা সমর্থ জামাতাকে সম্মানিত করে শাস্ত্রানুশাসনক্রমে দুহিতা জাত পৌত্র প্রাপ্ত হন। অপুত্র দুহিতার গর্ভ হতে বিশ্বাস করে প্রসন্ন মনে শরীর ধারণ করেন। ঔরসপুত্র দুহিতাকে পৈত্রিক ধন দেন না। তিনি তাকে ভর্তার প্রণয়ের আধার করেন। যদি পিতামাতা পুত্র ও কন্যা উভয়ই উৎপাদন করেন তা হলে তাদের মধ্যে একজন উৎকৃষ্ট ক্রিয়াকর্ম করেন এবং অন্যজন সম্মানিত হন।' এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি হতে বোঝা যাচ্ছে বৈদিক যুগে অপুত্রক পিতা তাঁর কন্যার বিবাহের সময় জামাতার সঙ্গে এরূপ চুক্তি করতেন যে, ঐ কন্যার ঔরসজাত পুত্র কন্যার পিতা হবে এবং দৌহিত্র হয়েও পৌত্রের কার্য করবে। দ্বিতীয় ঋকে দেখতে পাচ্ছি পুত্র কন্যা উভয়ই থাকলে পুত্র পিতার সম্পত্তির অধিকারী হবে, কন্যা সম্পত্তি পাবে না। পুত্র হবে পারলৌকিক ক্রিয়ার অধিকারী, কন্যা হবে সম্মানিতা।

    দত্তক পুত্রঃ সমাজে দত্তক পুত্র গ্রহণেরও প্রচলন ছিল। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই দত্তক পুত্র বড় হয়ে আপন পিতামাতার আশ্রয়ে চলে যেত। ফলে এই প্রথা খুব একটা সুখকর ছিল না। ঋষিদেরও প্রার্থনা ছিলঃ 'অপত্য যেন অন্য জাত না হয়' (৭।৪।৭)। পরের ঋকে বিষয়টি আরও পরিস্কার হয়ে উঠেছেঃ 'অন্যজাত পুত্র সুখকর হলেও তাকে পুত্র বলে গ্রহণ করতে অথবা মনে করতে পারা যায় না। আর সে পুনরায় আপন স্থানে গমন করে' (৭।৪।৮)। কয়েক হাজার বছর পরেও আমাদের বর্তমান সমাজে দত্তক পুত্র-কন্যা গ্রহণের রীতি ও তার ফলাফল বোধ বৈদিক যুগ থেকে বেশী কিছু উন্নতমানের হয়ে ওঠেনি।

    যক্ষ্মা রোগঃ যক্ষ্মা রোগের প্রাদুর্ভাব বর্তমান সমাজে বিশেষরূপে লক্ষণীয়। ১।১২২।৯ ঋক্ থেকে সেকালেও যক্ষ্মা রোগের অস্তিস্ত্বের কথা জানতে পারছিঃ 'যে তোমাদের জন্য সোমরসের অভিষব করে না, সে আপন হৃদয়ে যক্ষ্মা রোগ নিধান করে।'

    অশ্ব-মহিষ-গো-মাংসঃ তৎকালীন সমাজে প্রচলিত আরো কিছু বিশেষ দিকের প্রতি লক্ষ্য দেওয়া যেতে পারে। খাদ্য হিসেবে তখন গো, মহিষ এবং অশ্বের মাংস অত্যন্ত প্রিয় ছিল। অশ্বের মাংস সম্পর্কে এখানে মাত্র দুটি ঋকের উল্লেখ করা হলোঃ 'হে অশ্ব! অগ্নিতে পাক করার সময়, তোমার গা দিয়ে যে রস বার হয় এবং যে অংশ শূলে আবদ্ধ থাকে তা যেন ভূমিতে পড়ে না থাকে এবং তৃণের সাথে মিশ্রিত না হয়। দেবতারা লালায়িত হয়েছেন, সমস্ত তাঁদের দেওয়া হোক' (১।১৬২।১১)। 'যে কাষ্ঠদন্ড মাংস পাক পরীক্ষার্থে ভান্ডে দেওয়া হয়, যে সকল পাত্রে ঝোল রক্ষিত হয়, যে সকল আচ্ছাদন দ্বারা উষ্ণতা রক্ষিত হয় ... এরা সকলেই অশ্বের মাংস প্রস্তুত করছে' (১।১৬২।১৩)। শেষ উদ্ধৃতি হতে বুঝা যায় অশ্বের মাংস অত্যন্ত রসাল করে ঝোলসহ পরিপাক করা হতো এবং সে মাংসের জন্যে দেবতাগণও যে লালায়িত হয়ে উঠতেন তার পরিচয় ছড়িয়ে রয়েছে প্রথম উদ্ধৃতিতে। কেবল দেবতারা নন, জনসাধারণও সে মাংসের এতটুকু পাওয়ার জন্যে যে কেমন করে চারিদিকে ভীড় করে থাকত এবং রান্নার সুঘ্রাণ আস্বাদন করত তার কৌতুকবহ বর্ণনা পাওয়া যায় ১।১৬২।১২ ঋকেঃ যারা চারদিক হতে অশ্বের পাক দর্শন করে, যারা বলে তার গন্ধ মনোরম হয়েছে - এখন নামাও, এবং যারা মাংস ভিক্ষার জন্য অপেক্ষা করে, তাদের সংকল্প আমাদের সংকল্প হোক।'

