দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব হিন্দু দেবী দুর্গার আরাধনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হওয়া বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। শাস্ত্রীয় বিধানে আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষে এবং চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষে দুর্গোৎসব পালন করা যায়। চৈত্র অর্থাৎ বসন্তকালের দুর্গাপূজা বাসন্তী দুর্গাপূজা ও আশ্বিন অর্থাৎ শরৎকালের দুর্গাপূজা শারদীয়া দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। বাংলায় শারদীয়া দুর্গাপূজা অধিক জনপ্রিয়। যদিও অনেক পরিবারে বাসন্তী দুর্গোৎসব পালনের প্রথাও বর্তমান।
দুর্গাপূজা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্তর্গত একাধিক রাষ্ট্রে পালিত হয়ে থাকলেও, এটি বিশেষ করে বাঙালিদের উৎসব হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় এই উৎসবের জাঁকজমক সর্বাধিক। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ও বিশেষ উৎসাহে এই উৎসব পালন করে থাকেন। এমনকি অসম ও ওড়িশাতেও দুর্গাপূজা মহাসমারোহে পালিত হয়ে থাকে। বর্তমানকালে পাশ্চাত্য, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যেসব দেশগুলিতে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা কর্মসূত্রে অবস্থান করেন, সেখানেও মহাসমারোহে দুর্গোৎসব আয়োজিত হয়ে থাকে। এই কারণে সারা বিশ্বের কাছেই বর্তমানে বাংলার অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে দুর্গোৎসব। ২০০৬ সালে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রেট হল-এ ভয়েসেস অব বেঙ্গল সিজন নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রদর্শনীর অঙ্গ হিসাবে বিরাট দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন স্থানীয় বাঙালি অভিবাসীবৃন্দ ও জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।
সাধারণত আশ্বিন শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে দশম দিন অর্থাৎ দশমী অবধি পাঁচ দিন দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। আবার সমগ্র পক্ষটি দেবীপক্ষ নামে আখ্যাত হয়। দেবীপক্ষের সূচনা হয় পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন; এই দিনটি মহালয়া নামে পরিচিত। অন্যদিকে দেবীপক্ষের সমাপ্তি পঞ্চদশ দিন অর্থাৎ পূর্ণিমায়; এই দিনটি কোজাগরী পূর্ণিমা নামে পরিচিত ও বাৎসরিক লক্ষ্মীপূজার দিন হিসাবে গণ্য হয়। দুর্গাপূজা মূলত পাঁচদিনের অনুষ্ঠান হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা ও কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় তার সমাপ্তি। পশ্চিমবঙ্গের কোনও কোনও পরিবারে অবশ্য পনেরো দিনে দুর্গোৎসব পালনের প্রথা আছে। এক্ষেত্রে উৎসব মহালয়ার পূর্বপক্ষ অর্থাৎ পিতৃপক্ষের নবম দিন অর্থাৎ কৃষ্ণানবমীতে শুরু হয়ে থাকে। বিষ্ণুপুরের প্রাচীন রাজবাড়িতে আজও এই প্রথা বিদ্যমান। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় মহাসপ্তমী থেকে বিজয়া দশমী অবধি জাতীয় ছুটি ঘোষিত থাকে; এই ছুটি বাংলাদেশে কেবলমাত্র বিজয়া দশমীর দিনই পাওয়া যায়।
