২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে বিমান হামলাকে বলা হয় শতাব্দীর ভয়াবহতম সন্ত্রাসী হামলা। দুঃখিত এই হামলাকারীদের সন্ত্রাসী বললে ইনারা অবশ্য অসন্তুষ্ট হন। হওয়ারই কথা। যে উনিশজন বিমান ছিনতাই করে টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগন ভবনের উপর হামলে পড়েছিল তারা তো আর এমনি এমনি এমনটা করে নি। তারা করেছিল তাদের ধর্মের জন্য। তাদের স্রষ্টার মন জয় করার জন্য। তাদের সন্ত্রাসী বলে? এমন স্পর্ধা কে দেখায়? তারা সন্ত্রাসী নয়। তারা ধর্মের সৈনিক। তারা হল জিহাদি। আজ থেকে দশ বছর আগে একুশে টিভিতে ব্রেকিং নিউজ শুনলাম একটি যাত্রীবাহী বিমান নিউইয়র্কের একটি ভবনের ভিতর ঢুকে পড়েছে। তখনও পরিস্থিতি বুঝতে পারি নাই। যখন ঘটনার ভিডিও দেখলাম তখন বুঝতে পারলাম কতটা নারকীয় ছিল ওই হামলা। ১১০ তলার দুটি ভবন মূহুর্তের মধ্যেই ধ্বসে পড়ল। প্রান হারাল প্রায় তিন হাজার নিরপরাধ নিরীহ মানুষ। ও হ্যাঁ, পুরোপুরি নিরপরাধ অবশ্য তারা ছিল না। তাদের অনেক বড় একটি অপরাধ ছিল যে, তারা কাফির। যদিও সবাই না। তবে কাফিরদের রাজ্যে বসবাস করলে কে অতকিছু দেখতে আসে? আমি পড়ি তখন ক্লাস সেভেনে। ঘটনাটি আমার মনকে ভীষণভাবে আঘাত করেছিল। এতগুলো মানুষকে এভাবে প্রায় ২০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উত্তাপে পুড়ে মরতে হল (কারণ ভবনের দেয়াল ছিল অ্যালুমিনিয়ামের)। “Fitna” নামের একটি সংক্ষিপ্ত প্রামাণ্যচিত্রে ঘটনার বর্বরতাকে আরও স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আগ্রহীরা পারলে সংগ্রহ করে দেখে নিবেন। পরদিন যখন আমি স্কুলে গেলাম, স্কুলের পরিবেশ দেখে আমি নিজের চোখকে, কানকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে সকলের মাঝে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম আমার সহপাঠি বন্ধুদের, “কি ব্যাপার, এতগুলো মানুষ মারা গেল, আর তোমরা আনন্দ করছো?” তাদের সবার মোটামুটি একই জবাব ছিল, “হ্যাঁ, আমেরিকা অবশেষে একটা শিক্ষা পেয়েছে”। তখনও লাদেন বা আল-কায়েদা কেউই হামলার দায় স্বীকার করে নি। কিন্তু তাদের কথা ছিল, “এই ঘটনা যেই ঘটিয়েছে তাকে আমরা সালাম জানাই”। তিন সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যুতে এই ছিল ওদের প্রতিক্রিয়া। রাতারাতি লাদেন বনে যায় বেশিরভাগ মুসলিমদের হিরো। লাদেনের আদর্শ নিয়ে চলতে পারাটা সকলের কাছেই ছিল অত্যন্ত গর্ব করার মত একটি বিষয়। ফুটপাতে হটকেকের মত বিক্রি হতে থাকে লাদেনের পোস্টার। বেশিরভাগ তরুণ মুসলিমদের ঘরের দেয়াল আলোকিত করে ঝুলতে থাকে ওসামা বিন লাদেন, মোল্লা ওমরের ছবি ও পোস্টার। একবার আমি একটা কার্টুন এঁকে বলেছিলাম, “এটা লাদেন”। আর যাই কোথায়, পারলে আমাকে ওখানেই কোরবানি দিয়ে দেয়। যেন আমি নবীর কার্টুন এঁকে ফেলেছি। শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যে নয়, লাদেনের ক্রেজ দেখার মত ছিল আমাদের মিডিয়াতেও। এমন একজন বীরকে তার প্রাপ্য সম্মাননা দিতে যাতে বিন্দুমাত্র গাফিলতি না থাকে, সে দিকে মিডিয়ার সবাই সদা সতর্ক ছিল। আমি সব সময়ই বলি আল-কায়েদা যদি নাইন ইলেভেনের ঘটনা না ঘটাত তাহলে আমাদের আফগানিস্তান ও ইরাকে মার্কিনিদের নির্লজ্জ্ব আগ্রাসন দেখতে হত না। মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়। ২০০১ সালের কয়েক বছরের মধ্যে মুসলিমদের অবস্থান এবং ভোল ৩৬০ ডিগ্রি কোণে ঘুড়ে যায়। যারা ২০০১ সালের হামলার পর মনের আনন্দ ধরে রাখতে পারছিল না তারাই হঠাৎ ওই ঘটনাকে নিন্দনীয় আখ্যা দিতে থাকে। এদের মধ্যে কিছু এমন আছে যারা হয়তো নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছিল। লাদেন আর আল-কায়েদা মানবতার জন্য কত বড় হুমকি এটা অনুধাবন করে হয়তো নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসেছিল। কিন্তু বেশিরভাগই, ৯/১১ এর কারণে লাদেন ও আল-কায়েদা যাদের বুকের সমস্তটা জুড়ে স্থান পেয়েছিল তারা বলতে থাকে – ৯/১১ আমেরিকার সাজানো নাটক। লাদেন আমেরিকার কথাতে চলে। আল-কায়েদাকে আমেরিকাই যালায়। ৯/১১ এর ঘটনা ঘটানো হয়েছিল যাতে ওরা ইরাক, আফগানিস্তানে হামলা চালাতে পারে। এই বদলে যাওয়াকে কি বলে অভিহিত করা যায় তা আমার জানা নেই। কোন ইহুদি যদি আমাকে এসে বলে যে, ফিলিস্তিনিরাই ইসরাইলি সেনাদের পোশাক পড়ে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে, তাকে বিশ্বাস করাটা যতটা অসম্ভব, কোন সুস্থ মানুষের পক্ষে ততটাই অসম্ভব ওদের এই আধুনিক দাবিগুলোকে মেনে নেয়া। আচ্ছা নিম্নের দাবিগুলোকে মেনে নিলে কেমন দেখায় একবার বলুন তো? ৮ই মার্চ মাদ্রিদে স্পেনিয়রাই ট্রেনে হামলা চালিয়েছিল। মুম্বাইয়ের সন্ত্রাসী হামলা ভারতীয়দের সাজানো নাটক। লন্ডনের ৭/৭ বোমা হামলাও ব্রিটিশরাই করেছে। আমাদের সীমান্তে বাঙ্গালিরা নিজেরাই নিজেদের হত্যা করে বিএসএফের নামে দোষ দেয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের কলঙ্কিত করার জন্য ইহুদিরা নিজেদের হত্যা করেছিল। হিরোশিমা, নাগাসাকিতে আসলে জাপানিরাই পরমাণু বোমা ফেলেছিল। এই ধরণের কোন হামলার দায় হামলার ভিকটিমদের উপর চাপিয়ে দেয়াটা আসলে অস্বাভাবিক কিছু নয়। ২১শে আগস্টের বোমা হামলার দায়ও যেমন আওয়ামী লীগের উপর চাপানো হয়েছিল। এখন যেমনটা দেখা যায়, কোন ইভটিজিংএর শিকার হলে সব দোষ ওই মেয়ের ঘাড়ে কিভাবে চাপানো যায় তা নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠে। তবে ইনারা জাতে মাতাল হলেও তালে আবার ঠিক রয়েছেন। টুইন টাওয়ারের ধ্বংসলীলার সাক্ষী হয়ে থাকা গ্রাউন্ড জিরোতে উনাদের আবার মসজিফ নির্মাণ করা চাই। হায়রে মানুষ। হাজার হাজার মানুষ যেখানে এসে নিজেদের হারানো স্বজনদের কথা স্মরণ করে চোখের জল ফেলে, সেখানে নিজেদের উপাসনালয় স্থাপনা করে যেন তারা বিজয় নিশান টাঙ্গাতে চলেছেন। আবার এর প্রতিবাদ করলে তারা আবার এটাকে ‘ইসলামবিদ্বেষ’ বলে চিল্লাতে থাকে। আমার খুবই অবাক লাগে মানুষ পরিস্থিতির প্রয়োজনে নিজের ভোল এতটা পালতে ফেলতে পারে? লাদেনের মৃত্যুর পর পাকিস্তানের সাধারন মানুষের কান্না আমরা দেখেছি। সে দিক থেকে আমরা আমাদের দেশীয় জন্য গর্বিত হতে পারি। তারা কাঁদলেও সেটাকে তারা চেষ্টা করেছে ভিতরেই রেখে দেয়ার। কিন্তু এটাও কি তারা পেরেছে? লাদেনের মৃত্যুতে মুসলিমদের মধ্যে তিন রকম প্রতিক্রিয়া দেখেছি। এক যারা কেঁদে ভাসিয়েছে; দুই যারা মেনে নিয়েছে লাদেন একজন সন্ত্রাসী, এটা তার পাওনা ছিল এবং তিন, যাদের অন্তর ফেটে গেলেও মুখে হাসি নিয়ে বেড়িয়েছে। ভাবছেন এই তৃতীয় গোষ্ঠীকে কিভাবে চেনা যায়? যদি কাউকে বলতে দেখেন, “এই লাদেন ব্যাটা ছিল আমেরিকার এজেন্ট। এই যা করছে সবই আমেরিকা তারে দিয়া করাইছে। এখন আমেরিকাই যদি তারে মাইরা ফেলে তো আমাদের কি করার আছে?” বুঝবেন এরাই পরে ওই তৃতীয় গোষ্ঠীর মধ্যে।