    ইন্দ্রের জন্য শত মহিষ পাকের উল্লেখ পাওয়া যায় ৬।১৭।১১ ঋকেঃ 'তোমার জন্য পূষা ও বিষ্ণু শত মহিষ পাক করুন।' বৃষ, গাভী এবং গো-বৎসের প্রতি দেবতা, ঋষি এবং সাধারণ জনসমাজের আসক্তির কথা ঋগ্বেদের নানা সূক্তের নানা মন্ত্রে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এখানে সামান্য কয়েকটি ঋকের উল্লেখ করা হলঃ ১০।৮৯।১৪ ঋকে গাভীদের হত্যা করার উল্লেখ পাওয়া যায়ঃ গোহত্যা স্থানে গাভীগণ হত হয়।' ১০।৮৬।১৩ ঋকে পাওয়া যায় বৃষ ভক্ষণের ইতিকথাঃ 'তোমার বৃষদিগকে ইন্দ্র ভক্ষণ করুণ, তোমার প্রতি অতি চমৎকার, অতি সুখকর হোমদ্রব্য তিনি ভক্ষণ করুণ।' একটি অথবা দুটি নয় - একসঙ্গে পনের অথবা বিশটি বৃষ হত্যা ও পাক করে ভক্ষণের চাঞ্চল্যকর রাজসিক তথ্য পাওয়া যায় ১০।৮৬।১৪ ঋকেঃ 'আমার জন্য পঞ্চদশ এমন কি বিংশ বৃষ পাক করে দেয়, আমি খেয়ে শরীরের সুস্থতা সম্পাদন করি, আমার উদরের দু-পার্শ্ব পূর্ণ হয়।'

    স্ত্রীজাতিঃ সমাজে স্ত্রীজাতির বিশেষ সম্মানের আসন ছিল। স্ত্রীলোক পুরুষের সঙ্গে একত্রে বসে যজ্ঞে অংশ গ্রহণ করতেন। 'হে ইন্দ্র! তোমার সেবক এবং পাপদ্বেষী যজমান দম্পতী তোমার তৃপ্তির অভিলাষে অধিক পরিমাণ হব্যদান করে তোমার উদ্দেশ্যে বহু সংখ্যক গধন লাভের জন্য যজ্ঞ বিস্তার করছে' (১।১৩১।৩)। 'পরিণীত দম্পতি একত্রে তোমাকে প্রচুর হব্যদান করছে' (৫।৪৩।১৫)। কেবল একত্রে যজ্ঞ করবার অধিকার নয়, স্ত্রীগণও যে ঋষির সমপর্যায়ে এসে বেদের মন্ত্র সঙ্কলন ও রচনার অধিকারিণী ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় পঞ্চম মন্ডলের আটাশ সূক্তে, এ সূক্তের রচয়িতা বিশ্ববারা নাম্নী রমণী। এ সঙ্গে অত্রির দুহিতা অপালা (৮।৯১।১), কক্ষীবানের দুহিতা ঘোষা(১।১১৭।৭ ও ১০।৪০।১) এবং ইন্দ্রের পত্নী ইন্দ্রাণীর (১০।১৪৫।১-৬) নাম স্মরণযোগ্য। কয়েক হাজার বছর পূর্বে স্ত্রীজাতির এ সম্মানীয় অধিকার আমাদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে। বর্তমানকালের মত অবিবাহিতা কন্যার সংখ্যাও সেকালে কম ছিল না। অনেক কুমারী কন্যাই আজীবন পিতামাতার কাছে থেকে গেছেঃ 'হে ইন্দ্র! যাবজ্জীবন পিতামাতার সঙ্গে অবস্থিতা কন্যা যেমন আপনার পিতৃকূল হতে ভাগ প্রার্থনা করে, সেরূপ আমি তোমার নিকট ধন যাঙঞা করি' (২।১৭।৭)। এ ঋক হতে প্রতীয়মান হয় কুমারী কন্যারা কেবল পিতৃগৃহে থাকত না, পিতার সম্পত্তিতেও তার অধিকার ছিল। যে প্রথা আজ আইন করে আমরা বর্তমান হিন্দু সমাজে সদ্য চালু করেছি - কয়েক হাজার বছর পূর্বেই সমাজে তার প্রচলনের অস্তিত্বর প্রমাণ পাওয়া যায়। এর ফলে অবিবাহিতা কন্যাকে যে অপরের গলগ্রহ হয়ে লাঞ্ছনা ভোগ করতে হতো না তা বুঝতে কোন অসুবিধা নেই। বিবাহের সময় বর্তমানকালের মত আগেও যে কন্যাকে বসনভূষণে অলংকৃত করে জামাতার হাতে সমর্পণ করা হতো তার উল্লেখ পাওয়া যায় ১০।৩৯।১৪ ঋকেঃ 'যেরূপ জামাতাকে কন্যা দেবার সময় তাকে বসন-ভুষণে অলংকৃত করে সম্প্রদান করে।' এখানেও কন্যাদের যথেষ্ট সম্মান লক্ষ্য করা যায়। কিছুকাল পূর্বেও আমাদের সমাজে বিধবাদের লাঞ্ছনা ও পদে পদে অবমাননার শেষ ছিল না। বর্তমানে আইন করে পুনর্বিবাহের প্রচলন করলেও বিধবাদের অস্বস্তিকর অবস্থার কিছুমাত্র উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয় না। কিন্তু বৈদিক যুগে বিধবাদের হয়তো এতখানি লাঞ্ছনা ভোগ করতে হতো না। দেবরের সাথে তাদের পুনর্বিবাহের উল্লেখ লক্ষ্য করা যায় ১০।৪০।২ ঋকেঃ 'যেরূপ বিধবা রমণী শয়নকালে দেবরকে সমাদর করে।' সুতরাং দেবর যে দ্বিতীয় বর এরূপ প্রথা বৈদিক যুগের পূর্ব হতেই সমাজে প্রচলিত ছিল।