বর্তমানকালে দুর্গাপূজা দুইভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে – ব্যক্তিগতভাবে পারিবারিক স্তরে ও সমষ্টিগতভাবে পাড়া স্তরে। ব্যক্তিগত পূজাগুলি নিয়মনিষ্ঠা ও শাস্ত্রীয় বিধান পালনে বেশি আগ্রহী হয়; এগুলির আয়োজন মূলত বিত্তশালী বাঙালি পরিবারগুলিতেই হয়ে থাকে। অন্যদিকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাসিন্দারা একত্রিত হয়ে যৌথ উদ্যোগেও দুর্গোৎসবের আয়োজন করেন। এগুলি বারোয়ারি বা সর্বজনীন পূজা নামে পরিচিত। সর্বজনীন পূজার উদ্ভবের ইতিহাসের সঙ্গে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের ঐতিহ্য ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। আজকাল এই পূজাগুলিতে থিম পূজা অর্থাৎ, থিম ভিত্তিক মণ্ডপ ও প্রতিমা নির্মাণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
পৌরাণিক উপাখ্যান
পূজা শুরুর প্রাগমুহুর্তে, কলকাতার একটি পূজামণ্ডপে মহাষষ্টীর বোধনের পূর্বে দেবীপ্রতিমা, ২০০৬
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে উল্লিখিত কিংবদন্তী অনুসারে দুর্গোৎসবের প্রবর্তক স্বয়ং কৃষ্ণ।
এই পুরাণে দুর্গাপূজা প্রবর্তনের একটি ইতিহাস কথিত হয়েছে। বলা বাহুল্য,
এই ইতিহাস কোনও প্রামাণিক ইতিহাস নয়, বরং একটি পৌরাণিক সূচিমাত্র।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এ লিখিত বিবরণ অনুসারেঃ
প্রথমে পূজিতা সা চ কৃষ্ণেন পরমাত্মনা। বৃন্দাবনে চ সৃষ্ট্যাদ্যৌ গোলকে রাগমণ্ডলে।।
মধুকৈটভভীতেন ব্রহ্মণা সা দ্বিতীয়তঃ। ত্রিপুরপ্রেষিতেনৈব তৃতীয়ে ত্রিপুরারিণা।।
ভ্রষ্টশ্রিয়া মহেন্দ্রেন শাপাদ্দুর্বাসসঃ পুরা। চতুর্থে পূজিতা দেবী ভক্ত্যা ভগবতী সতী।।
তদা মুনীন্দ্রৈঃ সিদ্ধেন্দ্রৈর্দেবৈশ্চ মুনিমানবৈঃ। পূজিতা সর্ববিশ্বেষু বভূব সর্ব্বতঃ সদা।।
অর্থাৎ, সৃষ্টির আদিতে গোলকস্থ আদিবৃন্দাবনক্ষেত্রের মহারাসমণ্ডলে কৃষ্ণ
সর্বপ্রথম দুর্গাপূজা করেন। দ্বিতীয়বার দুর্গার আরাধনা করেন মধুকৈটভ
দৈত্যদ্বয়ের ভয়ে ভীত ব্রহ্মা। ত্রিপুরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধকালে সংকটাপন্ন মহাদেব
তৃতীয়বার দুর্গাপূজা করেছিলেন। এরপর দুর্বাসা মুনির শাপে শ্রীভ্রষ্ট হয়ে
দেবরাজ ইন্দ্র যে দুর্গাপূজা করেন, তা ছিল চতুর্থ দুর্গোৎসব। এরপর থেকেই
পৃথিবীতে মুনিগণ, সিদ্ধ ও দেবতাগণ এবং মানবগণ নানা দেশে নানা সময়ে
দুর্গোৎসবের আয়োজন করে।
দেবী ভাগবত পুরাণ
দেবী ভাগবত অনুসারে ব্রহ্মা ও ইন্দ্রের ন্যায় ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু (ইনি পৌরাণিক চরিত্র, সংহিতাকার নন) পৃথিবীর শাসনভার পেয়ে ক্ষীরোদসাগরের
তীরে মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মান করে দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। এই সময়ে
তিনি বাগ্ভব বীজ জপ করতেন ও আহার ও শ্বাসগ্রহণ পরিত্যাগ করে ভূতলে একপদে
দণ্ডায়মান থেকে একশত বছর ধরে ঘোর তপস্যা করেন। তপঃপ্রভাবে অত্যন্ত শীর্ণ
হয়ে পড়লেও মনু কামক্রোধ জয় করে হৃদয়ে দুর্গাচিন্তা করতে করতে সমাধির
প্রভাবে স্থাবর হয়ে পড়লেন। তখন দুর্গা প্রীত হয়ে তাঁকে দর্শনদান পূর্বক
বরদান করতে চাইলে মনু দেবদুর্লভ বর চাইলেন। মনুর প্রার্থনা শুনে দেবী
দুর্গা বললেন, "হে মহাবাহো! তোমার প্রার্থনা সুসিদ্ধ হবে। আমি তোমাকে তোমার
সকল প্রার্থনীয় বিষয় দান করছি। বৎস! তোমার রাজ্য নিষ্কণ্টক হোক; তুমি
পুত্রলাভ কর।”
দেবীমাহাত্ম্যম্
বৈষ্ণবী ও বারাহী দেবী শুম্ভ-নিশুম্ভের অসুরসৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধরতা, সপ্তদশ শতাব্দীর পুথিচিত্রণ
: শ্রীশ্রীচণ্ডী
দুর্গা ও দুর্গাপূজা সংক্রান্ত কাহিনিগুলির মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ও লোকমান্য হল দেবীমাহাত্ম্যম্-এ বর্ণিত কাহিনিটি। দেবীমাহাত্ম্যম্ প্রকৃতপক্ষে মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এর একটি নির্বাচিত অংশ। বাংলায় সাধারণত শ্রীশ্রীচণ্ডী
নামে পরিচিত সাতশত শ্লোকবিশিষ্ট এই দেবীমাহাত্ম্যম্ পাঠ দুর্গোৎসবের একটি
