হিন্দুধর্মে মনসা লৌকিক সর্পদেবী। তাঁর পূজা প্রধানত বাংলা ও উত্তর ভারতের
অন্যান্য অঞ্চলে প্রচলিত। সর্পদংশন প্রতিরোধ ও সাপের বিষের হাত থেকে রক্ষা
পাওয়ার জন্য তাঁর পূজা করা হয়। মনসা প্রজনন ও সমৃদ্ধিরও দেবী। তিনি নাগরাজ বাসুকীর ভগিনী ও ঋষি জগৎকারু বা জরৎকারুর পত্নী। মনসা বিষহরি (বিষনাশকারিণী), জগৎগৌরী, নিত্যা (চিরন্তনী) ও পদ্মাবতী নামেও পরিচিতা।
পুরাণ ও লোককথা অনুযায়ী, পিতা শিব ও স্বামী জগৎকারু উভয়েই মনসাকে প্রত্যাখ্যান করেন। সৎ-মা চণ্ডী (এই ক্ষেত্রে পার্বতীর নামান্তর) তাঁকে ঘৃণা করেন। এই কারণে মনসা সর্বদা নিরানন্দ ও বদরাগী। অন্য এক মতে, মনসার পিতা হলেন কশ্যপ। মনসা তাঁর ভক্তদের ভালবাসেন। কিন্তু যে তাঁর পূজা করতে অস্বীকার করে, তার প্রতি তিনি নির্দয় হন।
প্রথম দিকে দেবতারা মনসার দেবীত্ব স্বীকার করেননি। এই কারণে মনসাকে নিজে
উদ্যোগী হয়ে দেবী হিসেবে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হয় এবং নিজেকেই
নিজের পূজা প্রচার করে মানব ভক্তমণ্ডলীতে স্থান খুঁজে নিতে হয়।
উৎস
মনসা মূলত একজন আদিবাসী
দেবতা। নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যে তাঁর পূজা প্রচলিত ছিল। পরবর্তীকালে
উচ্চবর্ণীয় হিন্দুসমাজেও মনসা পূজা প্রচলন লাভ করে। বর্তমানে মনসা আর
আদিবাসী দেবতা নন, বরং তিনি একজন হিন্দু দেবীতে রূপান্তরিত হয়েছেন। হিন্দু দেবী হিসেবে তাঁকে নাগ বা সর্পজাতির পিতা কশ্যপ ও মাতা কদ্রুর সন্তান রূপে কল্পনা করা হয়েছে। খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দী নাগাদ, মনসাকে শিবের কন্যারূপে কল্পনা করে তাঁকে শৈবধর্মের
অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সময় থেকেই প্রজনন ও বিবাহরীতির দেবী হিসেবেও
মনসা স্বীকৃতি লাভ করেন। কিংবদন্তি অনুযায়ী, শিব বিষপান করলে মনসা তাঁকে
রক্ষা করেন; সেই থেকে তিনি বিষহরি নামে পরিচিতা হন। তাঁর জনপ্রিয়তা দক্ষিণ
ভারত পর্যন্ত প্রসারিত হয়। মনসার পূজকেরা শৈবধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেও
অবতীর্ণ হন। শিবের কন্যারূপে মনসার জন্মকাহিনি এরই ফলস্রুতি। এর পরেই
হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদী মূলধারায় মনসা দেবীরূপে স্বীকৃতিলাভ করেন।
মূর্তিতত্ত্ব
একাদশ শতাব্দীর মনসা ভাস্কর্য
মনসা সর্বাঙ্গে সর্পাভরণভূষিতা এবং পদ্ম অথবা নাগপৃষ্ঠে আসীনা। তাঁর
মাথার উপর সপ্তফণাযুক্ত নাগছত্র দেখা যায়। কখনো কখনো তাঁর কোলে একটি
শিশুকেও দেখা যায়। মনে করা হয় এটি তাঁর পুত্র আস্তিক।
মনসাকে "একচক্ষু কানা" (চাঁদ সদাগরের বিখ্যাত উক্তি অনুযায়ী, "চেঙমুড়ী
কানী") দেবীও বলা হয়। কারণ তাঁর একটি চোখ সৎ-মা চণ্ডী কর্তৃক দগ্ধ
হয়েছিল।
মহাভারত
মহাভারতে
মনসার বিবাহের কাহিনিটি রয়েছে। ঋষি জগৎকারু এক প্রচণ্ড তপস্যায় রত
ছিলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে বিবাহ করবেন না। একদা তিনি দেখতে পান যে
একদল লোককে গাছে উলটো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এঁরা ছিলেন তাঁরই
