হিন্দুধর্মে অবতার (সংস্কৃত: अवतार, avatāra; আক্ষরিক অর্থে অবতরণকারী) বলতে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে স্বেচ্ছায় মর্ত্যে অবতীর্ণ পরম সত্ত্বাকে বোঝায়।
কেবলমাত্র পরম সত্ত্বা বা পরমেশ্বরের অবতারগুলিই ধর্মানুশীলনের ক্ষেত্রে
গুরুত্বপূর্ণ। এই সকল অবতার সর্বজনশ্রদ্ধেয় ও অতিলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন।
অন্যান্য অবতারগুলি ঈশ্বরের গৌণ সত্ত্বার রূপ অথবা কোনো গৌণ দেবদেবীর অবতার। এই শব্দটি হিন্দুধর্মে মূলত বিষ্ণুর অবতারদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। হিন্দুধর্মের অন্যতম বৃহৎ শাখা বৈষ্ণবধর্মে এই সকল অবতারের পূজার বিধান রয়েছে। বৈষ্ণবরা বিষ্ণুর দশাবতারকে পরমেশ্বরের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যরূপে কল্পনা করেন। পুরাণে শিব ও গণেশের অবতারের কথাও পাওয়া যায়। গণেশ পুরাণ ও মুদগল পুরাণ-এ
গণেশের অবতারসমূহের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। তবে এই সকল অবতারের তুলনায়
হিন্দুধর্মে বিষ্ণুর অবতারগণের গুরুত্ব অধিক। অনেক ক্ষেত্রেই অন্যান্য
অবতারগুলি বৈষ্ণব শাস্ত্রের বর্ণিত অবতারদের অনুসরণে কল্পিত হয়ে থাকে।
বিষ্ণুর অবতার
হিন্দুধর্মে অবতারবাদ মূলত বিষ্ণুকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। বিষ্ণু ত্রিমূর্তির অন্যতম দেবতা ও হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী জগতের পালক ও রক্ষাকর্তা।
দশাবতার : গরুড় পুরাণ মতে বিষ্ণুর দশ অবতার
বিষ্ণুর দশ সর্বাধিক প্রসিদ্ধ অবতার দশাবতার নামে পরিচিত। দশাবতারের তালিকাটি পাওয়া যায় গরুড় পুরাণ গ্রন্থে। এই দশ অবতারই মানব সমাজে তাঁদের প্রভাবের ভিত্তিতে সর্বাপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য হন।
দশাবতারের প্রথম চার জন অবতীর্ণ হয়েছিলেন সত্যযুগে। পরবর্তী তিন অবতারের আবির্ভাব ত্রেতাযুগে। অষ্টম অবতার দ্বাপরযুগে এবং নবম অবতার কলিযুগে অবতীর্ণ হন। পুরাণ অনুসারে, দশম অবতার এখনো অবতীর্ণ হননি। তিনি ৪২৭,০০০ বছর পর কলিযুগের শেষ পর্বে অবতীর্ণ হবেন।
গরুড় পুরাণ অনুসারে বিষ্ণুর দশ অবতার হলেন:
- ১. মৎস্য, মাছের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
- ২. কূর্ম, কচ্ছপের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
- ৩. বরাহ, শূকরের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
- ৪. নরসিংহ, অর্ধনরসিংহ রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
- ৫. বামন, বামনের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ
- ৬. পরশুরাম, পরশু অর্থাৎ কুঠারধারী রামের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ
- ৭. রাম, রামচন্দ্র, অযোধ্যার রাজপুত্রের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ
- ৮. কৃষ্ণ, দ্বাপরযুগে ভ্রাতা বলরামের সঙ্গে অবতীর্ণ।
- ৯. বুদ্ধ, কলিযুগে অবতীর্ণ হন।
- ১০. কল্কি, সর্বশেষ অবতার। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, কলিযুগের অন্তে তাঁর আবির্ভাব ঘটবে।
ভাগবত পুরাণ অনুসারে বলরাম শেষনাগের অবতার। কোনো কোনো বৈষ্ণব শাস্ত্রে তাঁকে বিষ্ণুর নবম অবতার মনে করা হয়। উল্লেখ্য, এই সকল গ্রন্থে বুদ্ধের কোনো উল্লেখ নেই।
ভাগবত পুরাণ মতে বিষ্ণুর অবতার
ভাগবত পুরাণ–এর প্রথম স্কন্দে সংখ্যাক্রম অনুসারে বিষ্ণুর যে বাইশ অবতারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা নিম্নরূপ:
- ১. চতুর্সন [ভাগবত ১।৩।৬] (ব্রহ্মার চার পুত্র)
- ২. বরাহ [ভাগবত ১।৩।৭] (বন্য শূকর)
- ৩. নারদ [ভাগবত ১।৩।৮] (ভ্রাম্যমান ঋষি)
- ৪. নর-নারায়ণ [ভাগবত ১।৩।৯] (যমজ)
- ৫. কপিল [ভাগবত ১।৩।১০] (দার্শনিক)
- ৬. দত্তাত্রেয় [ভাগবত ১।৩।১১] (ত্রিমূর্তির যুগ্ম অবতার)
- ৭. যজ্ঞ [ভাগবত ১।৩।১২] (সাময়িকভাবে ইন্দ্রের ভূমিকা গ্রহণ করা বিষ্ণু)
- ৮. ঋষভ [ভাগবত ১।৩।১৩] (রাজা ভরত ও বাহুবলীর পিতা)
- ৯. পৃথু [ভাগবত ১।৩।১৪] (যে রাজা পৃথিবীকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন)
- ১০. মৎস্য [ভাগবত ১।৩।১৫] (মাছ)
- ১১. কূর্ম [ভাগবত ১।৩।১৬] (কচ্ছপ)
- ১২. ধন্বন্তরী [ভাগবত ১।৩।১৭] (আয়ুর্বেদের জনক)
- ১৩. মোহিনী [ভাগবত ১।৩।১৭] (সুন্দরী নারী)
- ১৪. নৃসিংহ [ভাগবত ১।৩।১৮] (নর-সিংহ)
- ১৫. বামন [ভাগবত ১।৩।১৯] (খর্বকায়)
- ১৬. পরশুরাম [ভাগবত ১।৩।২০] (পরশু অর্থাৎ কুঠার সহ রাম)
- ১৭. ব্যাসদেব [ভাগবত ১।৩।২১] (বেদ সংকলক)
- ১৮. রাম [ভাগবত ১।৩।২২] (অযোধ্যার রাজা)
- ১৯. বলরাম [ভাগবত ১।৩।২৩] (কৃষ্ণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা)
- ২০. কৃষ্ণ [ভাগবত ১।৩।২৩] (রাখাল বা স্বয়ং ভগবান)
- ২১. বুদ্ধ [ভাগবত ১।৩।২৪] (জ্ঞানী)
- ২২. কল্কি [ভাগবত ১।৩।২৫] (ধ্বংসকারী)
এই বাইশ অবতার ছাড়াও উক্ত গ্রন্থের পরবর্তী অংশে আরও তিন অবতারের কথা আছে:
- ১. প্রশ্নিগর্ভ [ভাগবত ১।৩।৪১] (প্রশ্নির সন্তান)
- ২. হয়গ্রীব [ভাগবত ২।৭।১১] (অশ্ব)
- ১. হংস [ভাগবত ১১।১৩।১৯] (রাজহংস)
কল্কি অবতারের বর্ণনা দেওয়ার পর ভাগবত পুরাণ–এ ঘোষিত হয়েছে, বিষ্ণুর অবতার অসংখ্য। যদিও উপরি উল্লিখিত পঁচিশ অবতারের গুরুত্বই সর্বাধিক।
ভাগবত পুরাণ–এর একটি শ্লোক, মহাভারত-এর কতকাংশ এবং অন্যান্য পৌরাণিক ধর্মগ্রন্থের মতে, চৈতন্য মহাপ্রভু হলেন বিষ্ণুর অন্যতম অবতার। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ঐতিহ্য অনুসারে তাঁকে অবতার রূপে পূজা করার বিধান রয়েছে। এই কারণেই চৈতন্য মহাপ্রভুকে গৌরাঙ্গ অবতার নামে অভিহিত করা হয়।
বৈষ্ণবধর্মে অন্যান্য অবতার
পুরুষ অবতার