    বহুবিবাহঃ সমাজে বহুবিবাহের প্রচলন সে যুগে বিশেষরূপে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। বহুবিবাহের কুফল সপত্নী বিরোধের যে চিত্র ঋগ্বেদে পাওয়া যায় তা একই সঙ্গে রীতিমত কৌতুককর ও ভয়াবহ। সতীনকে এড়িয়ে স্বামী বশ করার জন্যে স্ত্রীর আকুলতা বহু ঋকে সুন্দররূপে ফুটে উঠেছে। কেবল নিজেকে 'স্বামীর নিকট আদরণীয়' (১০।১৫৯।৩) করে তুলেই স্ত্রী ক্ষান্ত হয়নি - স্বগর্ভজাত কন্যাকে সতীন-কন্যা অপেক্ষা স্বামীর নিকট আদরণীয় করে তুলতে তার প্রচেষ্টার অন্ত ছিল নাঃ 'আমার কন্যাই সর্বশ্রেষ্ঠ শোভায়' (১০।১৫৯।৩)। এক বনে যেমন দুটি সিংহ থাকে না এক স্বামীর তেমনি দুই স্ত্রী থাকবে না। সপত্নী পীড়নে জর্জরিত নারীর সগর্ব ও হিংস্র ঘোষণাপত্র লক্ষ্য করুণঃ 'আমার শত্রু জীবিত রাখি না, শত্রুদের আমি বধ করি, জয় করি, পরাস্ত করি। ... আমি সকল সপত্নীকে জয় করেছি, পরাস্ত করেছি' (১০।১৫৯।৫-৬)। সতীনদের পরাস্ত অরার ফল-স্বরূপ 'আমি এ বীরের (স্বামীর) উপর প্রভুত্ব করি' (১০।১৫৯।৬)। সে যুগে সপত্নীদের কত নির্মমভাবে পীড়ন করা হতো তার পূর্ণ চিত্র পাওয়ার জন্যে দশম মন্ডলের একশো পঁয়তাল্লিশ সূক্তের আরো কিছু ঋকের অনুবাদ এখানে উদ্ধৃত করা হলঃ 'এই যে তীব্র শক্তিযুক্ত লতা, এ ওষধি, এ আমি খননপূর্বক উদ্ধৃত করা হল, এ দিয়ে সপত্নীকে ক্লেশ দেওয়া যায়, এ দ্বারা স্বামীর প্রণয়লাভ করা যায়' (১); 'হে ওষধি!......তোমার তেজ অতি তীব্র, তুমি আমার সপত্নীকে দূর করে দাও' (২); 'হে ওষধি! তুমি প্রধান, আমি যেন প্রধান হই, প্রধানের উপর প্রধান হই, আমার সপত্নী যেন নীচেরও নীচ হয়ে থাকে' (৩)। সপত্নী পীড়নের পর স্বামীকে বশ করার জন্য তুক-তাকের সঙ্গে বশীকরণ মন্ত্রও উচ্চারিত হতে দেখা যায়ঃ 'হে পতি এ ক্ষমতাযুক্ত ওষধি তোমার শিরোভাগে রাখলাম। সে শক্তিযুক্ত উপাধান (বালিশ) তোমার মস্তকে দিতে দিলাম। যেমন গাভী বৎসের প্রতি ধাবিত হয়, যেমন জল নিম্নপথে ধাবিত হয়, তেমনি যেন তোমার মন আমার দিকে ধাবিত হয়' (১০।১৪৫।৬)।

