আমরা মানবজাতি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব। আদি কাল থেকে মানব সন্তানরা ক্রমাগত নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে প্রাণী কূলের শিরোমনি হিসেবে। মানুষের চেয়ে অনেক গুন শারিরিক শক্তি সম্পন্ন প্রাণীরা পদনত হয়েছে মানুষের জ্ঞানের কাছে। এমনকি প্রাচীন কালে পৃথিবীতে আধিপত্য স্থাপনকারী প্রাণী ডাইনোসর ও হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। মানুষই একমাত্র প্রাণী যাঁরা যেকোন পরিবেশে, প্রতিকূলতায় নিজেদের টিকিয়ে রাখতে সক্ষম। আর এভাবেই মানবকূল এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর সবটুকু সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের কল্যাণে। বর্তমান যুগে সর্বত্র বিজ্ঞানের জয়-জয়কার। আমাদের নিত্য-নৈমিত্তিক জীবন-যাপনে বিজ্ঞানের অবদান বিস্ময় জাগানোর মতো। বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষ মুঠোয় পুরে নিয়েছে পৃথিবীকে। মহাশূন্যে আধিপত্য বিস্তারেও পরিচালিত করছে নানান অভিযান। বর্তমান সময়ে যেকোন সমস্যার সমাধানে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই এ লেখায় সনাতন ধর্মের রীতিনীতি ও শাস্ত্রবর্ণিত বিভিন্ন বিষয়ের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যদিও এটা একটা বৃহৎ ব্যাপার। সীমিত পরিসরে ব্যাখ্যা অসম্ভব। তারপরও গুরুত্ব¡পূর্ণ কিছু বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। সন্ধ্যায় ধুপধুনো (সালফার ডাই অক্সাইড) দিলে পোঁকামাকড়, মশা, তেলাপোকা আশে-পাশে থাকে না। শঙ্খ ও উলুধ্বনি শেয়াল, বনবিড়ালসহ বন্যপ্রাণীর উৎপাত কমায়। এগুলো মোটেই কুসংষ্কার বা সেকেলে নয়। বরং কয়েল ও মরটিন থেকে সৃষ্ট ক্যানসার ও হাঁপানি থেকে বাঁচবার একমাত্র নিরাপদ উপায়। সারা বিশ্বে আজ চিকিৎসা বিজ্ঞানের এতো জয়জয়কার এর সবটুকুর সুতিকাগারই ছিল ভারতের ঋষিদের দখলে। মিশর ও আরবের লোকেরা চিকিৎসার জন্য তখন ভারতে আসতেন। ছানি অপারেশনের পিতা ডাঃ শুশ্রুত, তিনি অঙ্গ প্রতঙ্গ জোড় লাগাতে পারতেন। পরবর্তীতে অশ্বীনি ভ্রাতৃদ্বয় এই বিদ্যা আয়ত্ব করেন। এই বিদ্যা প্রয়োগ করে প্রায় দ্বিখণ্ডিত অবস্থায় জন্মানো জরাসন্ধকে জোড় লাগিয়ে বাঁচিয়ে ছিলেন এঁরাই। ইনিই সেই পরাক্রমশালী মগদরাজ জরাসন্ধ, যার কাছে রাজ্য হারাবার ভয়ে তটস্থ ছিলেন মথুরার রাজা শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরাম। সুতরাং দেখা যায় সুপ্রাচীন কালেও ছানি অপারেশন ও হাড় জোড়া লাগানো বিদ্যা মানুষের আয়ত্ত্বে ছিল। বিশাল্যকারণীর রসে লক্ষন বেঁচে উঠলেন-সেটাতো রামায়নেই বর্ণিত আছে। জড়ি বুটি, রস এবং ঋগবেদের আয়ুর্বেদ পুরোটাই চিকিৎসা সংক্রান্ত। (ভারত বিভক্ত না হলে আজ ইংরেজিতে নয়, সংস্কৃতে বিজ্ঞানের মেডিকেল সায়েন্স পড়তে হতো)। তারপরও আরবরা এদেশ থেকে যা নিয়েছিল তা বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধশালী করেছে। (ডাঃ সি এনসি বোস-সনাতন ধর্ম ও বিজ্ঞান) তৎকালীন ঋষিরা মানবদেহের কোথায় কী আছে তা ভালো করেই জানতেন। এমনকি তৎকালীন সময়ে মানবদেহের অভ্যন্তরের অনেক ছবি এঁকেছিলেন ঋষিরা। যা দেখলে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। এখন আসা যাক শাস্ত্রবাণীর সাথে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার বিভিন্ন ধারণা মিল প্রসঙ্গে। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বইটির মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং পরিণতি অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন যে, ‘‘মনে করা হয় বিস্ফোরণের সময় মহাবিশ্বের আয়তন ছিল শুণ্য, সুতরাং উত্তাপ ছিল অসীম। মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে তাপমাত্রা নেমে এসেছিল প্রায় এক হাজার কোটি ডিগ্রীতে। এ তাপ সূর্য্যরে কেন্দ্রের তাপের চেয়ে প্রায় এক হাজার গুণ বেশী’’। ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে সৃষ্টির প্রারম্ভে তাপমাত্রা ছিল ১০০০ জ্বলন্ত সূর্য্যরে তাপের সমান। আরো বলা হয়েছে, ‘‘পরমেশ্বর ভগবানের শক্তি, প্রকৃতির সাম্য, অব্যক্ত অবস্থা বিক্ষুব্ধ হওয়ার ফলে সৃষ্টির শুরু হয়’’। অর্থাৎ বিক্ষুব্ধ অবস্থা থেকে সৃষ্টির শুরু। আধুনিক বিজ্ঞান প্রায় একই কথা বলে। বিজ্ঞানীরা বলেন একটি বড় ধরনের বিষ্ফোরন থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। যাকে বিগব্যাঙ বলা হয়। ঋকবেদে বলা হয়েছে ‘যজ্ঞের সদন হতে স্ত্রোত্র প্রকৃষ্ট রুপে গমন করুক। সূর্য কিরণ সমূহ দ্বারা বৃষ্টি সৃষ্টি করিয়াছেন’। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সূর্য্যের তাপে সমুদ্র ও জলাশয়ের পানি বাষ্পীভুত হয়ে উপরে উঠে ঘনীভূত ও শীতলিভূত হয়ে মেঘে, সর্বশেষ বৃষ্টি রূপে মাটিতে নেমে আসে। সংক্ষেপে এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় পানিচক্র। পানিচক্রের এই প্রক্রিয়া ঋকবেদের উপরোক্ত শ্লোকের সাথে অনেকাংশে মিলে যায়। বিজ্ঞানীরা ভিনগ্রহের প্রাণের অস্বিত্বের অনেক প্রমাণ পেয়েছেন। পৃথিবী ছাড়া অন্যান্য গ্রহে প্রাণী রয়েছে এটা বৈজ্ঞানিক সত্য। ভাগবতে বলা হয়েছে- ‘‘নভো দদাতি শ্বসতাং পদং যন্নিয়মাদদঃ, লোকং স্বদেহং তনুতে মহান সপ্তভিরাবৃতম্’’ (ভাঃ ৩/২৯/৪৩) অর্থাৎ পরেমেশ্বর ভগবানের নিয়ন্ত্রণে আকাশ অন্তরীক্ষে বিভিন্ন গ্রহদের স্থান প্রদান করে। যেখানে অসংখ্য প্রাণী বাস করে। তাঁর পরম নিয়ন্ত্রণে সমস্থ ব্রহ্মাণ্ডের বিরাট শরীর সপ্ত-আবরণ সহ বিস্তৃত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আবরণে ধারণ হয়। ব্রহ্মসংহিতায় বলা হয়েছে- ‘‘যঃ করণার্ণবজলে ভজতি যোগনিদ্রমনস্ত জগদ গুসরোমকুপঃ, আধারশক্তিমবলম্ব্য পরাংস্বমূর্তিং গোবিন্দ আদি পুরুষংতমহং ভজামি’’।। ব্রহ্মা বলেছেন, ‘‘আমি সেই আদি পুরুষ গোবিন্দের ভজনা করি, যিনি তাহার অংশবতার মহাবিষ্ণুরূপে কারণ সমুদ্রে যোগনিদ্রায় শায়িত এবং তাহার দিব্য শরীরের রোমকূপ থেকে অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ড বুদবুদ আকারে প্রকাশিত হইতেছে’’। বর্নণা মতে মহাবিষ্ণু কারণ সমুদ্রে (Causal Ocean) যোগনিদ্রায় শায়িত আছেন। তাহার রোমকূপ থেকে অসংখ্য ব্রহ্মান্ড বুদবুদ আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। ঐ বুদবুদগুলি পরবর্তীতে এক একটি ব্রহ্মাণ্ডে বিবর্তন বা সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ কারণ সমুদ্র (Causal Ocean) হলো এক একটি ব্লাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর।