আমার
ব্লগ নামক একটি ব্লগ সাইটে নেত্রকোনার গৌরাঙ্গর আত্মহত্যার ঘটনাটি নিয়ে
একটি পোস্ট এসেছে। আগ্রহীরা তা নিচে দেয়া লিংক থেকে পড়ে দেখতে পারেন।
সেখানে নানাজনে নানারকম মন্তব্যও করেছে।
পোস্টটি লিখেছেন: রাসেল
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থানার গ্রাম ছোটোহাতিমী, সেখানে থাকতেন গৌরাঙ্গ সরকার। তিনি আত্মহত্যা করেছেন ৪ঠা জুন। এক সপ্তাহ আগে।
তিনি
ভুমিহীনদের নেতা ছিলেন, তার নেতৃত্বেই ছয় একর ভুমিতে ফসল ফলিয়ে জীবিকা
নির্বাহ করতো ৮৫টি পরিবার। বাংলাদেশে তাদের পরিচয় সংখ্যালঘু। শুধু
সংখ্যালঘু বললে এদের লঘুত্ব প্রকাশিত হয় না ঠিক ভাবে, তারা যেকোনো বিচারেই
সংখ্যালঘু, যাদের রাষ্ট্রীয় পরিচয় পত্র আছে, যারা প্রতি বছর ভোটের মচ্ছবে
ভোট দিতে যান, তাদের এক একটা ভোটে নির্বাচিত হয় বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিগণ,
তারাই রাষ্ট্রকে দিকনির্দেশনা দেন, তারাই রাষ্ট্রীয় আইন নির্মাণ করেন।
অবশ্য আইন এক ধরণের বুজরুকি সংখ্যালঘুদের জন্য। তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর
নাগরিকত্ব নিয়ে অবহেলিত বাংলাদেশে। তাদের জন্মভুমিতে, যেখানে তাদের ১৪
পুরুষের বাস।
তাদের ভোটে সংবিধানে ধারা যোগ-বিয়োগ হয়ে যায় না,
তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংসদে দাঁড়িয়ে উৎকট রসিকতা, রঙ্গ-বিলাসিতা
এবং অশ্লীলতার চর্চা করেন। ওয়াক আউট- ওয়াক ইন খেলা খেলেন নিয়মিত। এবং এইসব
নির্বাক ভোটারদের কথা কিংবা দাবি তাদের কানে পৌঁছায় না।
বাংলাদেশে
স্থানীয় প্রশাসনের নামে যা চলমান, সেটাকে আরও হাস্যকর করে তুলেছে আশরাফুল
হক, তিনি উপজেলা এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাংসদের অনুগ্রহভাজন করেছেন
সম্প্রতি এবং সাংসদেরা বিপুল ভোটে এটাকে সমর্থন দিয়েছে। সুতরাং সাংসদদের
নেক নজর থাকলে অনেক অপরাধ করেও পার পাওয়া সম্ভব।
স্থানীয় উপজেলা,
থানা, সালিশ এবং এ জাতীয় যত রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ন্যায়প্রতিষ্ঠাকেন্দ্র
রয়েছে সব খানেই তারা অবহেলিত। এবং তাদের আর্তি শুনবার কেউ নেই কোথাও।
ছোটোহাতিমি গ্রামে কি ঘটেছিলো ৩রা জুন ২০০৯-
স্থানীয়
মোহনগঞ্জ কলেজের শিক্ষক রফিকুল হক- যিনি স্থানীয় ভাবে প্রফেসর নামে
পরিচিত- তার নেতৃত্বে একদল মানুষ এসে ভুমিহীনদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া ৬ একর
খাস জমির ফসল কেটে নিয়ে যায়- এইসব সংখ্যালঘুকে হুমকি দেওয়া হয় যদি থানায়
মামলা সব সব কটা মানুষের লাশ ফেলে দেওয়া হবে, তাদের বাস্তুচ্যুত করা হবে,
তাদের উচ্ছেদ করা হবে- এবং এইসব ভুমিহীন মানুষদের অঘোষিত নেতা ছিলেন
গৌরাঙ্গ সরকার।
তিনি আশ্বাস দেন বিষয়টা মীমাংসা হবে, তবে তিনি
থানায় মামলা দিতে গেলে পুলিশ রাজী হয় নি মামলা আমলে আনতে- তিনি হুমকি ও
অপমান মাথায় নিয়ে ঘুরেছেন সারা দিন, পরের দিন যতটা সম্ভব চেষ্টা করেছেন
এইসব ভুমিহীন মানুষদের শেষ সম্বল জমির ফসল ফিরিয়ে আনতে।
এইসব
মানুষের অন্য কোনো আয়ের উৎস নেই, তাদের খোরাকির চাল জন্মে এই ৬ একর জমিতেই,
সেই ফসল হারিয়ে তারাও বিপন্ন এবং তারাও চাইছিলো গৌরাঙ্গ সরকার- তাদের
অঘোষিত নেতা- তাদের কিছু আশার কথা শোনাবেন-
তা সম্ভব হয় নি।
গৌরাঙ্গ সরকার গভীর রাতে আত্মহত্যা করেন। তিনি পরাজিত হয়েছেন, নিজের
সন্তানকে পরাজয়ের অপমান জানিয়েছেন, তিনি নিঃশেষিত হয়ে নিজেকে খুন করেছেন।
যে লড়াইয়ে তার জিতবার কোনো ক্ষমতা ছিলো না, সে লড়াই একা একা লড়তে না পেরে