    বুঝতে কোনই কষ্ট হয় না স্ত্রীজাতি স্বামীকে যমের হাতে তুলে দিতে পারে কিন্তু সতীনের হাতে নয়।

    সমাজে ব্যাভিচারিণী নারীর উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়। ৪।৫।৫ ঋকে 'ভ্রাতৃরহিতা বিপথগামিনী ঘোষিতের ন্যায়, পতি বিদ্বেষিণী দুষ্টাচারিণী ভার্যার' উল্লেখ পাওয়া যায়! 'যেরূপ কোন নারী ব্যভিচারে রত হয়' (১০।৪০।৬) অথবা 'যেরূপ ভ্রষ্টা নারী উপপতির নিকট গমন করে' (১০।৩৪।৫) প্রভৃতি ঋকে দুশ্চরিত্রা নারী প্রাদুর্ভাবের কথা সোচ্চারে ঘোষিত হয়েছে। অবিবাহিতা কন্যার পুত্র হওয়ার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে ৮।৪৬।২১ ঋকে।

    স্বার্থচেতনাঃ বেদের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থপরতার কথা এমন উলঙ্গ হয়ে প্রকাশিত হয়েছে যে সেগুলি পাঠ করার সময় দারুণ মর্মবেদনা অনুভূত হয়। স্বার্থপরতার এমন অবাধ উচ্চারণ অন্য কোন গ্রন্থে লক্ষ্য করা যায় না। ঋগ্বেদের দশ সহস্রাধিক মন্ত্রের মধ্যে আনুমানিক এক-দশমাংশে কেবলমাত্র 'আমাকে ধন দাও, গো-ধন দাও, অশ্ব দাও' ইত্যাদি উচ্চারিত হতে দেখা যায়। এ স্বার্থচেতনা নিতান্তই ব্যক্তিকেন্ত্রিক। ঋষিরা বারবার অনুদার চিত্তে দেবতাদের কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছেনঃ 'আমার শত্রুকে মেরে ফেল, ধ্বংস করে, তাদের সকল ধন আমাকে দাও, অন্য কাকেও দিও না। কেবলমাত্র আমার মঙ্গল কর।' এরপরেও অনেক ঋকে দেখা যাচ্ছে ইন্দ্রকে সোমরস পান করিয়ে, তাঁকে দিয়ে কার্যসিদ্ধির পরিকল্পনা করছেন ঋষিগণ। ঋষি ও যজমানদের এ ধরনের সংকীর্ণ মনোবৃত্তি আদৌ ভালো লাগার নয়। মনে বার বার প্রশ্ন জাগে ঋষিদের মধ্যে এ হীন মনোবৃত্তি কি করে আশ্রয় পেল? এ সঙ্কীর্ণ মনোবৃত্তি ত্যাগ করে কেন তাঁরা আরো একটু উদার হতে পারলেন না? ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির কাছে তাঁরা এমন করে অন্ধ হয়ে গেলেন কেন? কেন? কেন? শ্রদ্ধা-বিগলিত ভক্তি-প্লুত আত্মা তাঁদের কাছে যে আরো অনেক বড় জিনিস আশা করেছিল। এ প্রসঙ্গে ঋকের কোন উদ্ধৃতি দেওয়া হল না - যে কোন শ্রদ্ধাবান বেদ-পাঠক এ কথার সত্যতা উপলব্ধি করতে পারবেন।