অবিচ্ছেদ্য অঙ্গও বটে। এই গ্রন্থে দুর্গাকে নিয়ে চারটি কাহিনি প্রচলিত
আছে; তার মধ্যে একটি কাহিনি দুর্গোৎসব প্রচলনের এবং অপরাপর তিনটি কাহিনি
দেবী দুর্গার মাহাত্ম্যকীর্তন সংক্রান্ত। ঐ তিনটি কাহিনিতে দুর্গাই
কেন্দ্রীয় চরিত্র।
রাজা সুরথের কাহিনি
রাজা সুরথের কাহিনিটি প্রকৃতপক্ষে গ্রন্থের অবতারণার উপলক্ষ্যমাত্র। রাজা সুরথ
ছিলেন সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর ও সুশাসক। কিন্তু একবার এক যুদ্ধে কতিপয়
যবনের হাতে তাঁর পরাজয় ঘটে। সেই সুযোগে তাঁর প্রিয় অমাত্যগণ বলহীন রাজার
ধনসম্পদ ও সেনা অধিকার করে নেন। রাজা মনের দুঃখে শিকারে যাবার ছলে বনে গমন
করেন। বনে ভ্রমণ করতে করতে রাজা সুরথ মেধা
ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হলেন। মুনি রাজাকে যথোচিত সমাদর করলেন ও আশ্রয়
দিলেন। কিন্তু সেই তপোবনেও হৃতরাজ্যের ভালমন্দের চিন্তায় তাঁর হৃদয়
শঙ্কিত হয়ে উঠতে লাগল। এমন সময় রাজা সমাধি নামক এক বৈশ্যের সাক্ষাৎ পেলেন
তপোবনে। তাঁর সঙ্গে আলাপ করে জানলেন, সেই বৈশ্যের অসাধু স্ত্রীপুত্রগণ
তাঁর সর্বস্ব অধিকার করে তাঁকে পরিত্যাগ করেছে। কিন্তু বৈশ্যও রাজার মতোই
তাঁর পরিবারবর্গের শুভাশুভ আশঙ্কায় উৎকণ্ঠিত হয়ে আছেন। তাঁদের মনে প্রশ্ন
জাগল, যাঁরা তাঁদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করে পথের ভিক্ষুক বানিয়েছে তাঁদের
প্রতি ক্রোধান্বিত না হয়ে কেন হৃদয়ে অনুকম্পার উদয় হচ্ছে। উভয়ে মেধা
ঋষির সমীপে উপস্থিত হয়ে তাঁদের প্রশ্ন ব্যক্ত করলেন। মেধাঋষি তাঁদের বললেন
পরমেশ্বরী শক্তি মহামায়ার
প্রভাবেই এমন হচ্ছে। রাজা সুরথ তাঁকে মহামায়ার স্বরূপ সম্পর্কে প্রশ্ন
করলে তিনি একে একে চণ্ডীপুস্তকে বর্ণিত দেবীমাহাত্ম্য সংক্রান্ত
কাহিনিত্রয়ের উল্লেখ করলেন। গ্রন্থের শেষে আছে, ঋষির কাহিনি শুনে
অনুপ্রাণিত রাজা ও বৈশ্য নদীতীরে তিনবছর কাল কঠোর তপশ্চর্যা অবলম্বন করে
দুর্গোৎসব করলেন এবং শেষে দেবীর বরে রাজা হৃতরাজ্য ও বৈশ্য তত্ত্বজ্ঞান লাভ
করলেন।
মধুকৈটভের কাহিনি
মধুকৈটভ বধরত নারায়ণ, সপ্তদশ শতাব্দীর পুথিচিত্রণ
শ্রীশ্রীচণ্ডী গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে সংক্ষেপে মধুকৈটভের
উপাখ্যানটি বর্ণিত হয়েছে : প্রলয়কালে পৃথিবী এক বিরাট কারণ-সমুদ্রে পরিণত
হলে বিষ্ণু সেই সমুদ্রের উপর অনন্তনাগকে শয্যা করে যোগনিদ্রায় মগ্ন হলেন।
এই সময় বিষ্ণুর কর্ণমল থেকে মধু ও কৈটভ নামে দুই দৈত্য নির্গত হয়ে
বিষ্ণু নাভিপদ্মে স্থিত ব্রহ্মাকে বধ করতে উদ্যত হল। ভীত হয়ে ব্রহ্মা
বিষ্ণুকে জাগরিত করবার জন্যে তাঁর নয়নাশ্রিতা যোগনিদ্রার স্তব করতে
লাগলেন। এই স্তবটি গ্রন্থে উল্লিখিত চারটি প্রধান স্তবমন্ত্রের অন্যতম। এই
স্তবে সন্তুষ্টা দেবী বিষ্ণুকে জাগরিত করলে তিনি পাঁচ হাজার বছর ধরে মধু ও
কৈটভের সঙ্গে মহাসংগ্রামে রত হলেন। মহামায়া শেষে ঐ দুই অসুরকে বিমোহিত
করলে তারা বিষ্ণুকে বলে বসে, "আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা প্রীত; তাই আপনার
হাতে মৃত্যু হবে আমাদের শ্লাঘার বিষয়। পৃথিবীর যে স্থান জলপ্লাবিত নয়,
সেখানে আপনি আমাদের উভয়কে বিনাশ করতে পারেন।” বিষ্ণু বললেন, "তথাস্তু।”
এবং অসুরদ্বয়ের মাথা নিজের জঙ্ঘার উপর রেখে তাদের বধ করলেন।
মহিষাসুরের কাহিনি
মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা, গুলের ঘরানার চিত্র, দ্রষ্টব্য এই চিত্রে দেবী ব্যাঘ্রবাহিনী
শ্রীশ্রীচণ্ডী গ্রন্থে বর্ণিত দেবী দুর্গার কাহিনিগুলির মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় আবার গ্রন্থের মধ্যম চরিত্র বা দ্বিতীয় খণ্ডে উল্লিখিত মহিষাসুর