তিনি আত্মহত্যা করেছেন। এটা তেমন বড় কোনো সংবাদ ছিলো না। বিশাল বাংলার কোণে কোণে ক এমন অনেক হৃদয়বিদারক ঘটনাই ঘটে, সেসব আমরা পড়ি, কিংবা পড়ি না-
গৌরাঙ্গ
সরকারের জীবন যা ঘটাতে পারে নি, তার মৃত লাশ সে অসম্ভবকে সম্ভব করতে
পেরেছে। পুলিশ এসেছে সেই ছোটোহাতিমী গ্রামে, তারা আত্মহত্যাকে আমলে এনেছে,
তারা একজন অভিযুক্তকে আটক করেছে। তবে পুলিশের থানা কর্মকর্তা অবশ্য
অস্বীকার করেছেন তাদের দায়িত্ব অবহেলার কথা।
বাংলাদেশের প্রশাসন
এবং আইন অন্য যেকোনো দেশের মতোই অন্ধ এবং নিস্ক্রিয়, তাদের সক্রিয়তা
শুধুমাত্র ক্ষমতাবানদের তোষণে। তারা নিয়মিত ভক্তের মতো এ দায়িত্ব পালন
করেন। তাদের আনুগত্যের পারিশ্রমিক ও পারিতোষিকও তারা পান নিয়মিত। বাংলাদেশ
অপরাধে ছেয়ে গেলে তাদের পকেটে পয়সার জোয়ার বাড়ে।
রফিকুল হক বৃত্তান্ত-
রফিকুল
হক স্থানীয় বিএনপি নেতা ছিলেন, বর্তমানে তিনি আওয়ামী লিগের সাথেও ঘনিষ্ট
সম্পর্ক তৈরি করেছেন। বাংলাদেশে এমনটাই সত্য- অপরাধীর মুখ বদলায় না তার
রাজনৈতিক আনুগত্য বদলায় এবং রাজনৈতিক আনুগত্যের কারণে তারা অপরাধ করে পার
পেয়ে যান। তাকে পুলিশ খুঁজে পায় না, কিন্তু টিভি ক্যামেরা খুঁজে পায়
এবং তার সাক্ষাৎকার এবং বক্তব্য প্রচার করতে পারে- কি চমৎকার আমাদের অন্ধ
প্রশাসন।
তিনি বলেছেন ২০০৫ সালে একজনের কাছে তিনি খাস জমি কিনে
নেন। তবে এই জমি ভুমিহীনদের নামে বরাদ্দ দিয়েছিলো খোদ সরকার ১৯৯৭ সালে। এবং
যাদের নামে ভুমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিলো তারাও এ সংবাদ জানে না যে তাদের আয়
উপার্জন ও আহার্যের একমাত্র সম্বল একখন্ড খাস জমি কোনো অলৌকিক নির্দেশে
হাত বদল হয়েছে, এবং তাদের অবগত না করেই কোনো এক ব্যক্তি যে খাস জমিকে
নিজের সম্পত্তি বলে বেচে দিয়েছে রফিকুল হকের কাছে।
রফিকুল হক জমির
দলিল নিয়ে বসে আছেন, দলিলে পোর্চা থাকে, লেখা থাকে কবে কাকে সরকার কতটুকু
খাজনার বিনিময়ে এ জমির দখলিসত্ত্ব প্রদান করেছে। সেই দলিলে কোনো সংবাদ নেই
কবে বরাদ্দকৃত চারজনের কাছে ক্রয় করা হয়েছিলো এ খাস জমি।
রফিকুল
হক এ জমির দখল নিতে চেষ্টা করেছেন ২০০৫সালে। সে জমিতে চাষ করবার অপরাধে
একজন অনিল ঘোষের পা কেটে নিয়েছেন। এবং থানা সে মামলাও আমলে আনে নি। এজহার
থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে রফিকুল হকের নাম। রাজনৈতিক ক্ষমতা চমৎকার বর্ম।
সংখালঘুত্বের
পাপ অনেক। তারা নিষ্পেষণ ও সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ করে,তাদের দেশপ্রেমে
বিশাল একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন সব সময়ই জাগ্রত। তারা সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদী
হতে চাইলেও সংখ্যাগুরুরা তাদের এই প্রতিবাদকে বিদেশী ষড়যন্ত্র হিসবে
প্রমাণ করতে চায়। কিন্তু একজন অনিল ঘোষ তার পা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান। তার ৫
সদস্যের পরিবার বসতবাটি হারিয়ে ফেলে, তারা চিকিৎসার খরচ মেটাতে যে দেনা
করেছেন, সে দেনার দায়ে বসট ভিটা যায়, ক্ষুধার অন্ন যায়।
এসব ঘটনার স্বাভাবিক পরিণতি কি হতে পারে - পেটের অন্ন জোগাতে একজন নিজেকে বেচতে বাধ্য হয়- ক্ষুধার জ্বালা ভয়ংকর।
তাদের অন্ন নেই, জীবিকা নেই, ৩ সন্তানকে নিয়ে অসহায় এই পরিবার না পাচ্ছেন ন্যায় বিচার, না পেয়েছেন কোনো সহযোগিতা।
রফিকুল হককে থানা খুঁজে পায় না, তার পক্ষে সাফাই গাওয়ার মানুষের অভাব হয় না। শুধু রাষ্ট্রই এই করুণ আর্তি শুনতে পায় না। কি ঘটবে ছোটো হাতিমীতে?