    উদারতাঃ তাই বলে অবশ্যই একথা বলা হচ্ছে না যে, ঋগ্বেদের কোথাও উদার মনোবৃত্তির পরিচয় নেই। নিশ্চয়ই আছে এবং অনেক স্থলেই তা লক্ষ্য করা গেছে। ১।১২০।১২ ঋকটি দেখুনঃ 'যে ধনবান লোক পরকে প্রতিপালন করে না তাকে ঘৃণা করি।' হঠাৎ ঝলকে ওঠা কি অপূর্ব একটি বাক্য! দরিদ্রপালন এবং দানের প্রতি নিখিল মানব সমাজের দৃষ্টিকে কত সুন্দরভাবেই না আকৃষ্ট করা হয়েছে। পরোপকারের প্রতি উৎসাহ দান করাই এ ঋকের মূল লক্ষ্য। কৃতপাপ জয়ের জন্য ঋষির আর একটি সুন্দর মন্ত্রোচ্চারণের প্রতি আমি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিঃ 'হে দেবগণ! আমরা দিনরাত নমস্কার করে পাপ জয়ের জন্য দোহবতী ধেনুর ন্যায় তোমার নিকট উপস্থিত হচ্ছি' (১।১৮৬।৪)। আমাকে পাপমুক্ত কর, আমাকে সৎ কর - এ প্রার্থনাই ঋষির যোগ্য প্রার্থনা, এ-দৃষ্টিই ঋষির যোগ্য দৃষ্টি। ১।১৮৫ সূক্তের ৮, ৯, ১০ এবং ১১ সংখ্যক ঋকেও আমরা ঋষিদের এই পবিত্র কন্ঠ শুনতে পেয়েছি। 'আমাদের শরীর রক্ষা কর, কথায় মিষ্টতা প্রদান কর, দিবসকে সুদিন কর' (২।২১।৬)। এ প্রার্থনা মধ্যে ঋষি কন্ঠের পরিচ্ছন্নতা সকলের সশ্রদ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনার সীমা অতিক্রম করে ঋষির ধ্যান-ধারণায় যখন ব্যাপকতা লক্ষ্যিত হয় তখন আনন্দিত না হয়ে পারা যায় না। শুনতে ভাল লাগে যখন ঋষির উদাত্তকন্ঠে উচ্চারিত হয়ঃ 'ওষধিসমূহ আমাদের জন্য মধুযুক্ত হোক; দ্যুলোকসমূহ, জলসমূহ ও অন্তরীক্ষ আমাদের জন্য মধুযুক্ত হোক; ক্ষেত্রপতি আমাদের জন্য মধুযুক্ত হোন' (৪।৫৭।৩)। এখানে ব্যক্তিগত স্বার্থপরতার অপমৃত্যু ঘটেছে। এরপর ঋষিদের যাত্রা শুরু হয় পাপ হতে পূণ্যের দিকে, সংকীর্ণতা হতে উদারতার দিকে, অন্ধকার হতে আলোকের দিকে। ইন্দ্রের কাছে তাদের সানুনয় প্রার্থনাঃ 'হে ইন্দ্র! তুমি আমাদের বিস্তীর্ণলোকে এবং সুখময়, ভয়শূন্যে আলোকে নির্বিঘ্নে নিয়ে যাও' (৬।৪৭।৮)। চিন্তা-ভাবনায় এই যে উত্তরণ, এই হলো বৈদিক ধর্মের স্বক্ষেত্র এবং স্বর্ণময় উজ্জ্বল বিস্তার। মহামরণ-পারে অসীম পিয়াসী মানবাত্মার এই যে বিপুল যাত্রা - এ দেশে আমাদের সমগ্র সত্তা, সুগভীর উল্লাস-উচ্ছ্বাসে নির্বাক হয়ে যায়। ঋগ্বেদের সর্বশেষ ঋকে যে বিপুল প্রার্থনাটি উচ্চারিত হয়েছে সেটি আমাদের এক দুর্লভ প্রাপ্তি, এ ঋকে সমবেত ঋষিকন্ঠে গেয়ে উঠেছেনঃ 'তোমাদের অভিপ্রায় এক হোক, অন্তঃকরণ এক হোক, মন এক হোক, তোমরা যেন সর্বাংশে সম্পূর্ণরূপে একমত হও' (১০।১৯১।৪)। এর থেকে বড় প্রার্থনা আর কি হতে পারে? ভারতীয় জনজীবনে ঐকমত্যের আজ বড় প্রয়োজন। আসুন ঋষির কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সমগ্র বিশ্বনিয়ন্তার কাছে আমরা প্রার্থনা জানাইঃ 'জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আমাদের সকল মানুষের অভিপ্রায় এক হোক, অন্তঃকরণ এক হোক, মন এক হোক, আমরা যেন সর্বাংশে সম্পূর্ণরূপে একমত হতে পারি।'