অনেক সময় নিম্নোক্ত পুরুষ অবতারদের মহাবিশ্বে বিষ্ণু বা কৃষ্ণের প্রকৃত অবতার বলে গণ্য করা হয়:
গুণ অবতার
- মূল নিবন্ধ: ত্রিমূর্তি
হিন্দু ত্রয়ী দেবতা ত্রিমূর্তি অনেক সময় গুণ অবতার নামে অভিহিত হয়ে থাকেন। এর কারণ তাঁদের প্রকৃতির এক-একটি গুণের নিয়ন্ত্রক রূপে কল্পনা করা হয়। যদিও তাঁরা কখনই জীবের রূপ ধারণ করে মর্ত্যে অবতীর্ণ হন না, তবুও তাঁদের অভিধার সঙ্গে অবতার কথাটি যুক্ত করা হয়:
মন্বন্তর অবতার
মন্বন্তর অবতারগণ বিশ্বজুড়ে বংশধর উৎপাদনের জন্য দায়ী। তাঁরা সংখ্যায় অসংখ্য এবং তাঁদের কোনোপ্রকার জন্মগ্রহণ নেই।
শাক্ত্যাবেস ও অবেস অবতার
অবতারদের দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়:
যখন বিষ্ণু স্বয়ং অবতীর্ণ হন, তখন তাকে সাক্ষাৎ বা শাক্ত্যবেসাবতার বলা
হয়। কিন্তু যখন তিনি নিজে অবতীর্ণ না হয়ে কারোর মাধ্যমে প্রকাশিত হন,
তখন তাকে বলা হয় অবেস অবতার।
মনে করা হয়, অবেস অবতারের সংখ্যা অনেক। বিশিষ্ট অবেস অবতার হলেন নারদ, শাক্যমুণি বুদ্ধ ও পরশুরাম। পরশুরামই প্রসিদ্ধ দশাবতারের অন্যতম যিনি প্রত্যক্ষভাবে বিষ্ণুর অংশসম্ভূত নন।
হিন্দুধর্মের শ্রী বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মতে প্রধান ও প্রত্যক্ষ অবতারদের দুটি শ্রেণি, পূর্ণ অবতার ও অংশরূপাবতার:
- পূর্ণ অবতার সেইগুলিই যেগুলির ক্ষেত্রে বিষ্ণু প্রত্যক্ষভাবে অবতীর্ণ হন এবং ঈশ্বরের সকল শক্তি ও গুণাবলি প্রদর্শন করেন। (যেমন, নৃসিংহ, রাম ও কৃষ্ণ)
- অংশরূপাবতারের ক্ষেত্রেও বিষ্ণু প্রত্যক্ষভাবে অবতীর্ণ হন, কিন্তু তিনি আংশিকভাবে সেই রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। (যেমন, মৎস্য ও পরশুরাম)।
অবেস অবতারগণ পরমেশ্বর রূপে পূজিত হন না। কেবলমাত্র প্রত্যক্ষ ও প্রধান
অবতারগণই ওইরূপে পূজিত হন। প্রকৃতপক্ষে যে সকল প্রত্যক্ষ অবতার আজ পূজিত হন
তাঁরা হলেন পূর্ণ অবতার নৃসিংহ, রাম ও কৃষ্ণ। অধিকাংশ বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মতে, কৃষ্ণ হলেন সর্বোচ্চ পূর্ণ অবতার। যদিও ইসকন সহ চৈতন্য মহাপ্রভু, নিম্বার্ক ও বল্লভ আচার্যের অনুগামীদের দার্শনিক মত রামানুজাচার্য ও মাধবাচার্যের
মতো অপরাপর বৈষ্ণবদের থেকে পৃথক। তাঁরা কেবল কৃষ্ণকে অবতার বলেই মানেন না,
তাঁকে সর্বোচ্চ ঈশ্বর মনে করেন। তবে সকল হিন্দুই বিশ্বাস করেন বিষ্ণু ও তাঁর অবতারদের পূজার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কারণ সকলেই বিষ্ণুর সঙ্গে সংযুক্ত। দ্বৈত দর্শনের প্রবক্তা মাধবাচার্যের মতে, বিষ্ণুর সকল অবতার শক্তি ও অন্যান্য গুণে একে অপরের সমান। তাঁদের উচ্চনিচ ক্রম নেই। তাঁদের মধ্যে ভেদবুদ্ধি করা মহাপাপ।
অবতারত্ব দাবিদার
পুরাণ-বর্ণিত অবতারগণের পাশাপাশি ভারতে অনেক ব্যক্তি নিজের বা তাঁদের গুরুদের অবতারত্বও দাবি করেন। এই রকম কয়েকটি উদাহরণ হল:
|