পূর্বপুরুষ। তাঁদের সন্তানেরা তাঁদের শ্রাদ্ধাদি সম্পূর্ণ না করায় তাঁদের
এই দুঃখজনক অবস্থা হয়েছিল। তাঁরা জগৎকারুকে বিবাহ করার উপদেশ দিয়ে বলেন
যে তাঁর পুত্রই শ্রাদ্ধাদি সম্পূর্ণ করে তাঁদের দুঃখ থেকে মুক্তি দিতে
পারবে। বাসুকী জগৎকারুর সঙ্গে নিজ ভগিনী মনসার বিবাহ দেন। আস্তিক নামে
তাঁদের একটি পুত্রসন্তান হয়। আস্তিক তাঁর পূর্বপুরুষদের মুক্তি দেন। রাজা জনমেজয় সর্পজাতির বিনাশার্থে সর্পনিধন যজ্ঞ শুরু করলে আস্তিকই নাগদের রক্ষা করেন।
পুরাণ
মনসার জন্মকাহিনি প্রথম উল্লিখিত হয়েছে পুরাণগ্রন্থেই।
মঙ্গলকাব্যে তাঁকে শিবের কন্যা বলা হলেও, পুরাণ অনুসারে তিনি ঋষি কশ্যপের
কন্যা। একদা সর্প ও সরীসৃপগণ পৃথিবীতে কলহ শুরু করলে কশ্যপ তাঁর মন থেকে
মনসার জন্ম দেন। ব্রহ্মা
তাঁকে সর্প ও সরীসৃপদের দেবী করে দেন। মনসা মন্ত্রবলে বিশ্বের উপর নিজ
কর্তৃত্ব স্থাপন করেন। এরপর মনসা শিবের সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করেন। শিব তাঁকে কৃষ্ণ-আরাধনার উপদেশ দেন। মনসা কৃষ্ণের আরাধনা করলে কৃষ্ণ তুষ্ট হয়ে তাঁকে সিদ্ধি প্রদান করেন এবং প্রথামতে তাঁর পূজা করে মর্ত্যলোকে তাঁর দেবীত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
কশ্যপ জরুৎকারুর সঙ্গে মনসার বিবাহ দেন। মনসা তাঁর অবাধ্যতা করলে, তিনি
মনসাকে ত্যাগ করবেন – এই শর্তে জরুৎকারু মনসাকে বিবাহ করেন। একদা মনসা দেরি
করে তাঁর নিদ্রাভঙ্গ করলে তাঁর পূজায় বিঘ্ন ঘটে। এই অপরাধে জরুৎকারু
মনসাকে ত্যাগ করেন। পরে দেবতাদের অনুরোধে তিনি মনসার কাছে ফিরে আসেন এবং
আস্তিক নামে তাঁদের একটি পুত্রসন্তান জন্মায়।
মঙ্গলকাব্য
মঙ্গলকাব্য
হল খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে বাংলায়
রচিত মনসা ও অন্যান্য স্থানীয় দেবদেবীর মাহাত্ম্যসূচক গাথাকাব্য। বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল ও বিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসাবিজয় কাব্যে মনসার জন্ম ও অন্যান্য উপাখ্যানগুলি সম্পূর্ণ বর্ণিত হয়েছে।
মনসাবিজয় কাব্য থেকে জানা যায়, বাসুকীর মা একটি ছোটো মেয়ের
মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। শিবের বীর্য এই মূর্তি স্পর্শ করলে মনসার জন্ম
হয়। বাসুকী তাঁকে নিজ ভগিনীরূপে গ্রহণ করেন। রাজা পৃথু
পৃথিবীকে গাভীর ন্যায় দোহন করলে উদগত বিষের দায়িত্বও বাসুকী মনসাকে দেন।
শিব মনসাকে দেখে কামার্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু মনসা প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে
তিনি শিবেরই কন্যা। শিব তখন মনসাকে স্বগৃহে আনয়ন করেন। শিবের পত্নী চণ্ডী
মনসাকে শিবের উপপত্নী মনে করেন। তিনি মনসাকে অপমান করেন এবং ক্রোধবশত তাঁর
একটি চোখ দগ্ধ করেন। পরে শিব একদা বিষের জ্বালায় কাতর হলে মনসা তাঁকে
রক্ষা করেন। একবার চণ্ডী তাঁকে পদাঘাত করলে তিনি তাঁর বিষদৃষ্টি হেনে
চণ্ডীকে অজ্ঞান করে দেন। শেষে মনসা ও চণ্ডীর কলহে হতাশ হয়ে শিব মনসাকে
পরিত্যাগ করেন। দুঃখে শিবের চোখ থেকে যে জল পড়ে সেই জলে জন্ম হয় মনসার