    একেশ্বর চিন্তাঃ সুপ্রাচীন কালে সরল আর্যগণ প্রকৃতির প্রত্যেকটি বিস্ময়কর ঘটনা ও কার্যে একটি করে দেবতার অস্তিত্ব কল্পনা করে নিয়েছিলেন। এই অনুমান ও কল্পনার ফলেই বেদে অগ্নি, বায়ু, ইন্দ্র, পূষা, ত্বষ্টা, সোম, সূর্যা, ঊষা, সরস্বতী, বিষ্ণু, ইন্দ্র প্রভৃতি অসংখ্য দেবতার উদ্ভব হল। সভ্যতার ক্রমোন্নতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারের ফলে এই আর্যগণই উপলব্ধি করলেন প্রকৃতির সকল কাজ একই নিয়মে চলে। ফলে তাঁরা এ সবকিছুর মূলে একজন সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব উপলব্ধি করলেন। তাঁরা বললেনঃ এক ছাড়া দ্বিতীয় নেই। এক হতেই সব। তৃতীয় মন্ডলের পঞ্চান্ন সূক্তটিতে সকল কার্যকরণের মূলে ঐশ্বরিক বলের ঐক্যের কথা সুন্দররূপে বিবৃত হয়েছে। কয়েক সহস্র বৎসর পূর্বে চিন্তাশীল ঋষিদের মনে যে চিন্তা-ভাবনার উদয় হয়েছিল কোরআন শরীফের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে তার আশ্চর্য মিল লক্ষ্য করা যায়। এখানে তার কিছু কিছু উল্লেখ করা হলঃ ''অগ্নি'' বেদিতে বিরাজ করেন, বনে প্রজ্জ্বলিত হন, আকাশে উৎপন্ন হন, পৃথিবীতে বিকশিত হন (৪ ঋক); তিনি উত্তাপ রূপে শস্য উৎপাদন করেন (৫ ঋক); সুর্যরূপে পশ্চিমদিকে অস্ত গিয়ে পূর্বদিকে উদয় হন (৬ ঋক); [ সূর্যের উদয়কালে তাদের গুহার দক্ষিণ পার্শ্বে হেলে আছে এবং অস্তকালে তাদের বামপার্শ্ব দিয়ে অতিক্রম করছে', আল্-কোরআন (২।২২৫)। ] দিবা ও রাত্রি পরস্পরে সঙ্গত হয়ে আসছে ও যাচ্ছে (১১ ঋক); [ 'তুমি (আল্লাহ), রাতকে দিনে এবং দিনকে রাতে পরিবর্তন কর', আল্-কোরআন (৩।২৭)। ] আকাশ ও পৃথিবী পরস্পরকে বৃষ্টি ও বাষ্পরূপে রস দান করছে (১২ ঋক)! আল্লাহ আকাশ থেকে যে জল বর্ষণ করে মৃতভূমিকে জীবিত করেন (রস দান করেন) এবং সকল প্রকার প্রাণী তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন', আল্-কোরআন (২।১৬৪) ] এবং যে নৈসর্গিক নিয়মে একদিকে বজ্র হচ্ছে, সে নিয়মে অন্যদিকে বৃষ্টি হচ্ছে (১৭ ঋক); একই নির্মাণ কর্তা মনুষ্য ও পশুপক্ষীকে সৃষ্ট করেছে (১৯, ২০ ঋক); [ তিনি (আল্লাহ) শুক্র হতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন,' আল্-কোরআন (১৬।৪), 'তিনি পশু সৃষ্টি করেছেন' আল্-কোরআন (১৬।৫)। ] তিনি শস্য উৎপাদন করেন, বৃষ্টি দান করেন, ধনধান্য উৎপন্ন করেন (২২ ঋক); [ 'তিনিই (আল্লাহ) আকাশ হতে বারি বর্ষণ করেন, ওতে তোমাদের জন্য রয়েছে পানীয় এবং তা হতে জন্মায় উদ্ভিদ যাতে তোমরা পশুচারণ করে থাক। তিনি তোমাদের জন্য ওর দ্বারা শস্য জন্মান, জায়তুন, খর্জুর বৃক্ষ, দ্রাক্ষা এবং সর্ব প্রকার ফল', আল্-কোরআন (১৬।১০-১১)] প্রকৃতির অনন্ত কার্য পরস্পরাকে ভিন্ন ভিন্ন দেবের নামে স্তুতি করা হয় সে কার্য পরস্পরায় একতা দেখে" বেদের ঋষিগণ স্বীকার করে নিয়েছেন যে দেবগণের কার্যসমূহ ভিন্ন নয়, তাঁরা একই দৈব ক্ষমতার অধীন, একজন ঈশ্বরই তাঁদের পরিচালিত করছেন, তাঁদের যে দৈবক্ষমতা তা সেই পরমেশ্বরেরই দান, সকল কিছু তাঁরই অধীন, সকল কিছুই সেই অনন্ত অসীম দয়াময়ের কৃপার ফল। সুতরাং ঈশ্বর বহু নন - এক। তিনি অসীম, তিনি করুণাময়, তিনি হতেই সব কিছুর সৃষ্টি, তিনি হতেই সব কিছু লয়। তৃতীয় মন্ডলের পঞ্চান্ন সূক্তে সর্বমোট বাইশটি ঋক্ আছে। প্রতিটি ঋকের শেষে এই কথাটি আছেঃ 'মহদ্দেবানাম-সুরত্বমেকম,' অর্থাৎ 'মহৎ দেবানাং অসুরত্বং একং' যার বাংলা অর্থ 'দেবগনের মহৎ বল একই।' সায়ণাচার্য এর অর্থ করেছেন দেবানাং একং মুখ্যং অসুরত্বং ...... প্রাবল্যং মহৎ ঐশ্বর্যং।' পন্ডিত Wilson-এর অর্থ হল, 'great and unequalled is the might of the gods.' বেদের অভ্রান্ত ব্যাখ্যাদাতা মহাপন্ডিত Max Muller এর অর্থ করেছেন 'The great divinity of the gods is one.' The divinepower of the gods is unique' - বলেছেন Muir. অর্থাৎ সব কিছুর মূলে সেই সর্বশক্তিমানের লীলাখেলা বিরাজমান। ঐশ্বরিক বল এবং দেবতাদের কাজ - এ দুয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বিশ্বনিখিলের সর্বত্র যে সকল কাজ হয়ে চলেছে প্রকৃতপক্ষে তার মূলে কোন দেবতা নেই। (আর্যগণ 'দেবতা আছে' এরূপ কল্পনা করে এক একটি দেবের নাম দিয়েছিলেন মাত্র। আছেন কেবলমাত্র এক ঈশ্বর। সকল কিছুই তাঁর অধীন, তাঁর নিয়ন্ত্রণে সকল কিছুই। তিনি ছাড়া দ্বিতীয় নেই। কোরআন শরীফে একথা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে "বল, তিনি আল্লাহ - এক" (১১২।