বধের কাহিনিটি। এই কাহিনি অনুসারে : পুরাকালে মহিষাসুর দেবগণকে
একশতবর্ষব্যাপী এক যুদ্ধে পরাস্ত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নিলে, বিতাড়িত
দেবগণ প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং পরে তাঁকে মুখপাত্র করে শিব ও নারায়ণের
সমীপে উপস্থিত হলেন। মহিষাসুরের অত্যাচার কাহিনি শ্রবণ করে তাঁরা উভয়েই
অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হলেন। সেই ক্রোধে তাঁদের মুখমণ্ডল ভীষণাকার ধারণ করল।
প্রথমে বিষ্ণু ও পরে শিব ও ব্রহ্মার মুখমণ্ডল হতে এক মহাতেজ নির্গত হল। সেই
সঙ্গে ইন্দ্রাদি অন্যান্য দেবতাদের দেহ থেকেও সুবিপুল তেজ নির্গত হয়ে সেই
মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হল। সু-উচ্চ হিমালয়ে
স্থিত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই বিরাট তেজঃপুঞ্জ একত্রিত হয়ে এক
নারীমূর্তি ধারণ করল। কাত্যায়নের আশ্রমে আবির্ভূত হওয়ায় এই দেবী
কাত্যায়নী নামে অভিহিতা হলেন। অন্য সূত্র থেকে জানা যায়, আশ্বিন মাসের
কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে দেবী কাত্যায়নী আবির্ভূতা হয়েছিলেন; শুক্লা
সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে কাত্যায়ন দেবীকে পূজা করেন এবং দশমীতে দেবী
মহিষাসুর বধ করেন।
যাই হোক, এক এক দেবের প্রভাবে দেবীর এক এক অঙ্গ উৎপন্ন হল। প্রত্যেক
দেবতা তাঁদের আয়ূধ বা অস্ত্র দেবীকে দান করলেন। হিমালয় দেবীকে তাঁর বাহন সিংহ দান করলেন। এই দেবীই অষ্টাদশভূজা মহালক্ষ্মী রূপে মহিষাসুর বধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন (শ্রীশ্রীচণ্ডী
অনুসারে, মহালক্ষ্মী দেবী মহিষাসুর বধ করেন। ইনিই দুর্গা। তবে বাঙালিরা
এঁকে দশভূজারূপে পূজা করে থাকেন)। দেবী ও তাঁর বাহনের সিংহনাদে ত্রিভুবন
কম্পিত হতে লাগল।
মহিষাসুর সেই প্রকম্পনে ভীত হয়ে প্রথমে তাঁর সেনাদলের বীরযোদ্ধাদের
পাঠাতে শুরু করলেন। দেবী ও তাঁর বাহন সিংহ প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ করে একে
একে সকল যোদ্ধা ও অসুরসেনাকে বিনষ্ট করলেন। তখন মহিষাসুর স্বয়ং দেবীর
সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেন। যুদ্ধকালে ঐন্দ্রজালিক মহিষাসুর নানা রূপ ধারণ করে
দেবীকে ভীত বা বিমোহিত করার প্রচেষ্টায় রত হলেন; কিন্তু দেবী সেই সকল
প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিলেন। তখন অসুর অহঙ্কারে মত্ত হয়ে প্রবল গর্জন করল।
দেবী বললেন,
" |
গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় মধু যাবৎ পিবাম্যহম। ময়া ত্বয়ি হতেঽত্রৈব গর্জিষ্যন্ত্যাশু দেবতাঃ।। |
” |
- রে মূঢ়, যতক্ষণ আমি মধুপান করি, ততক্ষণ তুই গর্জন করে নে। আমি তোকে বধ করলেই দেবতারা এখানে শীঘ্রই গর্জন করবেন।।
এই বলে দেবী লম্ফ দিয়ে মহিষাসুরের উপর চড়ে তাঁর কণ্ঠে পা দিয়ে
শূলদ্বারা বক্ষ বিদীর্ণ করে তাকে বধ করলেন। অসুরসেনা হাহাকার করতে করতে
পলায়ন করল এবং দেবতারা স্বর্গের অধিকার ফিরে পেয়ে আনন্দধ্বনি করতে
লাগলেন।
শুম্ভ-নিশুম্ভের কাহিনি
দেবীমাহাত্ম্যম্-এ বর্ণিত দেবী দুর্গা সংক্রান্ত তৃতীয় ও
সর্বশেষ কাহিনিটি হল শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের কাহিনি। গ্রন্থের উত্তর চরিত্র বা
তৃতীয় খণ্ডে বিধৃত পঞ্চম থেকে একাদশ অধ্যায়ে এই কাহিনি বর্ণিত হয়েছে :
শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে দুই অসুরভ্রাতা স্বর্গ ও দেবতাদের যজ্ঞভাগ অধিকার করে
