সনাতন ধর্ম হিন্দু ধর্ম নামে মধ্য যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত পরিচিত হয়েছে। এই হিন্দু নামটি এসেছে বিদেশীদের কাছ থেকে আর তারপরে সনাতন ধর্মের অনুসারীরা হিন্দু নামেই সর্বত্র পরিচিত। সনাতন ধর্মকে বৈদিক ধর্মও বলা হয়।আজকের লেখার মূল উদ্দেশ্য হল সনাতন ধর্ম সম্পর্কে সাধারণ ধারণা দেওয়া। আমি দেখেছি বিভিন্ন জায়গায় অনেকেই সনাতন ধর্ম সম্পর্কে উক্তি করেন এবং ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করেন। আমি অন্য কোন ধর্মমত নিয়ে আলোচনা করবনা আর সেটা আমি পছন্দও করিনা। আমি মনে করি সবাই যেহেতু মিলেমিশে আছি সেহেতু সবার ব্যাপারে একটু ধারণা থাকা প্রয়োজন। আমি সব ধর্ম সম্পর্কেই জানার চেষ্টা করেছি, জেনেছি- এর মাঝে ঋণাত্বক দৃষ্টিভঙ্গির কিছু নেই। আর্যদেরকে নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত আছে। যে কেউ চাইলেই যেকোন মতবাদ দিতে পারে। আমি সেদিকে যাবনা। আমি শুধু বলব সনাতন ধর্ম তখন থেকেও ছিল যেখানে ইতিহাসবিদদের ইতিহাস কুয়াশাচ্ছন্ন।
যে বিষয় নিয়ে সবার মনে প্রশ্ন জাগে তা হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কি একেশ্বরবাদী? আমি বিভিন্ন জায়গায় দেখেছি, এমনকি ইন্টারনেটেও দেখেছি অনেকেই বহু ঈশ্বরবাদী ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যারা এমন করেছে তারা বিস্তারিত না জেনেই করেছে। হিন্দুধর্ম একেশ্বরবাদী ধর্ম। "একেমাবাদ্বিতীয়ম”- আমি এক এবং অদ্বিতীয়, এ উক্তির মাধ্যমেই সব কিছু পরিস্কার করে দেওয়া।
এখন আসা যাক দেব-দেবী প্রসঙ্গে। দেব-দেবী সম্পর্কে হিন্দু ধর্মে বলা হয়েছে দেব-দেবীরা হচ্ছেন ঈশ্বরের শক্তির প্রকাশ। দেব শব্দকে বিশ্লেষণ করলে অর্থ পাওয়া যায়- যিনি দান করেন। যেমন- বিদ্যা শক্তির অধিষ্ঠাত্রী হচ্ছেন দেবী স্বরস্বতী। বিদ্যালাভের জন্য ভক্তরা স্বরস্বতীর উপাসনা করে। স্বরস্বতীর উপাসনা ঈশ্বরেরই উপাসনা তবে একটি নির্দিষ্ট অনুগ্রহ লাভের জন্য ঈশ্বরের নির্দিষ্ট শক্তির উপাসনা। ইংরেজীতে ঈশ্বরকে বলা হয় God, আবার দেবতা বুঝাতে বলা হয় god, বানানে-উচ্চারণে পার্থক্য না থাকায় বর্তমান প্রজন্মের মাথায় ভুল ধারণা জন্মে। দেব-দেবীর পূজা সনাতন ধর্মে প্রচলিত- এ রীতি নিষিদ্ধও নয় আবার দেব-দেবীর পূজাকে পরম মাহাত্ম্যও দেওয়া হয়নি। ধর্মগ্রন্থ গীতায় বলা হয়েছে- কামনার বশবর্তী হয়ে মানুষ দেবতার পূজা করে, তারা তাদের অভিষ্ট প্রাপ্ত হয়, তাদের সেই অভিষ্ট পরম ব্রহ্ম প্রদান করেন, কিন্তু দেব ভক্তরা কখনও পরম ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হয়না। গীতায় আবার বলা হয়েছে- যে যেভাবেই ঈশ্বরের ভজনা করুক না কেন সে সেভাবেই তার অভিষ্ট লাভ করে- কোন না কোন ভাবেই সে সর্বদা ঈশ্বরের পথেই পরিচালিত হবে।