সহচরী নেতার।
পরে জরৎকারুর সঙ্গে মনসার বিবাহ হয়। কিন্তু চণ্ডী মনসার ফুলশয্যার
রাতটিকে ব্যর্থ করে দেন। তিনি মনসাকে উপদেশ দিয়েছিলেন সাপের অলঙ্কার পরতে
আর বাসরঘরে ব্যাঙ ছেড়ে রাখতে যাতে সাপেরা আকর্ষিত হয়ে তাঁর বাসরঘরে
উপস্থিত হয়। এর ফলে, ভয় পেয়ে জরৎকারু পালিয়ে যান। পরে তিনি ফিরে আসেন
এবং তাঁদের পুত্র আস্তিকের জন্ম হয়।
মনসামঙ্গল কাব্যের একটি পটচিত্র
এরপর মনসা তাঁর সহচরী নেতার সঙ্গে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন মানব ভক্ত সংগ্রহ
করার উদ্দেশ্যে। প্রথম দিকে লোকেরা তাঁকে ব্যঙ্গ করে। কিন্তু যারা তাকে
পূজা করতে অস্বীকার করে, তাদের চরম দুরবস্থা সৃষ্টি করে তাদের পূজা আদায়
করেন মনসা। তিনি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের পূজা লাভে সক্ষম হন। এমনকি
মুসলমান শাসক হাসানও তাঁর পূজা করেন। কিন্তু শিব ও চণ্ডীর পরমভক্ত চাঁদ সদাগর
তাঁর পূজা করতে অস্বীকার করেন। চাঁদের পূজা আদায়ের জন্য মনসা চাঁদের ছয়
পুত্রকে হত্যা করেন এবং তাঁকে নিঃস্ব করে দেন। পরে তিনি চাঁদের কনিষ্ঠ
পুত্র লখিন্দরকে হত্যা করলে, তাঁর বিধবা পুত্রবধূ বেহুলা চাঁদকে মনসা
পূজায় রাজি করাতে সক্ষম হন। চাঁদ মনসার দিকে না তাকিয়ে বাম হাতে তাঁকে
ফুল ছুঁড়ে দেন। মনসা তাতেই খুশি হয়ে চাঁদের ছয় পুত্রকে জীবিত করেন এবং
তাঁর সকল সম্পত্তি ফিরিয়ে দেন। এরপরই মনসা পূজা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন
করে।
মনসামঙ্গলে বলা হয়েছে, পূর্বজন্মে চাঁদকে মনসা একটি অভিশাপ দিয়েছিলেন।
তার পাল্টা অভিশাপে মনসার ভক্ত সংগ্রহে অসুবিধা হতে থাকে। কারণ এই শাপে
বলা হয়েছিল, চাঁদ মনসার পূজা না করলে মর্ত্যে মনসার পূজা প্রচলন লাভ করবে
না।
আনন্দ কে. কুমারস্বামী ও ভগিনী নিবেদিতা লিখেছেন, "[The] legend of [Chand Sadagar and] Manasā Devī, [...] who must be as old as the Mykenean
stratum in Asiatic society, reflects the conflict between the religion
of Shiva and that of female local deities in Bengal. Afterwards Manasā
or Padmā was recognized as a form of Shakti, [...] and her worship accepted by Shaivas.
She is a phase of the mother-divinity who for so many worshippers is
nearer and dearer than the far-off and impersonal Shiva...".
পূজা
অধিকাংশ ক্ষেত্রে, প্রতিমায় মনসা পূজা করা হয় না। মনসা পূজিতা হন
স্নুহী বা সীজ বৃক্ষের ডালে অথবা বিশেষভাবে সর্পচিত্রিত ঘট বা ঝাঁপিতে।
যদিও কোথাও কোথাও মনসা মূর্তিরও পূজা হয়। বাংলায় মনসা পূজা বহুল
প্রচলিত। এই অঞ্চলে মনসার মন্দিরও দেখা যায়। বর্ষাকালে সাপেদের
প্রাদুর্ভাব বেশি থাকে বলে এই সময়ই মনসা পূজা প্রচলিত। শ্রাবণ মাসে নাগপঞ্চমীতেও মনসার পূজা করা হয়। বাঙালি মেয়েরা এই দিন উপবাস ব্রত করে সাপের গর্তে দুধ ঢালেন।
এখন আপ্নারাই বিচার করবেন- যে ইনি - নারী থেকে দেবী নাকি নিন্ম থেকে উচ্চবর্ণের হিন্দু দের দেবীতে পরিণত হওয়া দেব শক্তি?
ধন্যবাদ সবাইকে
|