নিলে দেবগণ হিমালয়ে গিয়ে বৈষ্ণবী শক্তি মহাদেবীকে স্তব করতে লাগলেন
(পঞ্চম অধ্যায়ে উল্লিখিত এই স্তবটি অপরাজিতস্তব নামে পরিচিত; এটি
হিন্দুদের নিকট অতিপবিত্র ও নিত্যপাঠ্য একটি স্তবমন্ত্র; "যা দেবী
সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা” ও সমরূপ মন্ত্রগুলি এই স্তবের অন্তর্গত)।
এমন সময় সেই স্থানে পার্বতী গঙ্গাস্নানে উপস্থিত হলে, আদ্যাদেবী ইন্দ্রাদি
দেবতার স্তবে প্রবুদ্ধা হয়ে তাঁর দেহকোষ থেকে নির্গত হলেন। এই দেবী
কৌশিকী নামে আখ্যাত হলেন ও শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।
শুম্ভ-নিশুম্ভের চর চণ্ড ও মুণ্ড তাঁকে দেখতে পেয়ে নিজ প্রভুদ্বয়কে বললেন
যে এমন স্ত্রীলোক আপনাদেরই ভোগ্যা হবার যোগ্য। চণ্ড-মুণ্ডের কথায়
শুম্ভ-নিশুম্ভ মহাসুর সুগ্রীবকে দৌত্যকর্মে নিযুক্ত করে দেবীর নিকট প্রেরণ
করলেন। সুগ্রীব দেবীর কাছে শুম্ভ-নিশুম্ভের কুপ্রস্তাব মধুরভাবে ব্যক্ত
করল। দেবী মৃদু হেসে বিনীত স্বরে বললেন, "তুমি সঠিকই বলেছ। এই বিশ্বে
শুম্ভ-নিশুম্ভের বীর কে আছে? তবে আমি পূর্বে অল্পবুদ্ধিবশতঃ প্রতিজ্ঞা
করেছিলাম, যে আমাকে যুদ্ধে পরাভূত করতে পারবে, কেবলমাত্র তাকেই আমি বিবাহ
করব। এখন আমি প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করি কি করে! তুমি বরং মহাসুর শুম্ভ বা
নিশুম্ভকে বল, তাঁরা যেন এখানে এসে আমাকে পরাস্ত করে শীঘ্র আমার পাণিগ্রহণ
করেন। আর বিলম্বে কি প্রয়োজন?” সুগ্রীব ক্রোধান্বিত হয়ে দেবীকে নিরস্ত
হতে পরামর্শ দিল। কিন্তু দেবী নিজবাক্যে স্থির থেকে তাকে শুম্ভ-নিশুম্ভের
কাছে প্রেরণ করলেন।
দেবীর কথায় কুপিত হয়ে অসুররাজ শুম্ভ তাঁকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার
উদ্দেশ্যে দৈত্যসেনাপতি ধূম্রলোচনকে প্রেরণ করলেন। ধূম্রলোচনের সঙ্গে দেবীর
ভয়ানক যুদ্ধ হল ও সেই যুদ্ধে ধূম্রলোচন পরাজিত ও নিহত হল। এই সংবাদ পেয়ে
শুম্ভ চণ্ড-মুণ্ড ও অন্যান্য অসুরসৈন্যদের প্রেরণ করল। তাদের সঙ্গে যুদ্ধ
করার জন্য দেবী নিজ দেহ থেকে দেবী কালীর সৃষ্টি করলেন। চামুণ্ডা ভীষণ
যুদ্ধের পর চণ্ড-মুণ্ডকে বধ করলেন। তখন দেবী দুর্গা তাঁকে চামুণ্ডা আখ্যায়
ভূষিত করলেন।
কলকাতার খিদিরপুরের ভেনাস ক্লাবে রামের অকালবোধন দৃশ্য
চণ্ড-মুণ্ডের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সকল দৈত্যসেনাকে সুসজ্জিত করে প্রেরণ
করলেন দেবীর বিরুদ্ধে। তখন তাঁকে সহায়তার প্রত্যেক দেবতার শক্তি রূপ ধারণ
করে রণক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন। এই দেবীরা হলেন ব্রহ্মাণী, মাহেশ্বরী,
কৌমারী, বৈষ্ণবী, বারাহী, নারসিংহী, ঐন্দ্রী প্রমুখ। এঁরা প্রচণ্ড যুদ্ধে
দৈত্যসেনাদের পরাভূত ও নিহত করতে লাগলেন। এই সময় রক্তবীজ দৈত্য
সংগ্রামস্থলে উপস্থিত হল। তার রক্ত একফোঁটা মাটিতে পড়লে তা থেকে লক্ষ লক্ষ
রক্তবীজ দৈত্য সৃষ্টি হয়। এই কারণে দুর্গা কালীর সহায়তায় রক্তবীজকে বধ
করলেন। কালী রক্তবীজের রক্ত মাটিতে পড়তে না দিয়ে নিজে পান করে নেন।
এরপর শুম্ভ আপন ভ্রাতা নিশুম্ভকে যুদ্ধে প্রেরণ করেন। প্রচণ্ড যুদ্ধের
পর দেবী দুর্গা নিশুম্ভকে বধ করলেন। প্রাণপ্রতিম ভাইয়ের মৃত্যুর শোকে আকুল
হয়ে শুম্ভ দেবীকে বলল, "তুমি গর্ব করো না, কারণ তুমি অন্যের সাহায্যে এই
যুদ্ধে জয়লাভ করেছ।” তখন দেবী বললেন,
" |
একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মামপরা। পশ্যৈতা দুষ্ট মধ্যেব বিশন্ত্যো মদ্বিভূতয়ঃ।। |
” |
-একা আমিই এ জগতে বিরাজিত। আমি ছাড়া দ্বিতীয় কে আছে? রে দুষ্ট, এই সকল দেবী আমারই বিভূতি। দ্যাখ্, এরা আমার দেহে বিলীন হচ্ছে।
তখন অন্যান্য সকল দেবী দুর্গার দেহে মিলিত হয়ে গেলেন। দেবীর সঙ্গে
শুম্ভের ঘোর যুদ্ধ আরম্ভ হল। যুদ্ধান্তে দেবী শুম্ভকে শূলে গ্রথিত করে বধ
করলেন। দেবতারা পুনরায় স্বর্গের অধিকার ফিরে পেলেন।
কৃত্তিবাসি রামায়ণ
মূল রামায়ণে রামচন্দ্রের দুর্গোৎসবের কোনও বিবরণ না থাকলেও, কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর বাংলা রামায়ণ পদ্যানুবাদে কালিকা পুরাণের ঘটনা সাজিয়ে রামচন্দ্রের
দুর্গাপূজার চিত্র এঁকেছেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণ অনুসারে রাবণ বধের জন্য
ব্রহ্মা রামকে দুর্গোৎসবের পরামর্শ দিলে তিনি অকালে দেবীর বোধন ঘটান। অতঃপর
দুর্গাষষ্টী, মহাসপ্তমী ও মহাষ্টমী তিথিতে রীতিমতো চণ্ডীপাঠ করে তন্ত্রমতে দেবী দুর্গার আরাধনা করেন রাম। নবমীতে ১০৮ নীলপদ্মযোগে পূজার আয়োজন করা হলে হনুমান
সেই পদ্ম জোগাড় করেন। কিন্তু দেবী রামকে পরীক্ষা করার জন্য একটি পদ্ম
মায়াবলে লুকিয়ে ফেলেন। পদ্ম না পেয়ে পদ্মলোচন রাম নিজের একচক্ষু উৎপাটনে
উদ্যত দেবী তাঁকে দর্শন দেন ও রাবণবধের বরদান করেন।
মূর্তিতত্ত্ব
বাংলায় দেবী দুর্গার যে মূর্তিটি সচরাচর দেখা যায় সেটি পরিবারসমন্বিতা
বা সপরিবার দুর্গার মূর্তি। এই মূর্তির মধ্যস্থলে দেবী দুর্গা সিংহবাহিনী ও
মহিষাসুরমর্দিনী; তাঁর ডানপাশে উপরে দেবী লক্ষ্মী ও নিচে গণেশ; বামপাশে উপরে দেবী সরস্বতী ও নিচে কার্তিকেয়।কলকাতায় সাবর্ণ রায়চৌধুরী
পরিবার ১৬১০ সালে এই সপরিবার দুর্গার প্রচলন করেন । তাঁরা কার্তিকেয়র রূপ
দেন জমিদারপুত্রের, যা তৎপূর্ব ছিল সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের আদলে যুদ্ধের
দেবতা রূপে । এছাড়াও বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর-সংলগ্ন
অঞ্চলে দেবী দুর্গা এক বিশেষ মূর্তি দেখা যায়। সেখানে দেবীর ডানপাশে উপরে
গণেশ ও নিচে লক্ষ্মী, বামে উপরে কার্তিকেয় ও নিচে সরস্বতী এবং কাঠামোর
উপরে নন্দী-ভৃঙ্গীসহ বৃষভবাহন শিব ও দুইপাশে দেবীর দুই সখী জয়া ও বিজয়া
অবস্থান করেন। কলকাতার কোনও কোনও বাড়িতে দুর্গোৎসবে লক্ষ্মী ও গণেশকে
সরস্বতী ও কার্তিকেয়ের সঙ্গে স্থান বিনিময় করতে দেখা যায়। আবার কোথাও
কোথায় দুর্গাকে শিবের কোলে বসে থাকতেও দেখা যায়। এগুলি ছাড়াও বাংলার
বিভিন্ন অঞ্চলে দেবী দুর্গার বিভিন্ন রকমের স্বতন্ত্র মূর্তিও চোখে পড়ে।
তবে দুর্গার রূপকল্পনা বা কাঠামোবিন্যাসে যতই বৈচিত্র থাকুক, বাংলায়
দুর্গোৎসবে প্রায় সর্বত্রই দেবী দুর্গা সপরিবারে পূজিতা হন। এই প্রসঙ্গে
স্বামী প্রমেয়ানন্দের উক্তিটি স্মরণীয়ঃ
" |
...ধনদাত্রী লক্ষ্মী,
বিদ্যাদায়িনী সরস্বতী, শৌর্য-বীর্যের প্রতীক কার্তিকেয়, সিদ্ধিদাতা গণেশ ও
তাঁদের বাহন-সকলের মূর্তিসহ মহামহিমময়ী দুর্গামূর্তির পরিকল্পনা ও পূজা
বাংলার নিজস্ব। |
” |
দুর্গা
হিন্দু শাস্ত্রে ‘দুর্গা’ নামটির ব্যাখ্যা নিম্নোক্তরূপে প্রদত্ত হয়েছে :
" |
দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ।
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।।
রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।
ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।।
|
” |
- ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, উ-কার বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর
পাপনাশক ও অ-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও
ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। অন্যদিকে শব্দকল্পদ্রুম
অনুসারে, "দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা” – অর্থাৎ,