এখন আসা যাক প্রতীমা পূজা প্রসঙ্গে। আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেছে তোমরা মাটি দিয়ে প্রতীমা বানাও তারপর পূজা কর, আবার ফেলেও দাও। প্রথমে সনাতন ধর্মে প্রতীমা পূজা ছিলনা। তখন যজ্ঞের মাধ্যমে ধর্ম কার্য সম্পন্ন হত।পরবর্তিতে প্রতীমা পূজা প্রচলিত হয়। মানব মন অতি চঞ্চল, সর্বদা কোন না কোন দিকে বিক্ষিপ্ত হয়। প্রার্থনা করতে বসলেই পৃথিবীর সমস্ত চিন্তা মাথায় আসে। আমার নিজের কথাই বলি। আমি যখন কোন ছায়াছবি বসে দেখি- একাগ্রচিত্তে বসে দেখি, বাহিরের কোন চিন্তাই মাথায় আসেনা। কিন্তু যখনই প্রার্থনায় বসি- কোথা থেকে জানি বিভিন্ন চিন্তা চলে আসে, একাগ্রচিত্তে প্রার্থনা করতে পারিনা। এমনকি আমি মনকে জোরপূর্বক দমন করতে চেষ্টা করেও পারিনি। জানিনা- সবার ক্ষেত্রে এমন হয় কি না। এ সমস্যা সমাধানের জন্য নিম্ন সারির ভক্তদের জন্য প্রতীমা পূজার প্রচলন। যারা উচ্চ সারির ভক্ত- মানে যারা মনকে, ইন্দ্রীয়কে দমন করতে পারেন- তাদের জন্য প্রতীমা পূজার প্রয়োজন হয়না। পূজার সময় ভক্তরা প্রতীমার মাঝেই আরাধ্যকে দেখে একাগ্রচিত্তে উপাসনা করে। প্রতীমা পূজাও শাস্ত্র নির্দেশিত, বিভিন্ন দেবতার বিভিন্ন রকমের প্রতীমা, তাও শাস্ত্র নির্দেশিত। ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যায়- আপনারা কেউ যদি আমার ছবি দেখেন তাহলে আমার কথাই মনে করবেন- তবে আমি কিন্তু সেই ছবি নই। তেমনি প্রতীমার মাধ্যমে ভক্তের মনে ভক্তির ভাব জাগ্রত হয়, সেই ভক্তি ঈশ্বরের দরবারে পৌঁছে যায়- প্রতীমা এখানে ভক্তির উপকরণ মাত্র।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগবে- আমি একবার ঈশ্বর বলছি, আরেকবার ব্রহ্ম বলছি, কেউ ভগবান বলে- এর কারণ কি? জগতের পরম কারণ, পরম সত্যকে, পরম শক্তিকে বলা হয় ব্রহ্ম বা পরম ব্রহ্ম। ব্রহ্মের আবার দুই স্বরুপ। সগুণ ব্রহ্ম ও নিরগুণ ব্রহ্ম। নির্গুণ ব্রহ্ম সমস্ত গুণের অতীত। নিরগুণ ব্রহ্মের স্বরুপ অনেক কঠিন- আমি বুঝলেও বুঝানোর ক্ষমতা আমার নেই। সগুণ ব্রহ্ম সকল স্বর্গীয় গুণের অধিকারী। সগুণ ব্রহ্মকে ঈশ্বর বলা হয়, সৃষ্টিকর্তা বলা হয়, সর্বব্যাপী বলা হয়। ঈশ্বর শব্দের অর্থ হচ্ছে সর্বশক্তিমান।ব্রহ্ম শব্দের কোন লিঙ্গান্তর নেই, ব্রহ্ম সবকিছুর পরম কারণ, পরম সত্য। ঈশ্বরকে মাতৃরূপে ঈশ্বরীও বলা হয়। ভগবান- ছয়টি স্বর্গীয় গুণের অধিকারী হলে তাকে ভগবান বলা হয়। সকল গুণের অধিকারী ঈশ্বরকেও ভগবান বলা হয়। আবার শাস্ত্রে দেখা যাবে অনেক মুনি-ঋষিদেরকেও ভগবান বলা হচ্ছে। ছয়টি গুণ কোন মানুষ অর্জন করতে পারলে তাকেও ভগবান বলা যাবে।