১) বলা হয়েছেঃ "আল্লাহ! তিনি ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই। তিনি চিরঞ্জীব, অনাদি। তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না। আকাশ ও পৃথিবীতে যে কিছু আছে সমস্তই তাঁর ... তাঁর আসন আকাশ ও পৃথিবীতে পরিব্যাপ্ত আর ওদের (আকাশ-পৃথিবীর) রক্ষণাবেক্ষণে তিনি ক্লান্ত হন না, তিনি অতি উচ্চ, মহামহিম" (২।২২৫)। প্রথম মন্ডলে ঋষির মনে একেশ্বর সম্পর্কে প্রশ্ন জেগেছে 'যিনি এ ছয় লোক স্তম্ভন করেছেন, যিনি জন্মরহিত রূপে নিবাস করেন তিনি কি সেই এক' (১।১৬৪।৬)? এ প্রশ্নই তৃতীয় মন্ডলের পঞ্চান্ন সূক্তে স্থিতি লাভ করেছে ঐশ্বরিক বল ও দেবতাদের কাজের সমন্বয়ের মধ্যে, বাষট্টি সূক্তে তা জগদ্বিখ্যাত গায়ত্রী 'বরেণ্যং ভর্গঃ' অর্থাৎ বরণেয় জ্যোতি, ... আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাঁর জ্যোতির দিকে পথনির্দেশ করেন," (২৪।৩৫)। সুতরাং কোরআন শরীফেও এই 'বরেণ্যং ভর্গঃ' হা বরণীয় জ্যোতির সমর্থন পাচ্ছে।] রূপে নিখিল মানব হৃদয়ে বিস্তার লাভ করেছে। দশম মন্ডলের একাশি ও বিরাশি সূক্তে ঋষির এ চিন্তাই বিশাল পটভূমিতে অনন্য সাধারণ রূপ লাভ করেছে। এ সকল সূক্তে ঈশ্বরের সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পর্কে আর কোন প্রশ্ন নেই, ঋষি একেশ্বর চিন্তায় সম্পুর্ণরূপে নিমগ্ন, এখানে তাঁর সৃষ্টিকার্য সম্পর্কে ঋষির সানুরাগ অভিব্যক্তি প্রকাশিত। মহান ঈশ্বরের বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে ঋষি বলেছেনঃ 'সেই সুধীর পিতা উত্তমরূপে দৃষ্টি করে, মনে মনে আলোচনা করে জলাকৃতি পরস্পর সম্মিলিত এ দ্যাবাপৃথিবী সৃষ্টি করলেন। যখন এর চতুঃসীমা ক্রমশঃ দূর হয়ে উঠল, তখন দ্যুলোক ও ভূলোক পৃথক হয়ে গেল' (১০।৮২।১)। অর্থাৎ পৃথিবী ও আকাশ সৃষ্টি হল। পৃথিবী সৃষ্টির প্রারম্ভে যে সবকিছু জলময় ছিল কোরআন শরীফেও তার সমর্থন পাওয়া যায়। সূরা হূদ-এর সাত সংখ্যক আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেনঃ "যখন তাঁর আরশ জলের উপর ছিল তখন তিনিই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর ছয় দিনে সৃষ্টি করেন" (১১।৭, বার পারা, এগার সংখ্যক সূরা)। এই একেশ্বর সম্পর্কে বিশ্বকর্মা ঋষি বলেনঃ 'যিনি বিশ্বকর্মা, তাঁর মন বৃহৎ, তিনি নিজে বৃহৎ তিনি নির্মাণ করেন, ধারণ করেন, তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সকল আবলোকন করেন' (১০।৮২।২)। কোরআন শরীফে দেখা যায়ঃ "আকাশ ও ভুমন্ডলের এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে তার সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা নির্মাণ করেন এবং আল্লাহ্ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান" (৫।১৭)। বিরাশি সূক্তের তৃতীয় ঋকের অনুবাদ লক্ষ্য করুনঃ "যিনি আমাদিগকে জন্মদাতা পিতা, যিনি বিধাতা, যিনি বিশ্বভূবনের সকল ধাম অবগত আছেন, যিনি একমাত্র, অন্য সকল ভূবনের লোকে তাঁর বিষয়ে জিজ্ঞাসাযুক্ত হয়' (১০।৮২।৩)। তিনিই আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তিনিই পবিত্র, তিনিই শান্তি, তিনিই নিরাপত্তা বিধায়ক, তিনিই রক্ষক, তিনিই পরাক্রমশালী, তিনি প্রবল" (৫৯।২৩)। বেদের অন্যত্র বলা হয়েছেঃ 'সে এক প্রভু, তাঁর সকল দিকে চক্ষু, সকল দিকে মুখ, সকল দিকে হস্ত, সকল দিকে পদ, ইনি দুই হস্তে ও বিবিধ পক্ষ সঞ্চালনপূর্বক নির্মাণ করেন, তাতে বৃহৎ দ্যুলোক ও ভূলোক রচনা হয়' (১০।৮১।৩)।