দুর্গ নামক অসুরকে যিনি বধ করেন তিনিই নিত্য দুর্গা নামে অভিহিতা। আবার শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুসারে এই দেবীই ‘নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্যাঃ’ বা সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি।
সিংহ
উত্তর কলকাতার কাশীপুরের একটি মণ্ডপে তাপসীবেশে সিংহবাহিনী মহিষাসুরমর্দিনী
দেবী দুর্গার বাহন সিংহ। শ্রীশ্রীচণ্ডী গ্রন্থে দেবীর বাহন ‘বাহনকেশরী’, ‘ধূতসট’ প্রভৃতি বিশেষণে ভূষিত হয়েছে। দুর্গোৎসব কালে সিংহেরও পূজা কর্তব্য বলে গণ্য হয়।
সিংহ রজোগুণের এক প্রচণ্ড শক্তির উচ্ছ্বাসের প্রতীক। স্বামী নির্মলানন্দ বলেছেন,
" |
সত্ত্বগুণের অনুগত হলে সেই
শক্তি লোকস্থিতির সহায়ক হয়ে ওঠে। ... (সিংহ) আসুরিকতা ও পাশবিকতার উচ্ছেদ
সাধনপূর্বক দেবীর লোকস্থিতিমূলক পূণ্য কর্মের সহায়কারী। |
” |
এছাড়াও সিংহ মানুষের পশুত্ববিজয়েরও প্রতীক। স্বামী প্রমেয়ানন্দ লিখেছেন,
" |
প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আছে
পশুশক্তি। পুরুষকার ও সাধন-ভজনের দ্বারা মানুষ যখন যথার্থ মনুষ্যত্বে উপনীত
হয় তখন তার পশুভাব কেটে গিয়ে দেবভাব জাগ্রত হয়। আর তখনই সে প্রকৃত
শরণাগত হওয়ার যোগ্যতা লাভ করে, সার্থক জীবনের অধিকারী হয়। দেবীর চরণতলে
সিংহ সেই ভাবেরই প্রতীক। |
” |
মহিষাসুর
বেহালার ২৯ পল্লির থিম পূজামণ্ডপে দেবীপ্রতিমায় বাঁকুড়া জেলার লোকশিল্পের ছোঁয়া, ২০০৭
মহিষাসুর অসুর, অর্থাৎ দেবদ্রোহী। তাই দেবীপ্রতিমায় দেবীর পদতলে দলিত
এই অসুর ‘সু’ এবং ‘কু’-এর মধ্যকার চিরকালীন দ্বন্দে অশুভ শক্তির উপর
শুভশক্তির বিজয়ের প্রতীক। স্বামী প্রমেয়ানন্দের ভাষায়,
" |
সাধকের পক্ষে অসুর অবিদ্যা।
বিদ্যারূপিণী মা অবিদ্যা বিনাশ করে মহামুক্তির বিধান করেন। সাধারণ মানুষের
জীবনে দুঃখ-কষ্ট, ভয়-ভীতি, আপদ-বিপদ – এ-সকলই আসুরিক শক্তির কার্য।
পরমকরুণাময়ী মা নিরন্তর অসুর বিনাশ করে সন্তানের কল্যাণ বিধান করছেন। |
” |
তবে অসুর হলেও দুর্গোৎসবে মহিষাসুরেরও পূজার চল আছে। কালিকা পুরাণ
অনুসারে, মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে নিজের মৃত্যুদৃশ্য স্বপ্নে দেখে ভীত
মহিষাসুর ভদ্রকালীকে তুষ্ট করেছিলেন। ভদ্রকালী তাঁকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি না
দিলেও তাঁর ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে বরদান করতে ইচ্ছুক হন। মহিষাসুর দেবতাদের
যজ্ঞভাগ বর চাইলে দেবী সেই বর দিতে অস্বীকৃত হন; কিন্তু মহিষাসুরকে এই বর
দেন যে যেখানেই দেবী পূজিতা হবেন, সেখানেই তাঁর চরণতলে মহিষাসুরেরও স্থান
হবে।
গণেশ
গণেশ সিদ্ধির দেবতা। পুরাণ অনুসারে, তিনি সর্বাগ্রপূজ্য। গণেশের পূজা না
করে অপর কোনও দেবতার পূজা করার বিধান নেই। স্বামী প্রমেয়ানন্দের ভাষায়,
" |
গণশক্তি যেখানে ঐক্যবদ্ধ
সেখানে কর্মের সকল প্রকার বাধাবিঘ্ন দূরীভূত হয়। দেবাসুর-যুদ্ধে দেবতারা
যতবারই ঐক্যবদ্ধ হয়ে অসুরদের সঙ্গে লড়াই করেছেন ততবারই তাঁরা জয়ী
হয়েছেন। গণেশের আর এক নাম বিঘ্নেশ, অর্থাৎ বিঘ্ননাশকারী। বিঘ্নেশ প্রসন্ন
থাকলে সিদ্ধি নিশ্চিত। |
” |
বেহালার একটি পূজামণ্ডপে সনাতন বাঙালি ভাস্কর্যে সপরিবার দুর্গা, ২০০৭
মুষিক
গণেশের বাহন মূষিক বা ইঁদুর। ইঁদুর মায়া ও অষ্টপাশ ছেদনের প্রতীক। ব্রহ্মর্ষি শ্রীসত্যদেবের ভাষায়,
" |
অথর্বশীর্ষের সায়নভাষ্যে উক্ত হইয়াছে মুষ্ণাতি অপহরতি কর্মফলানি ইতি মূষিকঃ।
জীবের কর্মফলসমূহ অজ্ঞাতসারে অপহরণ করে বলিয়া ইহার নাম মূষিক। প্রবল
প্রতিবন্ধকস্বরূপ কর্মফল বিদ্যমান থাকিতে সিদ্ধিলাভ হয় না। তাই, কর্মফল
হরণের উপর সিদ্ধি প্রতিষ্ঠিত। |