সনাতন ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হচ্ছে বেদ। বেদ অর্থ জ্ঞান। বেদ অপৌরুষেয়- মানে বেদকে কোন মানুষ সৃষ্টি করেনি। ধ্যানের মাধ্যমে ঋষিগণ পরম ব্রহ্মের সত্যকে দর্শন করেছেন। সেই সত্যকে অন্তঃস্থ করেছেন। ঋষিরা বেদের দ্রষ্টা মাত্র, স্রষ্টা নন। গুরুর কাছ থেকে শিষ্যরা বেদ শুনে শুনে মনে রাখত- তাই বেদকে শ্রুতিও বলা হয়। বেদ- জ্ঞানের পরিসীমা অসীম কারণ এ জ্ঞান পরম ব্রহ্ম হতে প্রাপ্ত। সারা জীবন বেদ নিয়ে শিক্ষার্জন করার পর এক পরম বিদ্বানকে বলা হয়েছিল- বেদ যদি বিশাল পর্বত হয়, তুমি সেখান থেকে এক মুঠো ধূলি পরিমান জ্ঞান লাভ করেছ। শ্রীমদ্ভাগবদ গীতা হচ্ছে বেদের সার-সংক্ষেপ। পরম ব্রহ্মের অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সহজভাবে বেদ-জ্ঞানকে গীত করেছেন। তাই সনাতন সমাজে এখন গীতাই সর্বাধিক প্রিয়।
অবতার শব্দ নিয়েও অনেকের প্রশ্ন জাগতে পারে। শাস্ত্রে বলা আছে- পৃথিবীতে যখনই অধর্ম বেড়ে যাবে তখন ঈশ্বর পৃথিবীতে আবীর্ভূত হবেন। ঈশ্বর ধরাধামে অবতরণ করেন বলে তাঁকে অবতার বলা হয়। যেমন- মৎস্য অবতার, কুর্ম অবতার, বরাহ অবাতর, রাম অবতার, কৃষ্ণ অবতার, অবতার বুদ্ধ, কল্কি অবতার………………।
শাস্ত্রগ্রন্থের মাঝে আবার দুই ভাগ। শ্রুতি ও স্মৃতি। শ্রুতি হচ্ছে বেদ। এ শাস্ত্র সর্বদা অপরিবর্তিত থাকবে- বেদ কখনই পরিবর্তিত হবেনা- পরম ব্রহ্মের পরম জ্ঞান সর্বাদাই ধ্রুব। শ্রুতিতে পার্থিব বিষয়ের সাথে আছে পরমার্থিক বিষয়ের জ্ঞান। স্মৃতিশাস্ত্র পরিবর্তনশীল তবে সেই পরিবর্তন বেদের অধীন। সময়ের সাথে সাথে লোকাচার, খাদ্যাভাস, সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি- পারিপার্শ্বিকতার ভিত্তিতে জগতের কল্যাণের নিমিত্তে পরিবর্তন করা হয়। শাস্ত্রজ্ঞ মহাপুরুষগণ যুগে যুগেই কল্যাণের পথ দেখিয়ে যান। সমাজে সমস্যা দেখা দেয় যখন পণ্ডিতগণ প্রাচীন স্মৃতিশাস্ত্রের আলোকে বর্তমানকে বিচার করেন।প্রাচীন অনেক রীতিনীতি এখন পরিবর্তিত। শ্রী চৈতন্যদেব, শ্রীরামকৃষ্ণের প্রমুখ প্রদর্শিত নিয়মই হচ্ছে বর্তমান স্মৃতিশাস্ত্র।
প্রত্যেক ধর্মমতকেই সনাতন ধর্ম সত্য ও পরম ব্রহ্মের প্রদর্শিত পথ বলেই মান্য করে। মহাপুরুশ শ্রীরামকৃষ্ণ বলে গেছেন- যত মত তত পথ। শাস্ত্রে সবাইকে উদার হতে বলা হয়েছে। উদার চরত্রের অধিকারীকে ঈশ্বরের আত্মীয় মানে পরম ভক্ত বলা হয়েছে।
অনেক সুন্দর একটা লেখা পড়লাম, অনেক গুছিয়ে লিখেছেন দাদা। আসলে সনাতন ধর্ম নিয়ে যতটুকু বুঝি ততটুকু বুঝানোর সামর্থ্য আমাদের কারো নেই, আপনি একটু খেয়াল করে দেখবেন আপনার এতটুকু লেখার মাঝেই কতগুলো তত্ব এসেছে এর সম্পর্কে ধারণা না থাকলে সহজে কেউ এগুলো বুঝবেনা, যেমনটা লিখেছেন ছয়টি গুণ কোন মানুষ অর্জন করতে পারলে তাকেও ভগবান বলা যাবে। এটা অনেকটা অদ্বৈতবাদ এর সাথে মিলে এখন কেউ যদি বলে শ্রীরামকৃষ্ণ কে ঈশ্বরজ্ঞানে ভক্তি করবো অনেক হিন্দু ও ঠিক মেনে নিতে পারবে না। কারণ তার জ্ঞান এর সল্পতা। এরকম অনেক অনেক তত্ব যার কোনো শেষ নাই, এটা এমন একটা ধর্ম, ঝীবনব্যবস্থা যা দিনে দিনে সমৃদ্ধ হয়ছে শুধু। আপনার পোষ্ট টা সনাতন ধর্ম সম্পর্কে মূল ধারণা পেতে অনেক সহায়ক হবে। সামনে এরকম আরো পাবো আশা করি। ধন্যবাদ দাদা। ভালো থাকবেন।