    সুতরাং বেদের ঈশ্বর সম্পর্কীয় চিন্তা-ভাবনাগুলি গভীর মনোনিবেশ সহকারে পাঠ করলে বোঝা যায়, বেদের ঋষিগণ একেশ্বরের চিন্তা-ভাবনায় অধিকতর উৎসাহী ছিলেন। প্রকৃতির নানান বিস্ময়কর ক্রিয়াকান্ডের মর্মমূলে মহান ঈশ্বরের অস্তিত্বই তাঁরা বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছেন। এবং বিস্মিত হওয়ার বিষয় এই যে, চার হাজার বছর আগে বৈদিক যুগের মহান ঋষিগণ যে-কথা ভেবেছেন, যে-কথা বলেছেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমুন্নত এই বিংশ শতাব্দীর ধীশক্তিসম্পন্ন পন্ডিতগণ ঠিক সেকথা নিয়েই আলোচনা করেছেন। পরাবিদ্যায় আমরা কি সামান্য একটি ধাপও অগ্রসর হতে পেরেছি?

    পরিশেষে বেদের মহাজ্ঞানী ঋষিগণের সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে পরমেশ্বরের কাছে আমাদের প্রার্থনা হোকঃ হে পরমেশ্বর, 'বরেণ্যং ভর্গঃ - বরণীয় জ্যোতিঃ পুঞ্জে আমাদের অন্তঃকরণ আলোকিত কর। হে করুণাময় ঈশ্বর, তুমি আমাদের উপর করুণা কর, আমাদের অভিপ্রায় যেন এক হয়, অন্তকরণ এক হয়, মন এক হয়, আমরা যেন সর্বাংশে সম্পূর্ণরূপে একমত হতে পারি।'
    Views: 1220 | Added by: শকুন্তলা-দেবী | Tags: hinduism, hindu as sonaton, vedic science, ved | Rating: 0.0/0
    Total comments: 1
    0  
    1 নামহীন   (13-08-2011 9:40 PM) [Entry]
    ভাল লাগলো-

    এই বেদ আর বৈদিক সমাজের ধারক আমরা- আমাদের এটা কখনোই ভুলে গেলে চলবে না

    Only registered users can add comments.
    [ Registration | Login ]