” |
লক্ষ্মী
লক্ষ্মী শ্রী, সমৃদ্ধি, বিকাশ ও অভ্যুদয়ের প্রতীক। শুধু ধনৈশ্বর্যই নয়, লক্ষ্মী চরিত্রধনেরও প্রতীক। স্বামী নির্মলানন্দের ভাষায়,
" |
ধন, জ্ঞান ও শীল – তিনেরই
মহনীয় বিকাশ দেবী লক্ষ্মীর চরিত্রমাহাত্ম্যে। সর্বাত্মক বিকাশের
অধিষ্ঠাত্রী দেবতা বলেই তিনি কমলা। কমল বা পদ্মের ন্যায়ই তিনি সুন্দরী;
তদীয় নেত্রদ্বয় পদ্মের ন্যায় আয়ত। তাঁর শুভ করে প্রস্ফুটিত পদ্মকুসুম;
পদ্মবনেই তাঁর বসতি। |
” |
মহানামব্রত ব্রহ্মচারী অন্যদিকে সমুদ্রমন্থনে সমুদ্ভূতা দেবী লক্ষ্মীর মূর্তিতত্ত্বের অপর এক ব্যাখ্যাও দিয়েছেন,
" |
যাঁহারা বিচক্ষণ তাঁহারা
ভূমি-প্রকৃতি কর্ষণ করিয়া শস্যধন আহরণ করেন, বন-প্রকৃতি অনুসন্ধান করিয়া
ধন আহরণ করেন। খনি প্রকৃতি খনন করিয়া স্বর্ণধন সংগ্রহ করেন। এই সকলই
সাগরমন্থন। ... এই সকল সাগর-মন্থনে ধনাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীর আবির্ভাব। |
” |
পেচক
মধ্য কলকাতার মহম্মদ আলি পার্কের দুর্গাপ্রতিমায় নারীজাগরণের বার্তা, চালচিত্রে বাংলা তথা ভারতের মহীয়সী নারীগণ, ২০০৭
লক্ষ্মীর বাহন পেচক বা প্যাঁচা। রূপে ও গুণে অতুলনীয় এই দেবীর এমন
কিম্ভূত বাহন কেন, সে নিয়ে বেশ কয়েকটি মত প্রচলিত। প্রথমেই স্মরণে রাখা
কর্তব্য, হিন্দু শাস্ত্রে কোথাও পেচককে লক্ষ্মীর বাহনের মর্যাদা দান করা
হয়নি। এই বিশ্বাস একান্তই বাঙালি লোকবিশ্বাস।
প্যাঁচা দিবান্ধ। মনে করা হয়, যাঁরা দিবান্ধ অর্থাৎ তত্ত্ববিষয়ে অজ্ঞ,
তাঁরাই পেচকধর্মী। মানুষ যতকাল পেচকধর্মী থাকে ততদিনই ঐশ্বর্যের দেবী
লক্ষ্মীর আরাধনা করে সে। মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর মতে,
" |
পেচক মুক্তিকামী সাধককে বলে,
সকলে যখন ঘুমায় তুমি আমার মতো জাগিয়া থাকো। আর সকলে যখন জাগ্রত তখন তুমি
আমার মতো ঘুমাইতে শিখ, তবেই সাধনে সিদ্ধি। কৈবল্যধন লাভ।
পরমার্থধনাভিলাষী সাধক পেঁচার মতো রাত্রি জাগিয়া সাধন করে। লোকচক্ষুর
অন্তরালে নির্জনে থাকে। লক্ষ্মীমার বাহন রূপে আসন লইয়া পেচকের যে ভাষণ
তাহা বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন প্রকার সাধকের উপাদেয় সম্পদ।
|
” |
সরস্বতী
দক্ষিণ কলকাতার ম্যাডক্স স্কোয়ারের দুর্গাপূজা, ২০০৫
সরস্বতী বাণীরূপিণী বাগদেবী; তিনি জ্ঞানশক্তির প্রতীক।
" |
দেবীর হাতে পুস্তক ও বীণা।
পুস্তক বেদ শব্দব্রহ্ম। বীণা সুরছন্দের প্রতীক নাদব্রহ্ম। শুদ্ধ
সত্ত্বগুণের পূর্তি, তাই সর্বশুক্লা। শ্বেতবর্ণটি প্রকাশাত্মক। সরস্বতী
শুদ্ধ জ্ঞানময়ী প্রকাশস্বরূপা। জ্ঞানের সাধক হইতে হইলে সাধককে হইতে হইবে
দেহে মনে প্রাণে শুভ্র-শুচি। |
” |
হংস
সরস্বতীর বাহন হংস। হংস হিন্দুদের নিকট একটি পবিত্র প্রতীক।
" |
সরস্বতী-ব্রহ্মবিদ্যা। যে সাধক
দিবারাত্র অজপা মন্ত্রে সিদ্ধ তিনিই হংসধর্মী। মানুষ সুস্থ শরীরে
দিবারাত্র মধ্যে একুশ হাজার ছয়শত ‘হংস’ এই অজপা মন্ত্রজপরূপে
শ্বাস-প্রশ্বাস করিয়া থাকে। মানুষ যতদিন এই স্বাভাবিক জপ উপলব্ধি করিতে না
পারে, ততদিন ‘হংসধর্মী’ হইতে পারে না; সুতরাং ব্রহ্মবিদ্যারও সন্ধান পায়
না। |
” |
কার্তিকেয়
বেহালার জিতেন্দ্র স্মৃতি সংঘের জৌলুশপূর্ণ দেবীপ্রতিমা, ২০০৭
দেবসেনাপতি কার্তিকেয় বা কার্তিক সৌন্দর্য ও শৌর্যবীর্যের প্রতীক।
" |
যুদ্ধে শৌর্য-বীর্য প্রদর্শন
একান্ত প্রয়োজনীয়। তাই সাধক-জীবনে এবং ব্যবহারিক জীবনে কার্তিকেয়কে
প্রসন্ন করতে পারলে শৌর্য-বীর্য আমাদের করতলগত হয়... |
” |
ময়ূর
কার্তিকেয়ের বাহন ময়ূর। সৌন্দর্য ও শৌর্য – কার্তিকেয়ের এই দুই বৈশিষ্ট্যই তাঁর বাহন ময়ূরের মধ্যে বিদ্যমান। সবাইকে ধন্যবাদ
|