সেখানে যেই ৮৫ পরিবার অপেক্ষা করছেন ন্যায় বিচারের তারা কি আদৌ ন্যায় বিচার পাবেন? গৌরাঙ্গ সরকারের আত্মহত্যার পরিণতি কি হবে?
আমি
জানি না। একজন গৌরাঙ্গ সরকার মরে গেলে রাষ্ট্রের একটা ভোট কমে, একজন
গৌরাঙ্গ সরকার মারা গেলে একজন মানুষ কমে যায় যারা ভুমিহীনদের পক্ষে লড়াই
করতে পারে। রাষ্ট্র প্রতিরোধ চায় না, রাষ্ট্র নির্বিঘ্নে শোষণ চালাতে চায়।
এই শোষণের স্বরুপ আমাদের চেনা- মুখগুলো আমাদের চেনা। এরাই ব্যবসায়িক
নেতা, এরাই রাজনৈতিক নেতা, এরাই সালিশের প্রধান বিচারক- এরাই দোররা মেরে
ধর্ষিতাকে রক্তাক্ত করছে- এরাই হিল্লা বিয়ের নামে সম্ভোগ করছে কাউকে
কাউকে- এই সম্পূর্ন চক্রটি পরস্পরের বন্ধু । তারা পরস্পরর স্বার্থ দেখে,
স্বার্থ উদ্ধার করতে এদের সহযোগী হয়ে উঠে প্রশাসন।
পুলিশ প্রয়োজনে অন্ধ হয়ে যায়, ক্যামেরা খুঁজে পেলেও পুলিশ খোঁজ পায় না তাদের। তবে তারা পুলিশের পকেটে ঠিক মতো বখরা গুণে দিতে পারেন।
গৌরাঙ্গের
মৃত্যুর প্রতিশোধ চাই না আমি । চাই রাষ্ট্রপ্রধান নিজে এসে ক্ষমা
প্রার্থনা করুক এই পরিবারগুলোর কাছে। রাষ্ট্রের প্রতিটা নাগরিককে একই রকম
নাগরিক সুবিধা ও আইনি সহায়তা দেওয়ার অঙ্গীকার, সংবিধানকে সমুন্নত রাখবার
অঙ্গীকার করেই তারা সাংসদ হয়েছেন। তারা ন্যায়পালক, তাদের এই অঙ্গীকার
রাখতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের ব্যর্থতার লজ্জা তারা স্বীকার করবেন।
তাদের অপরাধের জন্য নতজানু হয়ে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করবেন।
গৌরাঙ্গ
হয়তো ভুমিহীনদের খাস জমির অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারে নি, কিন্তু যদি
প্রশাসন সক্রিয় হয় তবে এই ৬ একর খাস জমি এবং এর উপরে নির্ভরশীল পরিবারগুলো
বাঁচবে। তাদের বাঁচাতে ব্যর্থ হয়ে গৌরাঙ্গ আত্মহত্যা করেছিলেন। সেই
আত্মহত্যার দায় সমান ভাবেই রাষ্ট্রের উপরে বর্তায়। রাষ্ট্র সেই দায়স্খলন
করবে এমন অলীক প্রত্যাশাই করতে পারি।
এটা একুশে টিভির একটি
প্রতিবেদন দেখে লেখা। প্রতিবেদনটি প্রচারিত হয়েছে আজ- অনুষ্ঠানের নাম
একুশের চোখ- কারো কাছে এর কোনো লিংক থাকলে সেটা সংযুক্ত করবার অনুরোধ
করছি।
বাংলাদেশ সবার প্রতি ন্যায় সঙ্গত আচরণ করে সভ্য দেশে পরিণত হোক।
মূল পোস্টের লিংক: আমার ব্লগ
|